ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

ইতিহাস সম্মিলনীর একক বক্তৃতায় ঢাবি অধ্যাপক এমএম আকাশ

স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম বঙ্গবন্ধুর চিরস্থায়ী কীর্তি

প্রকাশিত: ০৫:৫১, ২৩ আগস্ট ২০১৫

স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম বঙ্গবন্ধুর চিরস্থায়ী কীর্তি

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ ‘বঙ্গবন্ধুর জীবনটা ছিল অত্যন্ত বর্ণাঢ্য, ঘটনাবহুল, উত্থান-পতনের বৈচিত্র্যে ভরপুর। বারে বারে তিনি নিজেই নিজের আত্মসীমা অতিক্রম করে গেছেন। নিছক ভৌগোলিক অর্থেও তাঁর বিচরণ ছিল বিশ্বব্যাপী বিস্তৃত। তিনি সাধারণভাবে নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির অনুসারী ছিলেন কিন্তু প্রয়োজনে কখনও কখনও সাহসী ও আপোষহীন হতে দ্বিধা করেননি। তাঁরই ধ্রুবতারা সুলভ অনুপ্রেরণায় সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্য দিয়ে জন্ম লাভ করেছিল একটি নতুন দেশ, স্বাধীন বাংলাদেশ। এটিই তাঁর চিরস্থায়ী কীর্তি।’ শনিবার রাজধানীর জাতীয় জাদুঘরের সুফিয়া কামাল মিলনায়তনে বাংলাদেশ ইতিহাস সম্মিলনীর উদ্যোগে জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে একক বক্তৃতায় জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে এভাবেই মূল্যায়িত করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক এম এম আকাশ। ‘বঙ্গবন্ধু : ইতিহাসের নির্মাতা- ইতিহাসের ট্র্যাজেডি- ইতিহাসের শিক্ষা’ শীর্ষক এই একক বক্তৃতার শেষাংশে অধ্যাপক এম এম আকাশ বলেন, প্রত্যেক মানুষের মধ্যেই সকল মানবিক গুণাবলী সুপ্ত বীজের আকারে বিদ্যমান। কখনও কখনও একটি বিশেষ মন্দগুণ অঙ্কুরিত হয়ে প্রকাশিত হয় এবং প্রায়ই তখন মানুষকে আর মানুষের মতো দেখায় না। কিন্তু তখনও তো সে মানুষই রয়ে যায়- তাই নয় কি? বঙ্গবন্ধুর যথার্থ মূল্যায়নের সময় আমাদের মনে রাখতে হবে যে ‘মানুষ হচ্ছে নদীর মতো’। বঙ্গবন্ধু একই সঙ্গে ছিলেন ইতিহাসের নির্মাতা, ইতিহাসের বিয়োগান্তক শোকগাঁথা এবং ইতিহাসের শিক্ষা ও প্রেরণাও বটে। ইতিহাস সম্মিলনীর সভাপতি বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ, লেখক, কলামিস্ট অধ্যাপক মুনতাসীর মামুনের সভাপতিত্বে একক বক্তৃতা অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখেন সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক মেসবাহ কামাল। এ সময় উপস্থিত ছিলেন অধ্যাপক রেহমান সোবহান, সিপিবির হায়দার আকবর খান রনো, চিত্রশিল্পী হাশেম খান, সিপিবির রুহিন হোসেন প্রিন্স প্রমুখ। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে একক বক্তৃতায় অধ্যাপক এম এম আকাশ ইতিহাসের নির্মাতা, ইতিহাসের ট্র্যাজেডি এবং ইতিহাসের শিক্ষা এই তিনটি শিরোনামের ওপর তাঁর বক্তব্য রাখেন। ইতিহাসের নির্মাতা বঙ্গবন্ধু অধ্যায়ে এম এম আকাশ বলেন, ইতিহাসের সবসময় নেতৃত্বের বিভিন্ন অংশের মধ্যে কর্মসূচীগত টানাপোড়েন থাকে। নেতাদের মধ্যে যারা সফল তারা অনুসারীদের নিয়ে সামনে এগিয়ে যান। সেজন্য সবসময় তাদের খেয়াল রাখতে হয় যেন নেতৃত্বের ‘ইঞ্জিনটি’ জনগণের ‘বগিগুলো’ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে না যায়। তিনি বলেন, এটি তখনই সম্ভব হয় যখন দক্ষ নেতৃত্ব জনগণের চেতনার ব্যারোমিটারের মাত্রাটি ভালভাবে মাপতে পারেন এবং ঐ মাত্রার ওঠা নামার সঙ্গে দ্রুত খাপ খাইয়ে নিয়ে আন্দোলনের কৌশল ও সেøাগান বদলে ফেলতে পারেন। এই ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধুর যে বিশেষ এক ধরনের নমনীয়তা ও গণবোধ ছিল তা ইতিহাসে একাধিকবার প্রমাণিত হয়েছে। তা না হলে তিনি মুসলিম লীগ থেকে আওয়ামী মুসলিম লীগ এবং আওয়ামী মুসলিম লীগ থেকে আওয়ামী লীগ এবং আওয়ামী লীগ থেকে কৃষক-শ্রমিক-আওয়ামী লীগে উত্তরণ ঘটাতে পারতেন না। তবে তাঁর সর্বশেষ উত্তরণটি সফল না হয়ে ট্র্যাজেডিতে পরিণত হয়। তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু মনেপ্রাণে ছিলেন বাঙালী। বাংলার লোকসমাজ, বাঙালী খাদ্য, বাঙালী সংস্কৃতি, বাংলাদেশের সবুজ প্রকৃতির প্রতি তাঁর ছিল প্রগাঢ় ভালবাসা ও একক অঙ্গীকার। রাজনৈতিক আদর্শের ক্ষেত্রেও বঙ্গবন্ধু ছিলেন অসাম্প্রদায়িক। একই সঙ্গে সোহরাওয়ার্দীর ভক্ত এবং কোন কোন ক্ষেত্রে সমালোচক। মওলানা ভাসানী ও শেরে বাংলার প্রতি তাঁর দুর্বলতা ছিল। এসব থেকে বোঝা যায়, বিভিন্ন ধারার জাতীয় নেতৃবৃন্দের কাছ থেকে বঙ্গবন্ধু নানা ধরনের গণতান্ত্রিক, রেডিকেল ও জাতীয়তাবাদী উপাদান গ্রহণ করেছিলেন। তাই তাঁর ভাবাদর্শের একটি বিচিত্র ‘কেমিস্ট্রি’ তৈরি হয়েছিল। অধ্যাপক এম এম আকাশ তাঁর বক্তৃতায় আরও বলেন, বঙ্গবন্ধু ‘মুসলমান’ অভিধাটি ব্যক্তিগত পরিচয়ের ক্ষেত্রে কখনও পরিত্যাগ করেননি। একার্থে তিনি ধর্মপরায়ণও ছিলেন, যদিও ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতার তিনি তেমন পরোয়া করতেন না। রাজনীতি ও আদর্শের ক্ষেত্রে তিনি ধর্মীয় পরিচয় বা ধর্মের ব্যবহারকে ক্রমশ পরিত্যাগ করেছিলেন। তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধুর আদর্শে সবচেয়ে বড়ভাবে কাজ করেছে সাধারণ মানুষের প্রতি অপার ভালবাসা। বাঙালীকে মনেপ্রাণে ভালবাসলেও তাদের তিনটি বিশেষ দুর্বলতাকে তিনি চিহ্নিত করতে ভুলেননি। সেগুলো হচ্ছে-পরশ্রীকাতরতা, মুখবুজে অত্যাচার সহ্য করার অভ্যাস এবং কুসংস্কার বা অলৌকিকতায় বিশ্বাস। এসব দোষগুলো থেকে নিজেকে মুক্ত রাখার ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধুকে সাহায্য করেছে তাঁর অসম্ভব আত্ম-সম্মানবোধ এবং আপোষহীন ইগো (অহংকার)। তিনি বলেন, কে স্বাধীনতার ঘোষক, কে ঘোষক নয়, এ নিয়ে একটি অর্থহীন বিতর্ক আজও অব্যাহত আছে। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চে প্রদত্ত বক্তৃতাটি ভাল করে পড়লে বোঝা যায় যে, বাংলাদেশ তখন তাঁর কথাতেই উঠছে বসছে। সমগ্র প্রশাসন যন্ত্র, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, সকল বাঙালী-অবাঙালী নাগরিক ইত্যাদি সকলেই তখন বঙ্গবন্ধুর প্রশাসনিক কর্তৃত্ব মেনে নিয়েছেন। সুতরাং আইনগতভাবে না হলেও মার্চ মাসের অসহযোগ আন্দোলনকালে বাস্তবে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়ে গেছে। ইতিহাসের ট্র্যাজেডি অধ্যায়ে অধ্যাপক এম এম আকাশ বলেন, বঙ্গবন্ধুর উদার হৃদয়, ক্ষমাশীলতা, বিশ্বাস প্রবণতা, ভালবাসার আবেগ এবং দুঃসাহস যেমন একসময় পাকিস্তান ভেঙ্গে বাংলাদেশ সৃষ্টির ইতিহাসটি নির্মাণ করতে সহায়ক হয়েছিল। আবার এই মহৎ প্রবণতাগুলোই স্বাধীনতা-উত্তরকালে তাঁকে দুর্বল ও অসতর্ক করে ফেলেছিল এবং প্রয়োজনীয় কঠোরতা ও সতর্কতা অবলম্বন করতে দেয়নি। তিনি সর্বদাই ক্ষমা করে ভালবেসে ভারসাম্য করতে চেয়েছেন। আর তাঁর পক্ষপুটে থেকেই খন্দকার মুশতাক গং তাঁকে ছোবল মারার জন্য গোপনে প্রস্তুত হয়েছিল। তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মৃত্যুর পর বিস্মৃতির অতল গহ্বরে হারিয়ে যাননি বরং দিনকে দিন আরও শক্তিশালী আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠছেন তিনি। নতুন প্রজন্ম নতুন করে যতই তাঁদের শেকড় এবং ইতিহাস খুঁজতে প্রবৃত্ত হচ্ছেন- ততই বঙ্গবন্ধুকে আরও বেশি বেশি করে জানার আগ্রহ উদ্দীপনা তৈরি হচ্ছে। ১৯৭৫ সালে মৃত্যুর পর ৪০ বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। এই সময়ে প্রতিক্রিয়াশীল ইতিহাস নির্মাতারা বহুভাবে বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিকে বিকৃত করেছে, চাপা দেয়ার চেষ্টা করেছে। কিন্তু আলোর আকর্ষণে অঙ্কুর যেমন মাটি ভেদ করে জেগে উঠছে, তেমনি বঙ্গবন্ধুর কীর্তি ও প্রতিশ্রুতিগুলো আজ আবার বিস্মৃতিকে ভেদ করে জেগে উঠছে।
×