ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

আজ হার্ডিঞ্জ ব্রিজ দেখতে পাকশী যাচ্ছেন বিশেষজ্ঞ দল

প্রকাশিত: ০৫:৫৫, ২৩ আগস্ট ২০১৫

আজ হার্ডিঞ্জ ব্রিজ দেখতে পাকশী যাচ্ছেন বিশেষজ্ঞ দল

স্টাফ রিপোর্টার, ঈশ্বরদী ॥ সর্বগ্রাসী কাল হরণ করতে পারেনি এক শ’ বছর অতিক্রমকারী হার্ডিঞ্জ সেতুর সৌন্দর্য। কংক্রিটের ঢালাই আর ইস্পাতের তৈরি বিশ্বের অন্যতম বৃহত্তম দৃষ্টিনন্দন রেলওয়ে হার্ডিঞ্জ সেতু ঘষেমেজে আর রঙের প্রলেপ দিয়ে শ্যাওলাযুক্ত ময়লার আস্তরণমুক্ত রাখা হয়েছে দীর্ঘদিন থেকেই। যতেœর অভাব না থাকায় এটির আর্কষণ নির্মাণকালের মতোই রয়ে গেছে। নান্দনিক নির্মাণশৈলী আর কংক্রিটের ঢালাই ও গুণগত মানের ইস্পাতের তৈরি স্প্যানের আকর্ষণেও কমতি ঘটেনি। মোটেও স্বপ্ন নয়। নিভৃত গ্রামের মানুষও এটিকে বাস্তবেই বিশ্বাস করে পৃথিবীর একটি দৃষ্টিনন্দিত উন্নত রেল সেতু হিসেবে। আমাদের দেশের কেউ কেউ ইতিহাস ঐতিহ্য থেকে পিছিয়ে থাকলেও সমহিমায় উজ্জ্বল হার্ডিঞ্জ সেতু পদ্মা নদীর উপর দাঁড়িয়ে আছে সেই ব্রিটিশ আমল থেকেই। অবিভক্ত ভারতের কলকাতার সঙ্গে আসাম ও পূর্ববঙ্গের যোগাযোগ সহজ করার লক্ষে ১৮৮৯ সালে ইস্টার্ন বেঙ্গল রেলওয়ে কর্তৃক পদ্মা নদীর উপর সেতু নির্মাণের প্রস্তাব পেশ করা হয়। দীর্ঘ ২০ বছর আলোচনার পর ১৯০৮ সালে প্রস্তাব গৃহীত হয়। প্রস্তাবে সিঙ্গেল লাইন বিশিষ্ট সেতু নির্মাণের কথা থাকলেও চূড়ান্ত নকশায় দ্বৈত লাইনের ব্যবস্থা রাখা হয় এবং নির্মাণ করা হয়। গৃহীত প্রস্তাব ও চূড়ান্ত নকশা অনুযায়ী পাকশীতে পদ্মা নদীর ২৮ ফুট উপরে ১৯১০ সালে ১ দশমিক ৮১ কিলোমিটার দীর্ঘ হার্ডিঞ্জ সেতুর নির্মাণ কাজ শুরু করা হয়। নির্মাণ কাজ শেষ করা হয় ১৯১৫ সালে। সেতুতে মূল পায়ার সংখ্যা রাখা হয় ১৬টি। মূল স্প্যানের সংখ্যা ১৫টি। ল্যান্ড স্প্যানের সংখ্যা ৬টি। প্রতিটি ল্যান্ড গার্ডারের দৈর্ঘ্য ধরা হয় ৭৫ ফুট। প্রতিটি মূল গার্ডারের দৈর্ঘ্য ৩শ’ ৪৫ ফুট ১ দশমিক ৫০ ইঞ্চি, উচ্চতা ৫২ ফুট এবং ওজন ১২শ’ ৫০ টন। নির্মাণ কাজে মোট ২৪ হাজার জনবল অংশ নেয়। নির্মাণ ব্যয় হয় ৪ কোটি ৭৫ লাখ ৫০ হাজার ভারতীয় রুপী। নদীর উভয় তীরে সেতু রক্ষা বাঁধের মোট দৈর্ঘ্য ধরা হয় ৬ মাইলের উর্ধে। তিন কোটি ঘনফুটেরও বেশি বোল্ডার পাথর সেতু রক্ষা বাঁধে ব্যবহার করা হয়। ১৫টি মূল গার্ডার এবং ৬টি ল্যান্ড গার্ডারে মোট ৩০ হাজার টন ইস্পাত ব্যবহার করা হয়। এ সেতু নির্মাণের জন্য, সেতু এপ্রোচে ১৬ কোটি ঘনফুট ও গাইড বাঁধে ৩ কোটি ৮৬ লাখ ঘনফুট মাটির কাজ করা হয়। সেতুর ডেটাম ধরা হয়েছে কক্সবাজার সমুদ্র পৃষ্ঠের গড় উচ্চতা থেকে ২০০ ফুট নিচে। রেল লেভেল ধরা হয় ২’শ ৯৬ ফুট। পায়ার টপ লেভেল ২শ’ ৫০ ফুট এবং সেতু বা বাঁধের টপ লেভেল ধরা হয় ২শ’ ৬০ ফুট। ১৯১৫ সালের ১ জানুয়ারি সেতুর নি¤œগামী লাইনে পরীক্ষামূলক প্রথম ট্রেন চালানো এবং সেতুর উর্ধগামী লাইনে পরীক্ষামূলক প্রথম ট্রেন চালানো হয় ১৯১৫ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি। সেতুর উদ্বোধন করা হয় ১৯১৫ সালের ৪ মার্চ। সেতুর উদ্বোধন করেন ভাইসরয় অব ইন্ডিয়া ব্যারন হার্ডিঞ্জ অব পেনসুরষ্ট। সেতুটির প্রধান প্রকৌশলীর দায়িত্ব পালন করেছেন স্যার রবার্ট উইলিয়াম গেইল্স। স্বাধীনতা যুদ্ধে সেতুর ১২ নং মূল গার্ডার ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ক্ষতিগ্রস্ত ১২ নং মূল গার্ডার প্রতিস্থাপনের পর ১৯৭৫ সালের ৫ আগস্ট সেতু দিয়ে পুনারায় ট্রেন চলাচল শুরু হয়। নির্মাণকালীন সময়ে মূল স্প্যানের ক্যাম্বার তৈরি করা হয় ৬ দশমিক ৫ ইঞ্চি এবং পদ্মা নদী দিয়ে নৌচলাচলের জন্য সেতুর নিচে হেডওয়ে দেয়া হয় ৪০ ফুট। কোন প্রকার নির্মাণ ত্রুটি, বিরূপ প্রভাব ছাড়াই উন্নত নকশা ও গুণগতমানের কারণে পাকশী হার্ডিঞ্জ সেতুর ইতোমধ্যে এক শ’ বছর অতিক্রম করেছে। এ অবস্থায় বিশ্বের সেতু বিশেষজ্ঞ দলের সদস্যরা এটির নির্মাণ শৈলী, সুযোগ সুবিধা, রক্ষণাবেক্ষণ, অগ্নি নির্বাপন ব্যবস্থা, জনবল ও ব্যবস্থপনাসহ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সরেজমিনে অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য পাকশী আসছেন ৫০ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল নিয়ে রবিবার দুপুরে। এ দলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন আন্তর্জাতিক সেতু বিশেষজ্ঞ প্রকৌশলী সংগঠনের সদস্য ও বাংলাদেশের প্রখ্যাত সেতু প্রকৌশলী জামিলুর রেজা চৌধুরী। ব্রিটিশ আমল থেকেই হার্ডিঞ্জ ব্রিজ নির্মাণকে কেন্দ্র করে পাকশী পদ্মা নদীর পাদদেশে গড়ে ওঠে পাকশী রেলওয়ে বিভাগীয় শহর। সে সময় এ শহরে বসবাস করাটা ছিল সৌভাগ্যের ব্যাপার। অনেকটা সোনার হরিণের মতো। শতবর্ষী হাজারো সবুজ কৃষ্ণচূড়ার ছায়াতলে অফিসার বাংলোসহ রেল কোয়ার্টারে বসবাস করত অফিসারদের পরিবারসহ অন্যান্য স্টাফ। অনেকে তখন প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে পাকশী শহরকে এক পলক দেখার জন্য ভিড় করত। নদীর গর্জন আর সবুজে ঘেরা পাকশী শহর ছিল দেশবরেণ্য অনেকের কাছেই ঐতিহাসিক স্থান। এখানকার অফিস থেকেই চলত দার্জিলিং এক্সপ্রেস, আসাম মেলসহ নানা প্রকার ট্রেন। পাশেই সাঁড়াঘাটে নৌঙর করত দেশী-বিদেশী স্টিমার, জাহাজসহ আরও কত কি। বিদেশী নাবিকদের পদভারে মুখরিত থাকত এ অঞ্চল। সাধারণের জন্য চালু হয়েছিল সিভিল হাট। সেই হাটে শুধু স্থানীয়রাই কেনাবেচা করত। কিন্তু কালের পরিক্রমায় সেই পাকশী শহর এক সময় জৌলুস হারিয়ে ফেলে। এভাবে চলে দীর্ঘদিন। উন্নয়নকামী রেল কর্মকর্তা ও রাষ্ট্র পরিচালকদের নজরে পড়ে পাকশীর হারানো অতীত ঐতিহ্যের ইতিহাস। তারা ভাবতে থাকেন কিভাবে হারানো ঐতিহ্যকে আবারও ফিরিয়ে আনা যায়। সেই আলোকেই শুরু হয় পাকশী রেলওয়ে বিভাগীয় উন্নয়নমূলক কর্মকা-। সংরক্ষণ করা হয়েছে ব্রিটিশ আমলের স্টিম ইঞ্জিন কোচ ও হার্ডিঞ্জ সেতুর উপর নিক্ষেপিত বোমার অংশ বিশেষ। নিমাণন করা হয়েছে অত্যাধুনিক রেস্ট হাউস। সংস্কার করা হয়েছে অফিস বাসা বাড়ি। নির্মাণ করা হয়েছে বাংলাদেশে রেল অঞ্চলে প্রথম পার্কিং টাইলসের রাস্তা।
×