ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

গাছে গাছে মাটির কলস, বাসযোগ্য পরিবেশ

প্রকাশিত: ০৬:১০, ২৫ আগস্ট ২০১৫

গাছে গাছে মাটির কলস, বাসযোগ্য পরিবেশ

বাবু ইসলাম ॥ ছোট্ট গ্রাম আগনুকালী। কাঁচা-পাকা পথের ধারে গাছ-গাছালির ছায়াঘেরা এ গ্রামটি পাখির অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে। শিকার বন্ধ করে পাখির বাসযোগ্য পরিবেশ গড়ে তোলার ব্যতিক্রমী কার্যক্রমের ফলে গ্রামটি এখন পাখির অভয়ারণ্য। গ্রামের বিভিন্ন ধরনের গাছের ডালে ইতোমধ্যে প্রায় আড়াই শ’ মাটির কলসি বেঁধে পাখির নিরাপদ আশ্রয় নিশ্চিত করা হয়েছে। প্রতিদিন ভোরে এবং গোধূলি লগ্নে পাখির কিচির মিচির শব্দে গোটা গ্রাম জেগে ওঠে। সেখানে একটি পাখিবান্ধব গ্রামের আবহ সৃষ্টি হয়েছে। মাত্র সাড়ে ৩ মাসের প্রচেষ্টায় গ্রামের উদ্যমী দু’যুবক মামুন বিশ্বাস ও ইমন সরকার গ্রামটিকে পাখির অভয়ারণ্যে পরিণত করেছে। সিরাজগঞ্জ জেলার শাহজাদপুর উপজেলার বেলতৈল ইউনিয়নের কাঁচা-পাঁকা মেঠোপথের গাছ-গাছালির ছায়াঘেরা এ গ্রামটিতে চার হাজার লোকের বসবাস। ছোট এই গ্রামটিকে মাত্র সাড়ে ৩ মাসের প্রচেষ্টায় মামুন বিশ্বাস ও ইমন সরকার নামের দুই যুবক বন্য পাখির অভ্যয়ারণ্যে পরিণত করেছে। দিনরাতের পরিশ্রমে তাদের এই সাফল্যে গ্রামবাসীসহ আশপাশের লোকজন মুগ্ধ হয়ে পড়েছে। ফলে ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনা নিয়ে গ্রামবাসীও তাদের এই কাজে সহয়োগিতার হাত বাড়িয়েছে। এ পর্যন্ত এ গ্রামের ২৩৭টি গাছে বিশেষভাবে তৈরি পাখির বাসযোগ্য একটি করে মাটির কলস বেঁধে দেয়া হয়েছে। ফলে এ গ্রামটি এখন পাখিদের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে। শুধু তাই নয়, আশপাশের লিছিমপুর, রায়পাড়া, সিকদারপাড়া, মধ্যপাড়া, সাতবাড়ীয়া, ভেন্নাগাছি, লক্ষ্মীপুরসহ ১০টি গ্রামকেও এর আওতায় এনে গাছে কলস বাঁধার কাজ চলছে। আগামী ৬ মাসের মধ্যে এই গ্রামগুলোও বন্য পাখির অভয়ারণ্যে পরিণত হবে বলে আশা করা হচ্ছে। বৃক্ষ নিধন, উপযুক্ত খাদ্য সঙ্কট, ক্ষেতে-খামারে মাত্রাতিরিক্ত রাসায়নিক স্যার ও কীটনাশক ব্যবহার, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, অপরিকল্পিত পাকা দালান-কোঠা নির্মাণ ও শিকারিদের তা-বে এ অঞ্চলে দেশীয় প্রজাতির পাখির সংখ্যা দিন দিন আশঙ্কাজনক হারে কমে যাওয়ায় এ দু’যুবক বিষয়টি দৃষ্টিগোচরে এনে নিজ উদ্যোগে পাখির অভয়াশ্রম গড়ে তোলার ব্যতিক্রমী এ কার্যক্রম শুরু করেছে। সরেজমিন আগনুকালী গ্রাম ঘুরে দেখা যায়, রাস্তার ধারে, পুকুরের পাড়ে, জমির পাশে, বিভিন্ন বাসা বাড়ির গাছের ডালে ডালে মাটির কলস বাঁধা হয়েছে। এ গ্রামের শাহীন, সুজন, নবী, কামরুল জানান, প্রথম দিকে এদের সবাই পাগল বললেও এখন এ কাজে তারা উৎসাহ দিয়ে নানাভাবে সহযোগিতা করছে। এ ছাড়া গ্রামের ছোট বড় সবাই এখন পাখি শিকার বাদ দিয়ে পাখির বাসযোগ্য উপযুক্ত পরিবেশ তৈরিতে সহযোগিতা করছে। ফলে সকলের সহযোগিতায় গ্রামটি এখন পাখিকুলের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে। এ ব্যাপারে উদ্যোক্তা মামুন বিশ্বাসের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ইতোমধ্যেই তারা পাখি সংরক্ষণ, প্রজনন ও নিরাপদ বাসস্থান গড়ে তোলার লক্ষ্যে ’দি বার্ড সেফটি হাউস’ নামে একটি সংগঠন গড়ে তুলেছে। এ সংগঠনের সদস্য ও কর্মী সুজন, কামরুল, নবী, শাহীনসহ অনেকই জানান, তারা এ কাজে এলাকাবাসীর ব্যাপক সাড়া পাচ্ছেন। ফলে তাদের এ কাজে আরো উৎসাহ-উদ্দীপনা বেড়ে গেছে । তারা আরও বলেন, এখন থেকেই পাখিকূলের প্রতি যতœবান না হলে ভবিষ্যতে পরিবেশবান্ধব দেশীয় অনেক প্রজাতির পাখি বিলুপ্ত হয়ে যাবে। ইতোমধ্যেই আমাদের দেশ থেকে ৪১ প্রজাতির দেশীয় পাখি বিলুপ্ত হয়ে গেছে। বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি প্রকাশিত তালিকা অনুযায়ী বিলুপ্ত পাখিগুলো হলো , বাদা তিতির, মেটে তিতির, দেশী ময়ূর, সবুজ ময়ূর, পাতিহাঁস, গোলাপি হাঁস, ছোট নাটাবটের, দেশী মেটেধনেশ, মেটে মালকোয়া, মেটেমাথা টিয়া, বাংলা ডাহর, পাতি ডাহর, দেশী সারস, পাতি সারস, ডেমোজিল সারস, খয়রা ঝিলি, ধলা শকুন, হিমালয়ী গৃধিনী, সরুঠুঁটি শকুন, কালা শকুন, রাজ শকুন, ধলাপেট বক, কালা কাস্তেচরা, বড়ধলা গগণবেড়, চিতিঠুঁটি গগণবেড়, রাঙা মানিকজোড়, ধলাগলা মানিকজোড়, কালাগলা মানিকজোড়, বড় মদনটাক, ল্যাঞ্জা মোটাঠুঁটি, দাগিলেজ গাছআঁচড়া, লালতলা প্রিনা, শতদাগি ঘাসপাখি, বাদা ছাতারে, লালমুখ দাগিডানা, কালাবুক টিয়াঠুঁটি, তিলাবুক টিয়াঠুঁটি, লাললেজ মৌটুসি, লম্বাঠোঁট তুলিকা, গেছো তুলিকা। কালো তিতর, জলার তিতর, কাটময়ূর, বোচাহাঁসসহ ৪৭ প্রজাতির দেশীয় পাখি ইতিমধ্যেই হারিয়ে যেতে বসেছে। এখনই সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা না হলে হয়ত অদূর ভবিষ্যতে তা হারিয়ে যাবে। ’দি বার্ড সেফটি হাউস’ এর উদ্যোক্তা মামুন বিশ্বাস বলেন, শুধু আমরা পাখি শিকার থেকে অন্যকে বিরত থাকলে অসংখ্য পাখি রক্ষা পাবে। এতে পরিবেশ ও প্রকৃতির ভারসাম্যও বজায় থাকবে। পাখিরাই হলো আমাদের প্রকৃত বন্ধু। এরাই আমাদের প্রাকৃতিক পরিবেশকে বাঁচিয়ে রেখেছে। প্রাকৃতিক পরিবেশ বেঁচে থাকলে আমরাও বেঁচে থাকব।
×