দু’দিন আগে লন্ডনে আইনের ছাত্রদের এক আলোচনা সভায় গিয়েছিলাম। সেখানে দু’চারজন বাংলাদেশী আইনের ছাত্রও ছিলেন। আলোচনার মুখ্য বিষয় ছিল মধ্যযুগীয় জবাবদিহিতাবিহীন বিচার ব্যবস্থার সংস্কার ও আধুনিকায়ন প্রয়োজন। এই গণতন্ত্রের যুগে বিচার ব্যবস্থাতেও জবাবদিহিতা থাকা আবশ্যক। একজন আলোচক সেই মধ্যযুগ থেকে বর্তমানকাল পর্যন্ত ইউরোপে বিচার ব্যবস্থার বিবর্তন ও আধুনিকায়নের একটা দীর্ঘ ফিরিস্তি দিলেন। রাজার সঙ্গে বিচার ব্যবস্থার লড়াই (বিশেষ করে ইংল্যান্ডে অষ্টম হেনরীর আমলে), পার্লামেন্টের সঙ্গে উচ্চ আদালতের দ্বন্দ্ব, জনগণ কর্তৃক বিচার ব্যবস্থায় জবাবদিহিতা দাবি ইত্যাদি নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা শুনতে শুনতে মনে হয়েছিল, বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থায় কোন প্রকার আধুনিকায়নের ছোঁয়া লেগেছে কি?
সামন্ত যুগের একটা বড় কথাই ছিল ‘কিং ক্যান ডু নো রঙ’, পরে কথাটা আরও সম্প্রসারিত হয়ে দাঁড়িয়েছিল গড, কিং এ্যান্ড জুডিসিয়ারি সর্বপ্রকার জবাবদিহিতার উর্ধে। গডকে অবশ্য জবাবদিহিতার আওতায় আনা মানুষের সাধ্য নেই। কিন্তু রাজাকে তারা এনেছে। ইউরোপে রাজা বলতেই এখন নিয়মতান্ত্রিক রাজা। তার ক্ষমতা তেমন নেই। তাদের আচার-আচরণ এবং কথাবার্তাও জবাবদিহিতার আওতায়। ইংল্যান্ডের রানীকে সবাই শ্রদ্ধা করেন। কিন্তু তিনিও সমালোচনার উর্ধে নন। প্রিন্স চার্লস তো অহরহ সমালোচিত হচ্ছেন।
ব্রিটেনের বিচার ব্যবস্থাতেও একটা বড় ধরনের পরিবর্তন এসেছে। সেই যে আগের শাদা পরচুলা পরা গম্ভীর সৌম্যমূর্তির বিচারক, যাকে ‘মি লর্ড’ বলে সম্বোধন করতে হয়, যিনি বহুকাল ছিলেন জবাবদিহিতার উর্ধে, এখন তার চালচলন বেশভূষা সবই ঠিক আছে, কিন্তু তিনি জবাবদিহিতার উর্ধে নন। কোন গুরুত্বপূর্ণ মামলায় উচ্চ আদালতের রায়ও আগের প্রশ্নহীন অবস্থান হারিয়েছে। এখন সংবাদপত্রে তা সমালোচিত হয়। রায়ের বিরুদ্ধে জনঅসন্তোষ দেখা দিলে সেই রায় আরও উচ্চ পর্যায়ে রিভিয়্যু করা এবং সংশ্লিষ্ট বিচারপতিকে অপসারণেরও দৃষ্টান্ত আছে।
লন্ডনে কিছুকাল আগে এক নারী ধর্ষণের মামলায় বিচারপতি পক্ষপাতিত্ব দেখিয়েছেন অর্থাৎ ধর্ষককে লঘু সাজা দিয়েছেনÑ এই অভিযোগে নারীরা দল বেঁধে রাজপথে বিক্ষোভ মিছিল করেছে। সংবাদপত্রে তার কঠোর সমালোচনা হয়েছে। বিচারপতিকে তার রায়সহ সরে যেতে হয়েছে। ব্রিটেনে এক ট্রেড ইউনিয়ন সংক্রান্ত মামলার রায় দিয়ে লর্ড ডেনিংয়ের মতো বিখ্যাত বিচারপতিকে দেশব্যাপী সমালোচনার ঝড়ের মুখে পড়তে হয়েছিল।
আমাদের উপমহাদেশে ব্রিটিশ শাসনামলে সাম্রাজ্যবাদী শাসকেরা নিজেদের ক্ষমতার স্বার্থে উচ্চ বিচার ব্যবস্থার অবস্থান প্রায় গডের নিচেই নির্ধারণ করে রেখেছিলেন। ফলে আইনের বিচার দেখিয়ে এমন সব মানুষকে রাজদ্রোহের দায়ে মৃত্যুদ- দেয়া হয়েছে, যাদের অধিকাংশ এখন স্বাধীনতার বীরযোদ্ধা হিসেবে দেশবাসীর কাছে স্মরণীয়। নিজের দেশে ব্রিটিশ শাসকেরা বিচার ব্যবস্থার সংস্কার এবং তার জবাবদিহিতার পথ খুলে দিয়েছেন; কিন্তু তাদের কলোনিগুলোতে তা করেননি।
সাম্রাজ্যবাদী শাসকেরা একদিকে উচ্চ আদালতকে দেখিয়েছে একটি সার্বভৌম সংস্থার মতো; অন্যদিকে এই সংস্থাকে এ্যাডমিনিস্ট্রেশনের সূক্ষ্ম প্রভাবের নিচে রেখে তাদের পছন্দ মতো রায় দেয়ার ব্যবস্থাটি নিশ্চিত রেখেছেন। এজন্যই জালিয়ানওয়ালাবাগের ঘটনাও ব্রিটিশ বিচারপতির চোখে বর্বর হত্যাকা- বলে বিবেচিত হয়নি। বিচার ব্যবস্থায় শাসন বিভাগের এই অদৃশ্য অঙ্গুলি হেলনের ধারাটি উপমহাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরে বহুদিন অব্যাহত ছিল।
পাকিস্তানের প্রয়াত বিচারপতি কায়ানি একবার বিদ্রƒপ করে বলেছেন, ‘সরকার যেসব মামলায় আগ্রহী, সেসব মামলায় কী রায় দেব তা জানার জন্য এজলাসে বসে আইনমন্ত্রীর একটি চিরকুটের জন্য আমাকে অপেক্ষা করতে হতো।’ পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর পূর্ব পাকিস্তানে বায়ান্ন সালের দিকে চীফ জাস্টিস ছিলেন একজন ব্রিটিশ। জাস্টিস স্যার এলিস। বায়ান্ন সালের ২১ ফেব্রুয়ারি তারিখে ভাষা আন্দোলনকারীদের ওপর পুলিশের গুলিবর্ষণের তদন্তের নামে (জনসাধারণকে প্রবোধ দেয়া) তৎকালীন মুসলিম লীগ সরকার এই জাস্টিস এলিসকে দিয়ে একটি এক ব্যক্তির তদন্ত কমিশন নিয়োগ করেছিলেন। নাম ছিল এলিস কমিশন।
এই এলিস কমিশন রায় দিয়েছিল, ‘গুলিবর্ষণ বৈধ ছিল। পুলিশকে বাধ্য হয়ে গুলি চালাতে হয়েছে।’ এলিস সাহেব শুধু এ কথা বলেই থামেননি। পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালীরা যে গণতন্ত্র লাভের যোগ্য নয়, বরং তাদের পিটিয়ে শাসন করা দরকার এ কথা প্রমাণ করার জন্য তিনি তার রায়ে লিখেছিলেন, ‘টেমস নদীর তীর থেকে গণতন্ত্রের বীজ এনে বুড়িগঙ্গার পারে পুঁতলে তাতে কোন ফল হবে না। বুড়িগঙ্গার পারের মাটি গণতন্ত্রের উপযোগী নয়।’
এলিস কমিশনের এই রায়ের বিরুদ্ধে সারা পূর্ব পাকিস্তানে প্রতিবাদের ঝড় উঠেছিল। ইউসুফ আলী চৌধুরী, মোহন মিয়ার পরিচালিত অধুনালুপ্ত দৈনিক ‘মিল্লাতের’ প্রধান সম্পাদকীয় নিবন্ধের হেডিং দেয়া হয়েছিলÑ ‘বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদে।’ এই সম্পাদকীয়তে এলিস কমিশনের রায়ের পেছনে সরকারের কারসাজি থাকার অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছিল।
কলোনিয়াল যুগের বিচার ব্যবস্থার বিভিন্ন ত্রুটি ও সীমাবদ্ধতা লক্ষ্য করেই স্বাধীন বিচার বিভাগ প্রতিষ্ঠার দাবির জন্ম। কিন্তু সেই সঙ্গে স্বাধীন বিচার ব্যবস্থায় জবাবদিহিতার ব্যবস্থা রাখার দাবি ওঠে। ‘কিং ক্যান ডু নো রঙ’ এই কথাটি কেউ যেমন এখন গ্রাহ্য করে না, তেমনি সর্বোচ্চ বিচার ব্যবস্থার মর্যাদা প্রায় গডের কাছাকাছি এই ধারণাটিরও এখন অবসান হয়েছে। বিচারপতিরাও মানুষ, তারাও সাধারণ মানুষের মতো ভুলত্রুটি করতে পারেন।
সম্প্রতি বাংলাদেশে ’৭১-এর যুদ্ধাপরাধী সা.কা. চৌধুরীর মৃত্যুদ-াদেশের রিভিয়্যুর মামলার রায় হওয়ার আগে দৈনিক জনকণ্ঠে নির্বাহী সম্পাদক স্বদেশ রায়ের একটি নিবন্ধে প্রধান বিচারপতি সম্পর্কে কিছু মন্তব্য প্রকাশিত হওয়ায় স্বদেশ রায় এবং দৈনিকটির সম্পাদক আতিকউল্লাহ খান মাসুদ দু’জনেই আদালত অবমাননার দায়ে অভিযুক্ত হন। এই মামলাটির বৈশিষ্ট্য এই যে, অভিযুক্ত সম্পাদকদ্বয় আদালতের কাছে ক্ষমা চাননি, বক্তব্য প্রত্যাহার করেননি। মহামান্য আদালতও তাদের আদালত চলাকালীন সময়ের কারাদ- এবং কিছু অর্থদ-ের ব্যবস্থা করেই ক্ষান্ত রয়েছেন।
মামলাটি এখন চুকেবুকে গেছে এবং এ সম্পর্কে নতুন করে বলারও আর অবকাশ নেই। মহামান্য আদালতের নির্দেশ সম্পর্কেও আমার বলার কিছু নেই। কিছু থাকা উচিতও নয়। আমার বলার কথা স্বদেশ রায়ের নিবন্ধটির পটভূমি নিয়ে। ’৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, দ-াদেশ ও দ-াদেশের রিভিয়্যু নিয়ে দেশ-বিদেশে নানা ধরনের তর্ক-বিতর্ক চলছে। ’৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের সমর্থকরা এবং তাদের দ্বারা নানাভাবে প্রভাবিত কিছু বিশিষ্ট বিদেশী আইনজীবী এই বিচার ব্যবস্থার স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতা নিয়ে অনবরত বিরূপ প্রচারণা চালাচ্ছেন। অন্যদিকে এই দেশী-বিদেশী প্রচারণার চাপে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের জন্য দায়ী ব্যক্তিরা যাতে বিচারে লঘু সাজা না পায় সেজন্যও দেশে গণজাগরণ মঞ্চ আন্দোলন গড়ে তুলেছে।
এই আন্দোলনের মুখেই যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন কারাদ- শেষ পর্যন্ত মৃত্যুদ-ে রূপান্তরিত হয়। অর্থাৎ ন্যায় বিচার হয়। ইউরোপেও এর নজির আছে। কোন গুরুতর অপরাধের জন্য বিচারপতি অপরাধীকে যে কোন কারণেই হোক লঘু শাস্তি দিয়েছেন। কিন্তু জনঅসন্তোষের মুখে সেই রায় পাল্টে গেছে। বাংলাদেশে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের সময় পালের গোদা গোলাম আযমের মৃত্যুদ-াদেশ না হওয়ায় এবং দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর চরম দ- বদলে গিয়ে যাবজ্জীবন কারাদ-ের আদেশ হওয়ায় জনমনে একটা সন্দেহ ও আশঙ্কা দেখা দিয়েছিল যে, সা.কা. চৌধুরীও তার প্রাপ্য চরম দ- রিভিয়্যু মামলায় না এড়িয়ে যান। মুখ্যত জনগণের এক ব্যাপক অংশের এই সন্দেহ ও ভয়ের ভাবটিই প্রতিফলিত হয়েছিল জনকণ্ঠে স্বদেশ রায়ের নিবন্ধে। মহামান্য সর্বোচ্চ আদালত অবশ্য সা.কা. চৌধুরীর মৃত্যুদ-াদেশ বহাল রেখে জনমনের এই সন্দেহ ও ভীতি দূর করেছেন। তবে সাধারণ মানুষের অনেকে হয়তো তারপরও ভাবতে পারে এই দ-াদেশ যে বহাল রয়েছে তার পেছনে মহামান্য আদালতের সুবিবেচনার সঙ্গে স্বদেশ রায়ের এই নিবন্ধটিরও কিছু ভূমিকা রয়েছে।
আতিকউল্লাহ খান মাসুদ এবং স্বদেশ রায় দু’জনকেই তাদের সাহসের জন্য ধন্যবাদ জানাই। অন্তত তারা যে তওবা সম্পাদক হননি এ জন্যে আমি গর্বিত। বাংলাদেশে তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া, জহুর হোসেন চৌধুরী, আবদুস সালাম ও কাজি মোহাম্মদ ইদ্রিসের ঐতিহ্যবাহী সাহসী সাংবাদিকতার ধারাটি আজ প্রায় অবলুপ্তির পথে। হাতেগোনা দু’চারজন সম্পাদক ও কলামিস্ট আছেন যারা এখনও সাংবাদিকতার গৌরব ও গর্বের ধারাটি ধরে রেখেছেন। যাদের মধ্যে আমার অনুজপ্রতীম স্বদেশ রায় একজন। তার নির্ভীকতাকে অভিনন্দন জানাই।
বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থার একেবারে নিম্ন পর্যায় থেকে সর্বোচ্চ পর্যায় পর্যন্ত সংস্কার ও আধুনিকায়ন প্রয়োজন। একটি প্রকৃত স্বাধীন বিচার ব্যবস্থা যেমন প্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন, তেমনি বিচার ব্যবস্থাকেও জবাবদিহিতার আওতায় আনা আবশ্যক। ক্ষমতা ও দম্ভের আইফেল টাওয়ারে অধিষ্ঠান হলে কোন বিচার ব্যবস্থাই সুষ্ঠু ও ন্যায় বিচারের নিশ্চয়তা বিধান করতে পারে না।
প্রাচীনকালে বাংলার সুলতান নাসিরুদ্দীনকে একবার তার প্রধান কাজি তার এজলাসে তলব করেছিলেন। অভিযুক্ত সুলতান কাজির কাছে হাজির হলেন এবং তার দেয়া দ-াদেশ মাথা পেতে নিলেন। এজলাসের কাজ শেষ হওয়ার পর সুলতান তার হাতের তলোয়ার কাজিকে দেখিয়ে বললেন, আপনি আজ ন্যায় বিচার করায় আমি খুশি। আপনি দেশের সুলতানকেও ভয় পাননি। ভয় পেয়ে অন্য রকম রায় দিলে এই তলোয়ার দিয়ে আপনার শিরñেদ করতাম। সঙ্গে সঙ্গে কাজি তার আসনের পেছনে লুকিয়ে রাখা একটা বেত্রদ- দেখিয়ে সুলতানকে বললেন, আপনি যদি আজ আমার দ-াদেশ মেনে না নিতেন, তাহলে এই বেত্রদ- দিয়ে আপনার পিঠে দশটি আঘাত করতাম।
সেকালে কাজির বিচারেও নির্ভীকতা ও নিরপেক্ষতা ছিল।
লন্ডন মঙ্গলবার, ২৫ আগস্ট, ২০১৫
শীর্ষ সংবাদ: