ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই;###;প্রতিটি হাসপাতালেই চিকিৎসার সুব্যবস্থা আছে;###;জুলাই থেকে অক্টোবর পর্যন্ত প্রকোপ থাকে

রাজধানীতে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বেড়েছে, ৩ দিনে শনাক্ত তিন শতাধিক

প্রকাশিত: ০৫:৪৯, ২৬ আগস্ট ২০১৫

রাজধানীতে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বেড়েছে, ৩ দিনে শনাক্ত তিন শতাধিক

নিখিল মানখিন ॥ রাজধানীতে গত তিন দিনে শনাক্ত হয়েছে তিন শতাধিক ডেঙ্গু রোগী। চলতি মাসে রেকর্ড সংখ্যক ৫২৬ জন ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়েছে। একদিনে গড়ে আক্রান্ত হয়েছে ২১ জন করে। এর মধ্যে গত ২২ থেকে ২৫ আগস্ট পর্যন্ত তিন দিনেই আক্রান্ত হয়েছে ৩২০ জন। গত দশ বছরেও এমন ঘটনা ঘটেনি বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। অথচ চলতি মাসে গত ২২ তারিখ পর্যন্ত রাজধানীতে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ২০৬ জন। ডেঙ্গু প্রতিরোধে ইতোমধ্যে বিশেষ সভা আহ্বান করে সংশ্লিষ্টদের প্রয়োজনীয় করণীয় সম্পর্কে নির্দেশনা দিয়েছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। রাজধানীর ডেঙ্গু নিয়ে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই এবং এ রোগে আক্রান্তের চিকিৎসার সুব্যবস্থা রয়েছে বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম। তবে তিন দিনে তিন শতাধিক ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হওয়ায় চিন্তামুক্ত থাকতে পারছে না নগরবাসী। সম্প্রতি সচিবালয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সম্মেলন কক্ষে ‘ডেঙ্গু প্রতিরোধে করণীয়’ শীর্ষক সভায় স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম বলেছেন, ডেঙ্গু প্রতিরোধে প্রস্তুত রয়েছে সরকার। দেশে বর্তমানে ডেঙ্গুর মৌসুম চলছে। প্রতিবছরই এ সময়ে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা একটু বেশি থাকে। প্রতিটি সরকারী হাসপাতালেই ডেঙ্গুর জীবাণু নির্ণয় ও চিকিৎসা ব্যবস্থা রয়েছে। তবে সকলকে এ বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে। এ বিষয়ে জনসচেতনতা বাড়াতে বিভিন্ন গণমাধ্যমকে কাজে লাগানোর জন্য সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী। আইইডিসিআর জানায়, রাজধানীতে জুলাই থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ডেঙ্গুর প্রকোপ বেশি হয়ে থাকে। মশক নিধন কার্যক্রমের স্থবিরতা, গাইডলাইনের অভাব এবং মানুষের অসচেতনতাই ডেঙ্গুর প্রকোপের জন্য দায়ী বলে মনে করছেন এ প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞানীরা। সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নির্ণয় ও রোগ গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) প্রতিবেদনে দেখা যায়, চলতি বছরে আগস্ট মাসের আগে গত মার্চে ২ জন, এপ্রিলে ২ জন, মে মাসে ১ জন, জুনে ১৫ জন এবং জুলাইয়ে ১৫৬ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়। সূত্রটি আরও জানায়, রাজধানীতে ২০১৩ সালের জানুয়ারিতে ৬ জন, ফেব্রুয়ারিতে ৭ জন, মার্চে ৩ জন, এপ্রিলে ৩ জন, মে মাসে ১২ জন, জুনে ৫০ জন, জুলাইয়ে ১৭২ জন, আগস্টে ৩৩৯ জন, সেপ্টেম্বরে ৩৮৫ জন এবং অক্টোবরে আক্রান্ত হয় ৫০১ জন। ২০১২ সালে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয় ১২ শ’ ৮৬ জন । আর গত ২০১১ সালে রেকর্ড সংখ্যক মানুষ ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত হয়। প্রতিবেদনে দেখা যায়, ওই বছর জুনে ৬১ জন, জুলাইয়ে ২৫৫ জন, আগস্টে ৬৯১ জন, সেপ্টেম্বরে ১৯৩ জন এবং অক্টোবরে আক্রান্ত হয় ১২০ জন। আর এভাবে গত ২০১০ সালে ২৫৭ জন, ২০০৯ সালে ৪৭১ জন, ২০০৮ সালে ১১ শ’ ৫১ জন এবং ২০০৭ সালে ৪৭১ জন ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত হয়। কিন্তু এ বছর জানুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত প্রায় ১ শ’ জন আক্রান্ত হয়েছে। এদিকে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা জানান, ডেঙ্গু রোগের বাহক এডিস মশা। এই মশার কামড়ে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়। এটি সহজে প্রতিরোধ করা সম্ভব। ডেঙ্গু প্রতিরোধে বাসার আশপাশের ঝোপ-জঙ্গল কেটে পরিষ্কার করে ফেলতে হবে বাসার টবে যেন পানি না জমে, সেদিকে লক্ষ্য রাখুন এবং টবের গোড়া পরিষ্কার রাখা দরকার। বাড়ির আশপাশে পরিত্যক্ত টায়ার, নারিকেলের খোসা, ভাঙা পাত্র বা অন্যান্য বস্তুÑ যেখানে পানি জমার আশঙ্কা আছে, তা পরিষ্কার করে ফেলতে হবে। বাসার রেফ্রিজারেটরের পেছনের পানির প্লেট পরিষ্কার করুন সব সময়Ñ যেন পানি জমে না থাকে। বাড়ির আশপাশের নালা-নর্দমা পরিষ্কার রাখতে হবে। প্রয়োজনে মশার ওষুধ ছিটানোর ব্যবস্থা করুন। দিনে ঘুমানোর প্রয়োজন হলে মশারি বা কয়েল ব্যবহার করুন। বাসার জানালা বা দরজায় সম্ভব হলে বাড়তি নেট লাগিয়ে নিন। এতে আর যাই হোক, মশার প্রকোশ থেকে কিছু হলেও রক্ষা পাওয়া সম্ভব। চিকিৎসা বিশেষজ্ঞরা জানান, প্রতিবছর জুলাই থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ডেঙ্গুর প্রকোপ থাকে। নগরীর সরকারী ও বেসরকারী হাসপাতাল-ক্লিনিকগুলোতে অনেক ডেঙ্গু রোগী চিকিৎসাধীন রয়েছে বলে জানা গেছে। সারাদেশের ডেঙ্গু আক্রান্ত ও মৃতের সঠিক সংখ্যা জানে না সরকার। কিন্তু হাসপাতাল-ক্লিনিক ছাড়াও চিকিৎসকদের ব্যক্তিগত চেম্বারে ডেঙ্গু রোগীর আগমন বেড়েছে। বিশেষজ্ঞরা অভিযোগ করেন, ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের বিশেষ মশক নিধন কার্যক্রম চালু নেই। পানি মেশানো ওষুধ ছিঁটানোর মাধ্যমেই নিজেদের দায়িত্ব সীমাবদ্ধ রাখছে ডিসিসি। মশক নিধন কার্যক্রমের বরাদ্দ নিয়ে লুটপাটের খেলা চলে। বাড়তি টাকা না দিলে কোন বাসা বা এলাকায় ওষুধ ছিঁটাই না ডিসিসির কর্মীরা। ডিসিসির এই বিভাগের সঙ্গে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ স্বাস্থ্য অধিদফতরের কোন যোগাযোগ থাকে না। ডিসিসির স্বাস্থ্য বিভাগের অধীনে এ কার্যক্রম চালিত হয়ে থাকে। স্বাভাবিক মশক নিধন কার্যক্রম ও ডেঙ্গু প্রতিরোধ কার্যক্রমের মধ্যে তারা কোন পার্থক্য দেখে না। ফলে এডিস মশা নিধনে তারা বিশেষ সফলতা পায় না। আর ডিসিসির অবহেলা ও দায়িত্বহীনতার দায়ভার গিয়ে পড়ে স্বাস্থ্য অধিদফতরের ওপর বলে অভিযোগ করেছেন অধিদফতরের কর্মকর্তারা। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা জানান, সময় জ্বর, পেটের ব্যথা ও অপারেশন দরকার এমন রোগীদের ক্ষেত্রে বিশেষভাবে সচেতন থাকতে হবে। এডিস মশার কামড় থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পারলে ডেঙ্গু হবে না। চিকিৎসার জন্য প্রথম থেকেই পরিমিত পানি (২৪ ঘণ্টায় ২Ñ৩ লিটার) এবং প্যারাসিটামল ছাড়া আর কোন ওষুধ লাগে না। প্লেটলেট এক লাখের কম হলে হেমোরেজিক ডেঙ্গু। হেমোরেজিক মারাত্মক হলেও, চিকিৎসা একই। জ্বর চলে যাওয়ার ৪৮ ঘণ্টা পর আর বিপদ থাকে না। বারবার প্লেটলেট পরীক্ষা করে কোন লাভ নেই, ভয় বাড়ানোর দরকার নেই। আট-দশ হাজার প্লেটলেট প্রায়ই পাওয়া যায় এবং কোন অতিরিক্ত চিকিৎসা লাগে না। ডেঙ্গু আক্রান্ত হলে হঠাৎ করে জ্বর ওঠে। কপালে, গায়ে ব্যথা লাগে। চোখে ব্যথা, চোখ নাড়ালে বা এদিক-ওদিক তাকালে ব্যথা অনুভূত হয়। দাঁতের মাড়ি দিয়ে রক্ত পড়ে। পায়খানার সঙ্গে রক্ত পড়তে পারে। পায়খানার সঙ্গে রক্ত অথবা কালো কিংবা লালচে-কালো রঙের পায়খানা, এমনকি প্রস্রাবের সঙ্গেও অনেক সময় রক্ত যেতে পারে। ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভার খুবই মারাত্মক। মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হতে পারে। বিশেষ পরীক্ষার পর প্রয়োজনীয় চিকিৎসার জন্য খুব দ্রুত হাসপাতালে নিতে হবে। রক্ত পরীক্ষায় যদি অণুচক্রিকা বা প্লেটলেটের সংখ্যা কমে যায়, তাহলে বুঝতে হবে, এটি হেমোরেজিক বা রক্তক্ষয়ী জ্বর। রোগীর অজ্ঞান হয়ে যাওয়া, অস্থিরতা, অবসন্নতা, পেটে তীব্র ব্যথা, হাত-পা ঠা-া হয়ে যাওয়া, ত্বক কুঁচকে যাওয়া, রক্তচাপ কমে যাওয়া কিংবা বেশি বেশি প্রস্রাব হওয়া ইত্যাদি লক্ষণ দেখা দেয়ামাত্র রোগীকে হাসপাতালে নিতে হবে। পুনরায় রক্ত পরীক্ষা করাতে হবে। প্রচুর তরল খাওয়াতে হবে। বিশুদ্ধ পানি প্রচুর পরিমাণে পান করাতে হবে। সেই সঙ্গে প্রস্রাবের পরিমাণ পর্যবেক্ষণ করতে হবে। সময়মতো সঠিক ব্যবস্থাপনায় ডেঙ্গু হেমোরেজিক জ্বরও সারিয়ে তোলা যায় বলে জানান বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন অনুষদের ডীন অধ্যাপক ডাঃ এবিএম আব্দুল্লাহ জনকণ্ঠকে জানান, নগরীতে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বেড়েছে। গত বছরের মতো এ বছরও হেমোরেজিক ডেঙ্গুতে আক্রান্তের সংখ্যাই বেশি দেখা যাচ্ছে। এ ধরনের ডেঙ্গুতে আক্রান্তরা নাক ও দাঁত দিয়ে এবং কাঁশির সময় রক্তক্ষরণে ভুগে থাকে। আর আক্রান্তরা পিঠ, ঘাড়, মাথা ও চোখের পেছনে ব্যথা অনুভূত হওয়ার কথা বলে থাকে। তিনি বলেন, ৪ থেকে ৫ দিনের মধ্যে জ্বর না কমলে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে। আর চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যাওয়ার আগে জ্বরের জন্য প্যারাসিটামল ছাড়া কোন ওষুধ দেয়া ঠিক হবে না। রোগীকে বেশি মাত্রায় পানি বিশেষ করে শরবত খাওয়ানো যেতে পারে। দিনের বেলায় ঘুমানোর সময়ও মশারি ব্যবহার করা উচিত। বাসায় খোলা পাত্রে পানি জমিয়ে রাখা যাবে না। এতে এডিস মশা ডিম পাড়ে। বাসায় সর্বত্র পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার জন্য তিনি পরামর্শ দেন ডাঃ এবিএম আব্দুল্লাহ।
×