শংকর কুমার দে ॥ বিজ্ঞানমনষ্ক লেখক ও ব্লগার অভিজিত, অনন্ত, ওয়াশিকুর ও নিলয় এই চার হত্যাকা-ের তদন্ত অন্ধকারে ঢাকা। অনুমাননির্ভর তদন্ত নিয়ে অথৈ সাগরে হাবুডুবু খাচ্ছে তদন্তকারীরা। হাতেনাতে ধরা পড়া খুনীদের জিজ্ঞাসাবাদ করেও সহযোগীদের শনাক্ত করে গ্রেফতার করতে পারছে না র্যাব ও ডিবি পুলিশ। কারণ একটাই, খুনীরা একজন আরেকজনকে চেনে না। জঙ্গী গোষ্ঠীগুলোর ‘সিøপার সেল’ এর ‘কাটআউট’ পদ্ধতিতে ব্লগার খুন করার কারণে খুনী চিহ্নিত করতে পারছে না তদন্তকারী সংস্থা র্যাব, ডিবি, গোয়েন্দা সংস্থা।
তদন্তকারী সংস্থাগুলোর তদন্তের বিষয়ে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, স্লিপার সেলের অচেনা ৮/১০ ব্লগারদের ওপর হামলা চালাচ্ছে বলে তাদের ধারণা। অচেনা এসব হামলাকারীর বিস্তারিত তথ্যও গোপন করা হয়। ফলে হামলার নির্দেশদাতারাও হামলাকারীদের সঠিকভাবে চেনে না। ব্লগার অভিজিত রায় ও অনন্ত বিজয় দাশ খুনের ঘটনায় র্যাবের হাতে গ্রেফতার হওয়া তিন জঙ্গী সদস্যের কাছ থেকে জিজ্ঞাসাবাদে এমনই তথ্য মিলেছে। গ্রেফতার হওয়া তৌহিদুর রহমান, সাদেক আলী ও আমিনুল মল্লিককে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ অভিজিত হত্যা মামলায় ৭ দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করছে। এই দুই ব্লগার হত্যায় অংশ নেয়া আরও চার সহযোগীকে ডিবি ও র্যাব খুঁজছে। কিন্তু যাদেরকে গ্রেফতার করা হচ্ছে এবং গ্রেফতারের জন্য খোঁজা হচ্ছে তারা ব্লগার হত্যাকা-ের সঙ্গে আদৌ জড়িত কিনা সে বিষয়ে নানা প্রশ্নের উত্তর এখনও মেলানো যাচ্ছে না।
মাত্র এক সপ্তাহ আগে গত ১৭ আগস্ট ধানম-ি ও নীলক্ষেত এলাকায় অভিযান চালিয়ে আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের (এবিটি) তিন সদস্যকে গ্রেফতার করে র্যাব। র্যাবের দাবি, তৌহিদ আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের অর্থের যোগানদাতা। অপর দুইজন সক্রিয় সদস্য। এদের মধ্যে সাদেক আলী ব্লগার অভিজিত রায়ের কিলিং মিশনে অংশ নিয়েছিল। সাদেক আলী আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের স্লিপার সেলের এক্সিকিউশন (বাস্তবায়ন) শাখার সক্রিয় সদস্য। যদিও অভিজিত রায়কে হত্যার ২/৩ ঘণ্টা আগে হত্যা করার নির্দেশ আসে সাদেক আলীর কাছে। সাদেক আলী মোবাইল ফোনের আটটি সিমকার্ড ব্যবহার করে। ঐ নির্দেশনা অনুযায়ী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মুহসিন হলের সামনের মাঠে সাদেক আলী, রমজান ওরফে সিয়াম, নাঈম, জুলহাস বিশ্বাস ও জাফরান আল হাসান মিলিত হয়। তবে ডিবির জিজ্ঞাসাবাদে সাদেক আলী তার অপর চার সহযোগীর নাম ভিন্ন নামে জানিয়েছে। তাদেরকে র্যাব ও ডিবি পুলিশ খুঁজছে। সাদেক আলীর অপর চার সহযোগী রাজধানীর বাইরে অবস্থান করে পরিকল্পনা অনুযায়ী কিলিং মিশনে অংশ নেয় বলে র্যাবের দাবি।
ব্লগার তদন্তের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট র্যাবের গোয়েন্দা শাখার একটি সূত্র জানান, অভিজিত রায় ও অনন্ত বিজয় দাশ কিলিং মিশনে অংশ নিয়েছিল আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের একই টিম। আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের অন্তত অর্ধশত স্লিপার সেল রয়েছে, যার একেকটি স্লিপার সেলের একটি করে এক্সিকিউশন শাখা রয়েছে। এই শাখায় একেবারে নতুন ও অচেনা সদস্য রিক্রুট করা হয়। কিলিং মিশনে অংশ নেয়ার আগ পর্যন্ত এক্সিকিউশন শাখার সদস্যরা একে অপরের কাছে অচেনা থাকে। এ হত্যা তাদের ওপর ‘ফরজ’ বলে নাযিল হয়েছে। বেহেশত পেতে তাদেরকে এ হত্যা করতে হবে। এ কারণে একজন সদস্য অপর সদস্যের ব্যাপারে বিস্তারিত কোন তথ্যই জানে না। স্লিপার সেলের প্রধান তাদেরকে নির্দিষ্ট ব্যক্তির ছবি দেখিয়ে দেয়। ঐ ব্যক্তির অবস্থান সম্পর্কে রেকি করা হয়। এরপর নির্দিষ্ট সময় চাপাতি বা ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। এক্সিকিউশন শাখার সদস্যরা রাজধানীসহ বিভিন্ন এলাকায় ছদ্মবেশে ঘুরে বেড়ায়। এদের কেউ মধু বিক্রেতা, কেউবা লেবুর সরবত বিক্রেতা আবার কেউবা ফল বিক্রেতা হিসেবে জীবিকা নির্বাহ করে। জীবিকা নির্বাহের আড়ালে তারা বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করার কাজ করে চূড়ান্ত প্রক্রিয়ায় নিয়োজিতদের কাছে সরবরাহ করে। তারপরই শুরু হয় ব্লগার হত্যাকাণ্ডের মহড়া ও সমাপ্তি।