ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

উচ্চমাত্রার সীসাযুক্ত ক্রুড অয়েল;###;যানবাহনের ইঞ্জিনের ক্ষতি ॥ পরিবেশ দূষণ

বাংলাপেট্রোল নামে বিক্রি

প্রকাশিত: ০৬:৫১, ২৬ আগস্ট ২০১৫

বাংলাপেট্রোল নামে বিক্রি

কৃষ্ণ ভৌমিক, পাবনা ॥ উত্তরাঞ্চলে প্রতিদিন প্রায় ২৫০ টন উচ্চমাত্রার সীসাযুক্ত ক্রুড অয়েল বাংলাপেট্রোল নামে অবাধে বিক্রি হচ্ছে। এতে যানবাহনের ইঞ্জিনসহ মূল্যবান যন্ত্রপাতির ব্যাপক ক্ষতিসহ পরিবেশের ভয়াবহ দূষণ ঘটছে। এদিকে সীসাযুক্ত বাংলাপেট্রোলের ব্যবসা করে প্রভাবশালী চক্র বছরে প্রায় ২৪০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। এই ব্যবসা নির্বিঘেœ চালাতে চক্রটি বিএসটিআই এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থাসহ বিভিন্ন মহলকে ম্যানেজ করতে প্রতিদিন ২০ লাখ টাকা উৎকোচ দিয়ে থাকে বলে অভিযোগ উঠেছে। বিপিসি ও জ্বালানি তেল ব্যবসায়ী সূত্রে জানা গেছে, ক্রুড অয়েল থেকে জ্বালানি তেল উৎপাদনের অনুমতি প্রাপ্ত পাঁচটি বেসরকারী রিফাইনারি কোম্পানি ভেজাল মেশানোর এ কাজটি করছে। আর এ সব ভেজাল জ্বালানি তেল বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনের (বিপিসি) অধীন তেল বিতরণ কোম্পানি পদ্মা, মেঘনা ও যমুনা কোম্পানির চোখ এড়িয়ে তেল পাম্প ও ডিলারদের কাছে পৌঁছে যাচ্ছে। সূত্র মতে, হরিপুর, কৈলাশটিলা, রশিদপুর ও বিয়ানীবাজার গ্যাস ফিল্ড থেকে গ্যাস উত্তোলনের সময় গ্যাসের সঙ্গে উচ্চমাত্রার সীসাযুক্ত ক্রুড অয়েল (গ্যাসের সহজাত) বেরিয়ে আসে। রিগ মেশিনে গ্যাস ও ক্রুড অয়েল আলাদা হয়ে যায়। পরে উত্তোলিত ক্রুড অয়েল রিফাইনারিতে পরিশোধনের জন্য পাঠানো হয়। গ্যাস ফিল্ডগুলোতে উত্তোলিত ক্রুড অয়েলের সঠিক হিসাব নেই। এ সুযোগে গ্যাস ফিল্ডের এক শ্রেণীর অসাধু কর্মকর্তা গোপনে উচ্চমাত্রার সীসাযুক্ত ক্রুড অয়েল জ্বালানি তেল ভেজালকারীদের কাছে বিক্রি করছে। আর ভেজালকারীর বাংলাপেট্রোল নামে ক্রুড অয়েল বিক্রি করছে। জানা গেছে, অকটেন, পেট্রোল, ডিজেল ও কেরোসিনে ক্রুড অয়েল মেশানোর উদ্দেশ্য হচ্ছে বেশি মুনাফা করা। এক লিটার ক্রুড অয়েলের দাম ৫০.৫০ টাকা। আর এক লিটার অকটেনের দাম ৯৬.০১ টাকা, পেট্রোল ৯২.১৫ টাকা, ডিজেল ৬৫.৮১ টাকা ও কেরোসিনের দাম ৬৬.৬১ টাকা। অধিক মুনাফার লোভেই জ্বালানি তেলে ক্রুড অয়েল মেশানো হচ্ছে। যমুনা সেতুতে চেকপোস্ট বসালে পাচার হয়ে আসা ক্রুড অয়েল হাতেনাতে ধরা যাবে বলে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনের (বিপিসি) দায়িত্বশীল সূত্র জানিয়েছে। জানা যায়, বাংলাদেশের গ্যাসক্ষেত্র থেকে গ্যাসের সহজাত হিসেবে ক্রুড অয়েল উৎপন্ন হয়। পরে গ্যাসের এই উপজাত পরিশোধন করে অকটেন, পেট্রোল, ডিজেল ও কেরোসিন প্রভৃতি পেট্রোলিয়াম পণ্য উৎপাদন করা হয়। ক্রুড অয়েল থেকে পেট্রোলিয়াম পণ্য উৎপাদনের জন্য সরকারী প্রতিষ্ঠান রূপান্তরিত প্রাকৃতিক গ্যাস কোম্পানি লিমিটেড (আরপিসিজিএল) রয়েছে। এর বাইরে সরকার পাঁচটি কোম্পানিকে ক্রুড অয়েল রুপান্তরের দায়িত্ব দিয়েছে। এ সব বেসরকারী কোম্পানি ক্রুড অয়েল থেকে অক্টেন, পেট্রোল, ডিজেল, কেরোসিনসহ বিভিন্ন পেট্রোলিয়াম পণ্য উৎপাদন করে। অক্টেন, পেট্রোল, ডিজেল ও কেরোসিন খোলাবাজারে বিক্রির কোন বিধান নেই। বেসরকারী রিফাইনারি কোম্পানিগুলো পরিশোধিত জ্বালানি তেল বিপিসির পদ্মা, মেঘনা ও যমুনা এই তিনটি কোম্পানির কাছে বিক্রি করবে। ক্রুড অয়েলের রং হুবহু পানির মতো। গ্যাসের এই উপজাত অকটেন, পেট্রোল, ডিজেল ও কেরোসিনের সঙ্গে মেশালে বোঝার উপায় নেই যে সেটি ভেজাল। বেশি মুনাফার আশায় বেসরকারী তেল রিফাইনারি কোম্পানি ও গ্যাস ফিল্ডে কতিপয় অসাধু কর্মকর্তা একটি প্রভাবশালী চক্রের যোগসাজসে উচ্চমাত্রায় সীসাযুক্ত ক্রুড অয়েল সরাসরি জ্বালানি তেলে মেশাচ্ছে। সেই ভেজাল জ্বালানি তেল দেশের বিভিন্ন স্থানে পেট্রোল পাম্প ও ডিলারদের কাছে গোপনে বিক্রি করছে। যমুনা সেতু হয়ে প্রতিরাতে ৬০ থেকে ৭০ লরি (প্রতি লরির ধারণ ক্ষমতা নয় হাজার থেকে সাড়ে ১৩ হাজার লিটার) উচ্চমাত্রার সীসাযুক্ত ক্রুড অয়েল উত্তরাঞ্চলে ঢুকছে। পরে এই ক্রুড অয়েল বাংলাপেট্রোল নামে এ অঞ্চলের বিভিন্ন জেলায় তেল পাম্প, ডিলার এবং খুচরা দোকানদারদের কাছে গোপনে বিক্রি করা হচ্ছে। এছাড়া গ্যাসচালিত বিদ্যুত কেন্দ্রের কমপ্রেসারের সাহায্যে গ্যাস সরবরাহ করা হয়। কমপ্রেসারের চাপে গ্যাসের গাদ ট্যাংকিতে জমা হয়। সেই গাদ প্রতি লিটার ২২ টাকা দরে বিক্রি হয়। আর অসাধু ব্যবসায়ীরা ২২ টাকা লিটারের গাদ পেট্রোলে মিশিয়ে ৯২.১৫ টাকা দরে বিক্রি করছে বলে বিপিসির ডিলার ও এজেন্ট সূত্রে জানা গেছে। এদিকে বিপিসির উত্তরাঞ্চলের বাঘাবাড়ী, পারবর্তীপুর, রংপুর, রাজশাহী ও হরিয়ানা অয়েল ডিপোর পদ্মা, মেঘনা ও যমুনা কোম্পানি থেকে উত্তরাঞ্চলে পাবনা, সিরাজগঞ্জ, বগুড়া, নওগাঁ, গাইবান্ধা, রংপুর, কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, নীলফামারী, পঞ্চগড়, জয়পুরহাট, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, দিনাজপুর ও নাটোর জেলায় প্রতিদিন প্রায় ২২ লাখ লিটার জ্বালানি তেল সরবরাহ করা হয়। এ অঞ্চলে ক্রুড অয়েল পাচার হয়ে আসায় এই পাঁচটি ডিপোতে জ্বালানি তেল বিক্রি কমে গেছে। এতে বিপিসি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে। বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনের (বিপিসি) চেয়ারম্যান এএসএম বদরুদ্দোজা জানিয়েছেন, কিছু কিছু বেসরকারী কোম্পানি জ্বালানি তেলে ক্রুড অয়েল মিশিয়ে বাংলাপেট্রোল নামে গোপনে বিক্রি করছে। বিপিসি যখন বেসরকারী কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে তেল নেয়, তখন সেই তেলের মান পরীক্ষা করে নেয়া হয়। জ্বালানি তেলে ভেজাল মেশানো মারাত্মক অপরাধ বলে তিনি জানান।
×