ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

বায়ান্ন বাজার তিপ্পান্ন গলি

প্রকাশিত: ০৫:৫০, ২৮ আগস্ট ২০১৫

বায়ান্ন বাজার তিপ্পান্ন গলি

মোরসালিন মিজান ॥ বাঙালীর প্রাণের কবি নজরুল। চির বিদ্রোহী কবি, একই সঙ্গে প্রেমের। সাম্যের। অসাম্প্রদায়িক চেতনা ও বিশ্বাসের কথা বললে নজরুল অনন্য সাধারণ উচ্চতায় অবস্থান করেন। ঝাঁকড়া চুলের বাবরি দোলানো মহান পুরুষের ৩৯তম প্রয়াণ দিবস ছিল বৃহস্পতিবার। কিন্তু হায়! ধ্রুবতারা হয়ে বাঙালীকে পথ দেখিয়ে চলা কবিকে বিশেষভাবে সংশ্লিষ্টরাও বেমালুম ভুলে ছিলেন! এ দিন কোথাও তেমন কবিকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। সকালে কবির সমাধিতে ফুল দেয়ার যেটুকু আনুষ্ঠানিকতা হয়েছে; এর বাইরে একটিমাত্র আয়োজন ছিল শিল্পকলা একাডেমিতে। বাকি সবাই একরকম হাত গুটিয়ে বসেছিলেন। নজরুল সঙ্গীতের শিল্পীরা সংগঠকরা মুখে ভারি মেকাপ নিয়ে টেলিভিশন স্ক্রিনে ছিলেন। রেকর্ডিং করে কাটিয়েছেন। লাইভ হয়েছে। শিল্পীদের বড় বড় ছবিসহ ইন্টারভিউ ছাপা হয়েছে পত্রিকায়। কিন্তু বিশেষ দিবসে কোথাও কোন অনুষ্ঠান নেই। আয়োজন নেই। একাধিক নজরুল সঙ্গীত শিল্পীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, কয়েক দিন পর ভিন্ন ভিন্ন দিনে নজরুলকে উৎসর্গ করে অনুষ্ঠানের আয়োজন করবেন তারা। কেন? তাহলে বিশেষ দিবসের কেন প্রয়োজন? এসব প্রশ্ন কয়েকজন নজরুল সঙ্গীত শিল্পী ও সংগঠককে করা হয়েছিল। উত্তর তারা তাদের মতো করেই দিলেন। আর তা থেকে একটি বিষয় পরিষ্কারÑ টেলিভিশনে প্রচার পাওয়ার মোহ তাদের পেয়ে বসেছে। এদিন টেলিভিশন রেডিও পত্রিকা নিয়ে ব্যস্ত থাকতে ভালবাসেন তারা। তাছাড়া একই দিন একাধিক অনুষ্ঠান থাকলে নাকি প্রচার কম পাওয়া যায়। সব মিলিয়ে নজরুলকে ভুলে থাকা। ভাবা যায়! এবার নজরুলের ম্যুরাল প্রসঙ্গ। কাজী নজরুল ইসলাম এ্যাভিনিউয়ের দুই প্রান্তে রয়েছে কবির দুটি স্মৃতিফলক। নজরুল জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে শাহবাগ ও কাওরানবাজারে স্মৃতিফলক দুটি নির্মাণ করা হয়। প্রতিদিনের আসা যাওয়ার পথে কবির চমৎকার দুটি ম্যুরাল। উদ্যোগটি দারুণ প্রশংসিত হয়েছিল। তবে এখন যথারীতি উল্টো চিত্র। নজরুলকে অমর্যাদা করার বড় উপলক্ষ হয়ে উঠেছে তাঁরই স্মৃতিফলক! শাহবাগ মোড়ে স্থাপিত নজরুলের স্মৃতিফলকটি যেন ময়লাÑআবর্জনার ভাগাড়। এর দুই পাশের ফুটপাথ দখল করে দোকান বসানো হয়েছে। মূল অবকাঠামোর সঙ্গে বাঁশ বেঁধে টানানো হচ্ছে শামিয়ানা। এর নিচে চুলো জ্বলছে। চা হচ্ছে। সঙ্গে বিড়ি সিগারেট; পান। রশিতে ঝুলিয়ে রাখা হচ্ছে কলা পাউরুটি। ভবঘুরে পথচারী রিক্সাওয়ালারা এখানে আড্ডা জমাচ্ছে। চায়ের কাপধোয়া পানি, কলার বাকল, সিগারেটের অবশিষ্টাংশ ফেলা হচ্ছে স্মৃতিফলকের পেছনের অংশে। এখানে মশা উড়ছে। মাছি ভনভন করছে। ফলকের গায়ে পানের পিক ফেলতে পর্যন্ত দুইবার ভাবছেন না কেউ কেউ। দোকানগুলোর সামনে রিক্সা দাঁড় করিয়ে রাখা হয় সব সময়। আছে বিজ্ঞাপনের বাহার। জাতীয় কবির মুখ ঢাকা পড়েছে কর্পোরেট হাউসগুলোর বিজ্ঞাপনে। ম্যুরালের দুই পাশে সারাবছর বিশাল বিশাল বিলবোর্ড টানানো থাকে। ওসবে বিচিত্র অঙ্গভঙ্গির মডেল। অনেকদূর থেকেও তাদের রঙচঙে মুখ খুব চোখে পড়ে। আর আড়ালে পড়ে থাকেন নজরুল! আসা যাক কাওরানবাজারে। একটু খেয়াল করুন, একই চিত্র। কাওরানবাজারের স্মৃতিফলকটি কয়েক দফা ভাঙ্গাগড়ার মুখে পড়েছে। জায়গা পরিবর্তন করে কখনও সামনে, কখনওবা পেছনে নেয়া হয়েছে। শুরুতে শাহবাগ এবং কাওরানবাজারের স্মৃতিফলক দুটি দেখতে অভিন্ন ছিল। সেখানে ছন্দপতন ঘটানো হয়েছে। এখন নতুন নক্সায় দাঁড় করানো নজরুল। পাঠ্য বইয়ে পড়া দুখু মিয়া নেই আর। নতুন স্পন্সর কোম্পানির নিজেদের মতো করে গড়া ম্যুরাল। ম্যুরালের গায়ে যথারীতি পোস্টার সাঁটা। পোস্টার টেনে তোলার বিচ্ছিরি দাগ। দ্রুত ইংরেজী শেখানোর বিজ্ঞাপন। আরও কত কী! না, কেউ দেখার নেই। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, শাহবাগের স্মৃতিফলকটির দেখাশোনার ভার ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের। তবে সে দায়িত্ব পালন করার কোন কারণ খুঁজে পাচ্ছেন না কর্তাব্যক্তিরা। একইরকম উদাসীন ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন। এ কারণে নজরুলের কাওরানবাজারের স্মৃতিফলকটির দৈন্যদশা। এ অবস্থায় নজরুলপ্রেমীরা মর্মাহত। তাদের প্রশ্নÑ তাহলে কী দরকার ছিল ম্যুরালের? নজরুলকে শ্রদ্ধা নাইবা করলাম; অশ্রদ্ধা করার অধিকার তো নেই কারও। আগস্ট প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। তবে এখনও রাজধানীজুড়ে শোক। ১৫ আগস্টের বেদনার কথা নানাভাবে প্রকাশিত হচ্ছে। মাসের প্রথম দিকে শুরু হওয়া অনেক কর্মসূচী এখনও চলমান আছে। নতুন করে শুরু হয়েছে বেশকিছু আয়োজন। গত ২৩ আগস্ট শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় চিত্রশালায় উদ্বোধন করা হয় শিল্পী কিরীটি রঞ্জন বিশ্বাসের একক চিত্রকর্ম প্রদর্শনী। শিরোনামÑ চিত্রপটে বঙ্গবন্ধু। নয় দিনব্যাপী আয়োজনে স্থান পেয়েছে ৪৪টি ছবি। অধিকাংশ কাজ তেলরঙে করা। বাঙালীর অবিসংবাদিত নেতার প্রতিকৃতি এঁকেছেন শিল্পী। নানাভাবে ব্যঞ্জনায় ফুটিয়ে তুলেছেন জাতির পিতাকে। প্রদর্শনী প্রতিদিন বেলা ১১টা থেকে রাত ৮টা সকলের জন্য উন্মুক্ত থাকছে। শুক্রবার চলছে বেলা ৩টা থেকে রাত আটটা পর্যন্ত। প্রতিবছর আগস্টে জাতির জনককে নিয়ে বিশেষ শিল্পকর্ম প্রদর্শনীর আয়োজন করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের শিক্ষার্থীরা। এবারের আয়োজনটি শুরু হয়েছে বুধবার থেকে। জয়নুল গ্যালারিতে বিকেলে এর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা হয়। এখানে অপেক্ষাকৃত নবীন শিল্পী। চারুকলার পাঠ এখনও চুকেনি। তবে কাজগুলো দেখে মুগ্ধ হতে হয়। নানা ধরনের নীরিক্ষার মধ্য দিয়ে গিয়েছেন শিক্ষার্থীরা। বিচিত্র মাধ্যমে তুলে ধরা বঙ্গবন্ধুকে দেখে সত্যি মনে হয় অভিজ্ঞদের কাজ। এখানেও প্রতিদিন আসছেন শিল্পপ্রেমীরা। ঘুরে ঘুরে তারা দেখছেন প্রিয় নেতার মুখ।
×