ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

পাইকারি ও খুচরা পর্যায়ে দাম উর্ধমুখী

৬ জাহাজ ভর্তি চিনি খালাসের পর শুল্ক বৃদ্ধি কাদের স্বার্থে?

প্রকাশিত: ০৭:০৭, ২৮ আগস্ট ২০১৫

৬ জাহাজ ভর্তি চিনি খালাসের পর শুল্ক বৃদ্ধি কাদের স্বার্থে?

মোয়াজ্জেমুল হক, চট্টগ্রাম অফিস ॥ ভোগ্যপণ্যের বাজারে পেঁয়াজ নিয়ে মূল্যের অস্থিরতা এখনও কাটেনি। চিনির বাজার দর ছিল সহনীয় পর্যায়ে এবং স্থিতিশীল। এ অবস্থায় আকস্মিকভাবে পরিশোধিত এবং অপরিশোধিত চিনি আমদানিতে শুল্ক বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত এবং তা কার্যকর করার ঘটনাটি কাদের স্বার্থে হয়েছে, তা নিয়ে ব্যবসায়ী মহলে বড় ধরনের জিজ্ঞাসার সৃষ্টি করেছে। এ ঘটনা চিনির বাজার মূল্যকে উর্ধমুখী করতে শুরু করেছে। অভিযোগ উঠেছে, একটি স্বার্থান্বেষী মহলের ইশারায় এ ঘটনার অবতারণা হয়েছে, যা ভোগ্যপণ্যের বাজারে পেঁয়াজের অস্থিতিশীলতার সঙ্গে চিনির উর্ধমূল্য নতুন মাত্রা যোগ করেছে। অনুসন্ধানে জানা গেছে, চলতি মাসের শুরুর দিকে বেসরকারী পর্যায়ে ৬ জাহাজ ভর্তি প্রায় আড়াই লাখ টন অপরিশোধিত চিনি দেশে আমদানি হয়ে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে খালাস হয়েছে। এরপর হঠাৎ করে চিনির আমদানি শুল্কমূল্য বৃদ্ধির ঘটনাটি সঙ্গত কারণেই ব্যবসায়ী মহলে বিভিন্ন প্রশ্নের উদ্রেক করেছে। যারা এত বিপুল পরিমাণ চিনি আমদানি করে নিয়ে এসেছে তারা নিশ্চয়ই শুল্ক বৃদ্ধির আগে প্রদত্ত শুল্ক অনুযায়ী চিনি বিক্রি করবে না। শুল্ক বৃদ্ধির সুযোগটি তারা নিশ্চয় গ্রহণ করতে তৎপর থাকবেন। গত বুধবার জাতীয় রাজস্ব বোর্ড পরিশোধিত ও অপরিশোধিত চিনি আমদানিতে ৫ শতাংশ হারে বাড়তি শুল্ক আরোপ করার সিদ্ধান্ত প্রদানের আগেই তা ফাঁস হয়ে যাওয়ায় গত সোম ও মঙ্গলবার থেকে চিনির বাজারমূল্য উর্ধমুখী হয়। বুধবার তা আরেক দফা বৃদ্ধি ঘটে। বৃহস্পতিবারও তা একই অবস্থায় রয়ে যায়। ভোগ্যপণ্যের দেশের এক বৃহত্তম পাইকারি বাজার খাতুনগঞ্জের ব্যবসায়ী সূত্রে জানানো হয়েছে, গত রমজানের আগে থেকে চিনির বাজারমূল্য সহনীয় পর্যায়ে চলে আসে। এর মূল কারণ ছিল আন্তর্জাতিক বাজারে চিনির ব্যাপক দর পতন। সে হিসেবে খুচরা পর্যায়ে চিনির দাম নেমে আসে কেজিপ্রতি ৩২ থেকে ৩৩ টাকায়। শুল্ক বৃদ্ধির ঘোষণা আসছে এমন তথ্য আগেভাগে ফাঁস হয়ে যাওয়ায় তা সঙ্গে সঙ্গে পাইকারি বাজারে আঘাত হানে। এতে চিনির বাজারমূল্যে উত্তাপ সৃষ্টি হয়। ফলে কেজিপ্রতি কোথাও ৭ থেকে ৮ টাকা, আবার কোথাও ৯ টাকা পর্যন্ত বৃদ্ধি হয়ে ৪০ টাকা ও এর ওপরে উন্নীত হয়েছে। বাজার সূত্র জানায়, খাতুনগঞ্জে গত সোম ও মঙ্গলবার মণপ্রতি ১১৭০ টাকার চিনি বর্তমানে ১২৫০ টাকা পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে। টনপ্রতি বেড়েছে ২১৫০ থেকে ২১৬০ টাকা। পাইকারি বাজারে মূল্য বৃদ্ধির এ ঘটনা দ্রুত খুচরা পর্যায়ে নাড়া দিয়েছে। অনুসন্ধানে জানা গেছে, দেশে চিনির বার্ষিক চাহিদা রয়েছে সর্বোচ্চ ১৬ লাখ টন। এর মধ্যে দেশে উৎপাদিত হয় সর্বোচ্চ ৯০ থেকে ১ লাখ টন। চাহিদার বাকি পুরো অংশটি আমদানির মাধ্যমেই মিটানো হয়। এক্ষেত্রে দেশে স্থাপিত ৫টি সুগার মিল উক্ত পরিমাণ অপরিশোধিত চিনি এনে তা পরিশোধনের মাধ্যমে বাজারজাত করে থাকে। অভিযোগ উঠেছে এ সুগার মিলগুলো সিন্ডিকেট করে সরকারের উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে আঁতাত করে শুল্ক বৃদ্ধির ঘটনাটি ঘটিয়েছে নিজেদের অধিক মুনাফা হাতানোর লক্ষ্যে। এ ঘটনা না হলে চলতি মাসের প্রথমার্ধে একযোগে এত বিপুল পরিমাণ চিনি আমদানি হয়ে আসার ঘটনা অতীতে কখনও ঘটেনি। ফলে ব্যবসায়ীরা এ ঘটনাকে পরিকল্পিতভাবে হয়েছে বলে নিশ্চিত হয়েছে। অপরিশোধিত ও পরিশোধিত চিনি আমদানিতে শুল্ক বৃদ্ধি প্রসঙ্গে চিনি ও খাদ্য কর্পোরেশন এবং রাজস্ব বোর্ড যে ব্যাখ্যা দিয়েছে তা বাস্তবতার সঙ্গে সঙ্গতি নেই। শুল্ক বৃদ্ধির মাধ্যমে আখচাষীদের লোকসান থেকে বাঁচাতে এবং রাজস্ব আয় বৃদ্ধির জন্য এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে বলে জানানো হলেও তা আদৌ সত্য বলে মেনে নিতে নারাজ পাইকারি ও খুচরা পর্যায়ের চিনি ব্যবসায়ীরা। জানা গেছে, বর্তমানে সরকারের হাতে চিনি মজুদের পরিমাণ সর্বোচ্চ ১ লাখ ৪০ হাজার টন। আগামী সেপ্টেম্বর মাসে শুরু হবে আখ মাড়াই মৌসুম। এরপর কাঁচামাল মিলে পৌঁছার পর তা থেকে চিনি উৎপাদন হয়ে বাজারে আসবে। এক্ষেত্রে চাষীদের কথা উল্লেখ করে সরকারী পর্যায়ে চিনি আমদানিতে শুল্ক বৃদ্ধির ঘটনা ঘটেছে বলে দাবি করা হয়েছে। আর এর পাশাপাশি এনবিআর বলেছে, তাদের বাড়তি রাজস্ব প্রাপ্তির কথা। কিন্তু ঘটনার নেপথ্য কাহিনী পরিবেশ পরিস্থিতি পর্যালোচনা তা বলে না। যে ৬ জাহাজ বোঝাই হয়ে প্রায় আড়াই লাখ টন চিনি যারা এনেছেন তারা তো পুরনো মূল্যে চিনি বিক্রি করবে না। শুল্ক বৃদ্ধির সুযোগটি নিয়েই তারা মূল্য বাড়িয়ে বিক্রি করবে। চিনির বাজার নিয়ন্ত্রিত হয় ডিও’র (ডেলিভারি অর্ডার) মাধ্যমে। পাইকারি ব্যবসায়ীরা ডিও’র মাধ্যমে বেসরকারী সুগার মিলের কাছ থেকে চিনি ক্রয় করে থাকে এবং তা মণে এবং কখনও টনে। এক্ষেত্রে চিনির মিল মালিকরা অপরিশোধিত চিনি পরিশোধন করার আগেও ডিও বিক্রি করে নগদ টাকা বাজার থেকে উঠিয়ে নেয়। এ ধরনের ডিও পরবর্তীতে কয়েক দফায় হাত বদল হয়ে ডেলিভারি পর্যায়ে যায়। আর তখন চিনির প্রকৃত মূল্য প্রকৃত অবস্থায় থাকে না। মাঝপথে হাত বদলকারীরা তাদের মুনাফা রেখেই তা বাজারে ছাড়ে। দেশে এ পর্যন্ত ৫টি সুগার মিল প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর বিদেশ থেকে পরিশোধিত চিনি আমদানি বলা চলে শূন্যের কোটায় চলে গেছে। টনে টনে আনা হচ্ছে অপরিশোধিত চিনি। আর এ ধরনের চিনি আনা হচ্ছে মূলত ব্রাজিল ও আফ্রিকা থেকে। এনবিআরের পক্ষ থেকে চিনি আমদানিতে অপরিশোধিত ও পরিশোধিত চিনি আমদানিতে শুল্ক বৃদ্ধি করা হয়েছে। ঘোষণা অনুযায়ী এতে অপরিশোধিত ও পরিশোধিত প্রতিটন চিনি আমদানিতে বাড়তি শুল্ক দিতে হবে টনপ্রতি ৭ ও ১০ হাজার টাকা হারে। এ অবস্থায় অপরিশোধিত চিনির ক্ষেত্রে টনপ্রতি শুল্ক বেড়েছে ৫ হাজার টাকা। আর পরিশোধিত চিনির ক্ষেত্রে বেড়েছে ১০ হাজার টাকা। গত বুধবার থেকে চিনি আমদানিতে নতুন শুল্কহার কার্যকর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে চিনির পাইকারি ও খুচরা বাজারে তা আঘাত করেছে। প্রশ্ন উঠেছে, মাত্র ৮ শতাংশ চিনি উৎপাদনকারী সরকারী চিনি কলগুলোর লোকসান কমাতে এবং চাষীদের মুনাফা নিশ্চিত করতে ৯২ শতাংশ আমদানি চিনির ওপর শুল্ক বৃদ্ধির বিষয়টি কতটুকু যৌক্তিক। সরকারী চিনি কল এবং চাষীদের ভিন্নভাবে ছাড় দিয়ে তাদের লোকসান থেকে রক্ষা করার পথ বেছে না নিয়ে ৯২ শতাংশ আমাদনি চিনির ওপর বাড়তি শুল্ক আরোপ করে বাজারকে অস্থিতিশীল করার সিদ্ধান্ত নিয়ে কাদের স্বার্থ সুরক্ষিত হচ্ছে, তা বড় ধরনের প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। দীর্ঘদিন ধরেই অপরিশোধিত চিনি আমদানিতে শুল্কহার ছিল টনপ্রতি ২ হাজার টাকা। আর পরিশোধিত চিনির ক্ষেত্রে ছিল টনপ্রতি ৪ হাজার টাকা, যা এখন ৭ ও ১০ হাজার টাকায় উন্নীত হয়েছে। আমদানিমূল্যের সঙ্গে বাড়তি শুল্ক যুক্ত হওয়ায় স্বাভাবিকভাবে মিল কর্তৃপক্ষ চিনির মূল্য বাড়াবে। কিন্তু তার আগেই পাইকারি বাজারে চিনির মূল্য বাড়া শুরু হয়ে গেছে। বেসরকারী আমদানির চিনি আগে বিক্রি হতো কেজিপ্রতি ৩২ থেকে ৩৩ টাকায়। আর সরকারী কলগুলোতে উৎপাদিত চিনি বিক্রি হয়ে আসছে কেজিপ্রতি ৩৭ টাকায়। নতুন সিদ্ধান্তের কারণে সরকারী মিলগুলো লোকসানের কবল থেকে রক্ষা পাবে। আর চাষীরাও মুনাফা লাভ করবে। সরকারী পর্যায়ে এমন চিন্তা থেকে এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে প্রচার করলেও বাস্তবতা রয়েছে ভিন্ন। ব্যবসায়ীদের বিভিন্ন সূত্রে বলা হয়েছে, চিনির আন্তর্জাতিক বাজার দর দু’বছর আগে যেখানে ছিল টনপ্রতি ৫শ’ ডলার, বর্তমানে তা ২৮০ ডলার পর্যন্ত হ্রাস পেয়েছে। চিনির আন্তর্জাতিক বাজারমূল্য এত কম হওয়ার ঘটনা সাম্প্রতিক সময়ের রেকর্ড। আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্য হ্রাস পাওয়ার কারণেই দেশের বাজারে চিনির দর কমেছে, অর্থাৎ তা সহনীয় পর্যায়ে রয়েছে। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতসহ বিভিন্ন দেশে চিনি উৎপাদন হয়ে যেখানে রফতানির তালিকায় রয়েছে সেক্ষেত্রে দেশে সরকারী চিনিকল ও চাষীদের মুনাফার কারণ দেখিয়ে আমদানি পর্যায়ে বাড়তি শুল্ক আরোপ দেশের বিশাল ভোক্তা শ্রেণীকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে নিঃসন্দেহে- পাইকারি ও খুচরা পর্যায়ের ব্যবসায়ীদের বিভিন্ন সূত্রে এ অভিমত রয়েছে।
×