ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

সৎ ব্যবসায়ীরা এলসি খুলে প্রতারিত হচ্ছেন ;###;এভাবে বিদেশে অর্থও পাচার হচ্ছে

পণ্য আমদানিতে ভয়ঙ্কর জালিয়াতি ॥ তেলের নামে কোকেন

প্রকাশিত: ০৫:৩২, ২৯ আগস্ট ২০১৫

পণ্য আমদানিতে ভয়ঙ্কর জালিয়াতি ॥ তেলের নামে কোকেন

রহিম শেখ ॥ ঋণের বিপরীতে শিল্পের যন্ত্রপাতি ও কাঁচামাল আমদানিতে এলসি খোলা হয়েছে। কিন্তু শিল্পের পণ্য আসেনি। এ সবের বদলে কন্টেনারে এসেছে ছাই, ইট, বালি, পাথর ও সিমেন্টের ব্লক। কখনও ফেব্রিক্সের বদলে এসেছে দামী ওষুধ। আবার কখনও শূন্য কনটেনার। তবে সবচেয়ে আলোচিত আমদানি পণ্যের ঘটনাটি ঘটেছে গত মে মাসে। সূর্যমুখী তেল আমদানির ঘোষণায় আনা কনটেনারটির একটি ড্রামে পাওয়া যায় তরল ‘কোকেন’। পণ্য আমদানিতে বড় ধরনের রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে চলছে রীতিমতো নয়ছয়। এ যেন মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে পণ্য আমদানি নিয়ম হয়ে গেছে। এলসি জালিয়াতির সঙ্গে নতুন করে জড়িত হচ্ছে নতুন নতুন খাত। এর মধ্যে ভোগ্যপণ্য, খাদ্য ছাড়াও ব্যাক টু ব্যাক এলসির সঙ্গে জড়িত গার্মেন্ট, জাহাজভাঙ্গা শিল্প প্রতিষ্ঠান। পরিসংখ্যান বলছে, গত এক বছরে যে পরিমাণে মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি হয়েছে সে অনুযায়ী শিল্প-কারখানাও গড়ে ওঠেনি। ফলে বিদেশে অর্থ পাচারের মতো ঘটনা ঘটছে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন। এদিকে পণ্য আমদানির দেনা শোধে প্রতারণার ঘটনা যেমন বাড়ছে, তেমনি অনেক সৎ ব্যবসায়ী সরাসরি এলসি খুলে প্রতারিত হচ্ছেন। ২৪০ কেজি ওজনের সাতটি কার্টন। ভেতরে থাকার কথা ফেব্রিক্স। সন্দেহ হলো শুল্ক গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের। আটকের পর খুলে পাওয়া গেল দুই কোটি টাকার ওষুধ। এই ওষুধগুলো আমদানির জন্য কোন অনুমতি নেয়া হয়নি। মানসম্মত কি-না তাও পরীক্ষা করা হয়নি। সব নিয়ম মেনে বৈধভাবে আমদানি করা হলে এগুলোর জন্য শুল্ক দিতে হতো প্রায় ২৫ লাখ টাকা। তবে ফেব্রিক্স ঘোষণা দিয়ে আনা এই পণ্য ছাড়ের জন্য শুল্ক দেয়া হয়েছে মাত্র ১০৫ টাকা। ছাড়ের কাগজপত্রে দেখা যায়, ঢাকা কাস্টম হাউসের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা পণ্য পরীক্ষা করে তা ‘ফেব্রিক্স’ নিশ্চিত করে সই করেছেন। এই ঘটনাটি ঘটে চলতি বছরের ১৯ মে। এর আগে ১০ মে রাতে বিমানবন্দরের রফতানি কার্গো শাখায় সবজির কার্টন থেকে এক কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা জব্দ করে কাস্টমস। এর পরদিন ১১ মে এয়ার ফ্রেইট শাখা থেকে দুই কোটি টাকার ওষুধের একটি চালান আটক করেন শুল্ক গোয়েন্দারা। তারা ১৩ মে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের ফ্লাইটে আসা একটি অবৈধ ওষুধের চালানও আটক করেন। এরপর ১৭ মে মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে আনা সাত কোটি টাকার ওষুধ বিমানবন্দরের কুরিয়ার সার্ভিস থেকে জব্দ করা হয়। পরদিন ১৮ মে কাস্টমস কর্মকর্তারা এয়ার ফ্রেইট শাখা থেকে ওষুধ ও বিদেশী সিগারেটের চালান জব্দ করেন। এ প্রসঙ্গে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড সদস্য মোঃ ফরিদ উদ্দিন জনকণ্ঠকে বলেন, আমাদের বেশিরভাগ পণ্য চীন, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুরসহ বেশ কয়েকটি দেশ থেকে আমদানি হয়। তিনি বলেন, ট্রেড ফ্যাসিলিটেশনের অংশ হিসেবে সময়ক্ষেপণ দূর করা এবং মিথ্যা ঘোষণায় পণ্য আমদানি বন্ধে পদক্ষেপ নিয়েছি আমরা। মিথ্যা ঘোষণায় আমদানি করে ছাড় পাওয়ার সুযোগ এখন আর থাকবে না বলে তিনি জানান। বাংলাদেশ ব্যাংকের এক পরিদর্শন প্রতিবেদনে দেখা যায়, এ্যালুমিনিয়ামের তার আমদানির জন্য নারায়ণগঞ্জে মক্কা মেটাল ইন্ডাস্ট্রিজ মালয়েশিয়ান কোম্পানি ইমালিয়া এন্টারপ্রাইজের সঙ্গে এলসি খুলে গত বছরের এপ্রিলে। মালয়েশিয়ান কোম্পানি পরে চীনা কোম্পানি মেসার্স সেথ চায়না ম্যানুফ্যাকচারিং বরাবর ওই এলসি প্রতিস্থাপন করে। কিন্তু চীনা কোম্পানি সরাসরি তাদের বরাবর এলসি খোলার প্রস্তাব দেয়। মালয়েশিয়ান কোম্পানির সঙ্গে আলোচনা করে মক্কা মেটাল সরাসরি এলসি খোলে। মংলা বন্দরে আমদানি পণ্যের কায়িক পরীক্ষায় দেখা যায়, এ্যালুমিনিয়ামের তারের বদলে এসেছে মাটি, বালু ও পাথরের কুচি। পরে মালয়েশিয়ান কোম্পানি এটিকে দুর্ঘটনা উল্লেখ করে এলসির অর্থ ৩৭ হাজার ডলার ফেরত দেয় ক্ষতিগ্রস্ত কোম্পানিকে। মক্কা মেটালের আরমানিটোলার ঠিকানায় টেলিফোনে যোগাযোগ করলে ফয়সাল পরিচয়ে এক ব্যক্তি বলেন, মালয়েশিয়ার কোম্পানির সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়ে আমরা চীন থেকে এ্যালুমিনিয়াম ওয়ার স্ক্র্যাপ আমদানির ঋণপত্র খুলেছিলাম। তবে তারা আমাদের সঙ্গে জালিয়াতি করেছে। অপর এক পরিদর্শন প্রতিবেদনে দেখা যায়, জনতা ব্যাংক তোপখানা রোড শাখার গ্রাহক মাহিন ট্রেডার্স নামে একটি প্রতিষ্ঠান ৪৬ লাখ টাকা মূল্যের ২৪ হাজার কেজি এ্যালুমিনিয়াম ইনগট বা দ- আমদানির জন্য গত বছরের আগস্টে ঋণপত্র খোলে। গত অক্টোবরে পণ্য আসার পর চট্টগ্রাম বন্দরে কাস্টমস কর্তৃপক্ষ পণ্যের কায়িক পরীক্ষা করে দেখে এ্যালুমিনিয়াম পণ্যের বিপরীতে কনটেনার ভর্তি বড় বড় পাথর এসেছে। যদিও আমদানিকারকের এলসির কাগজ সঠিক ছিল। আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান ব্যুরো ভেরিতাস, চায়নাকে প্রাক-জাহাজীকরণ পরিদর্শক (পিএসআই) হিসেবে নিয়োগ দেয়ার পরও এ ঘটনা ঘটে। এতে দেখা যায়, কনটেনারের গায়ে লাগানো সিলের নম্বর ও ব্যুরো ভেরিতাসের শিপিং সিলের নম্বর এক নয়। একই রকম ঘটনা ঘটেছে এ.বি এ্যান্ড ডি করপোরেশন নামের একটি প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে। তারা সিসা দ- (লেড ইনগট) আমদানির জন্য সাউথইস্ট ব্যাংকের আগ্রাবাদ শাখায় এলসি খুলেছিল। কাঁচামালের পরিবর্তে পাউডার জাতীয় পণ্য আসায় খালাস কার্যক্রম বন্ধ রাখে কাস্টমস কর্তৃপক্ষ। এ ছাড়া রফতানিকারকের এলসি মূল্য পরিশোধ করা হয়েছে কি-না সে বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য দেয়ার অনুরোধ জানিয়ে তারা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে চিঠি দেয়। এর পর কেন্দ্রীয় ব্যাংক এ বিষয়ে সাউথইস্ট ব্যাংক থেকে তথ্য সংগ্রহ করেছে। সাউথইস্ট ব্যাংক জানিয়েছে, বিদেশী রফতানিকারক সমমূল্যের সিসা দ- দিতে রাজি হয়েছে। এমন প্রেক্ষাপটে আমদানিকারকের স্বীকৃতি নিয়ে চীনা প্রতিষ্ঠানের এলসি মূল্য পরিশোধ করা হয়েছে। স্মরণকালের সবচেয়ে আলোচিত আমদানি পণ্যের ঘটনাটি ঘটে গেল মে মাসে। খাতুনগঞ্জের ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠান খান জাহান আলী লিমিটেডের নামে দক্ষিণ আমেরিকার দেশ বলিভিয়া থেকে ১০৭টি ড্রামে সূর্যমুখী তেল আসার কথা। ভোজ্যতেলবাহী কনটেনারটি জাহাজীকরণ হয় উরুগুয়ের মন্টিভিডিও বন্দর থেকে। সেখান থেকে সিঙ্গাপুর হয়ে গত ১২ মে এটি চট্টগ্রাম বন্দরে এসে পৌঁছে। গোয়েন্দা পুলিশের তথ্যের ভিত্তিতে মাদকদ্রব্য সন্দেহে গত ৭ জুন চট্টগ্রাম বন্দরের এনসিটি ইয়ার্ডে থাকা কনটেনারটি আটক করে সিলগালা করে দেয় শুল্ক গোয়েন্দা অধিদফতর। পরদিন ৮ জুন চট্টগ্রাম কাস্টমস, শুল্ক গোয়েন্দা অধিদফতর, চট্টগ্রাম বন্দর, গোয়েন্দা পুলিশ, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর, নৌবাহিনীসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে কনটেনারে থাকা ভোজ্যতেলের কায়িক পরীক্ষা করা হয়। আরও পরীক্ষার জন্য পরে নমুনা পাঠানো হয় ঢাকার স্বীকৃত দুটি পরীক্ষাগারে। সেখানে কনটেনারে থাকা ৯৬ নম্বর ড্রামে প্রায় ৬০ কেজি তরল কোকেনের অস্তিত্ব পাওয়া যায়। এদিকে ব্যাংকিং খাতে পণ্য আমদানির দেনা শোধে বড় ধরনের জালিয়াটি ঘটে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে। চীনের হুয়াইয়ে ইন্ডাস্ট্রিয়াল কোম্পানি থেকে শিল্পে ব্যবহৃত চুল্লি (ইন্ডাকশন কুকার) আমদানির জন্য এলসি খোলে দ্য ট্রেড এ্যান্ড কমার্স নামে একটি প্রতিষ্ঠান। আইএফআইসি ব্যাংকের ঢাকার মৌলভীবাজার শাখার মাধ্যমে ১২ হাজার ডলারের এলসি খোলা হয়। প্রতিষ্ঠানের মালিক এইচএম আওয়াল এলসি মার্জিন বাবদ ব্যাংকে জমা করেন দুই লাখ ৬৫ হাজার টাকা সমমূল্যের ডলার। এলসির চুক্তি অনুযায়ী যথাসময়ে পণ্য পাঠায় চীনা প্রতিষ্ঠান। তবে পণ্য আসার পর তাতে সমস্যা দেখিয়ে চীনা প্রতিষ্ঠানের মূল্য পরিশোধ থেকে বিরত থাকে প্রতিষ্ঠানটি। হুয়াইয়ে ইন্ডাস্ট্রিয়ালের অভিযোগের ভিত্তিতে পরিদর্শনে গিয়ে এইচএম আওয়ালের পণ্য আমদানিতে নানা গোলমাল পেয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। একইভাবে পলাশ এন্টারপ্রাইজ ও মেসার্স ভিশন লাইন নামে একই মালিকের অপর দুই প্রতিষ্ঠান ভারত ও চীন থেকে আমদানির ক্ষেত্রে অহেতুক সমস্যা বা ডিস্ক্রিপেন্সি দেখিয়ে মূল্য পরিশোধ করেনি। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এলসি স্থাপন ও বাতিলের বিষয়টি উদ্দেশ্যমূলক বলে পরিদর্শক দলের কাছে মনে হয়েছে। এ পরিস্থিতিতে জালিয়াতি করে পণ্যমূল্য পরিশোধ থেকে বিরত থাকার দায়ে এইচএম আওয়ালের বিরুদ্ধে মামলা করতে আইএফআইসি ব্যাংকের মৌলভীবাজার শাখাকে নির্দেশ দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ব্যাক টু ব্যাক এলসি খোলা হয়েছে ৬৮৩ কোটি ৮ লাখ মার্কিন ডলার। আর নিষ্পত্তি হয়েছে ৬২০ কোটি ১৮ লাখ মার্কিন ডলার। কয়েক বছর ধরে মূলধনী যন্ত্রপাতির আমদানি বৃদ্ধির অস্বাভাবিক তথ্য মিলছে। যে হারে এলসি খোলা হয়েছে, সে হারে নতুন বিনিয়োগ বাড়ছে না। পরিসংখ্যান বলছে, ২০১৪-১৫ অর্থবছরে মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানিতে এলসি খোলা হয়েছে ৪৩৫ কোটি ৪৭ লাখ মার্কিন ডলার। আর নিষ্পত্তি হয়েছে ৩০৯ কোটি ৬৮ লাখ মার্কিন ডলার। পরিসংখ্যান বলছে, মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি বাড়লেও ২০১৪-১৫ অর্থবছরে নতুন বিনিয়োগ উল্লেখযোগ্যহারে বাড়েনি। বাংলাদেশ ব্যাংক ও বিনিয়োগ বোর্ডের (বিওআই) তথ্য অনুযায়ী, ২০১৪-১৫ অর্থবছরে স্থানীয় বিনিয়োগে প্রকল্প নিবন্ধিত হয় ১ হাজার ৯টি । এতে বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল ৯১ হাজার ২৭৩ কোটি টাকা। এদিকে মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানির জন্য ঋণপত্র খোলার হার বাড়লেও এর আড়ালে অর্থ পাচার অথবা অন্য পণ্য আমদানি হচ্ছে কি-না তা খতিয়ে দেখতে ২০১৪ সালের ১ জানুয়ারি থেকে চলতি বছরের ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানির তথ্য অনুসন্ধানে নামে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ বিষয়ে বৈদেশিক মুদ্রা নীতি বিভাগের দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জনকণ্ঠকে বলেন, দীর্ঘদিন ধরেই দেশে মূলধনী যন্ত্রপাতির আমদানিতে অস্বাভাবিক তথ্য মিলছে। কিন্তু দেশে নতুন বিনিয়োগের দেখা মিলছে না। এতে যে কারোরই সন্দেহ জাগতে পারে, প্রকৃতপক্ষে মূলধনী যন্ত্রপাতি দেশে আসছে কিনা। তিনি আরও বলেন, সংশ্লিষ্ট এলসির মালামাল বন্দর থেকে খালাসের সময় কনটেনারে প্রকৃতপক্ষে কী আনা হয়েছে সেটি ফিজিক্যালি দেখার দায়িত্ব কাস্টমস কর্তৃপক্ষের। ফলে মাল খালাসের সময় কাস্টমস কর্তৃপক্ষ কর্তৃক বিল অব এন্ট্রির পরিসংখ্যান থেকেও কিছু তথ্য মিলতে পারে। এছাড়া উদ্যোক্তারা যে মূলধনী যন্ত্রপাতির এলসি খুলেছেন, সেগুলো দেশে এনে তা কারখানায় স্থাপন করা হয়েছে কিনা, তা সরেজমিন তদন্ত করলেই সবকিছু খোলাসা হবে। এ প্রসঙ্গে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর জনকণ্ঠকে বলেন, আমদানির চিত্র ফুলানো-ফাঁপানো। প্রকৃত পক্ষে এর বাস্তবতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার দাবি রাখে। অনেক আমদানি পণ্যে কাস্টমস ডিউটি থাকে না। এরপরও সেসব পণ্যের আমদানি অতি মূল্যায়িত দেখানো হচ্ছে। যেখানে দেশের মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রার একটা অংশ বাইরে পাচারের সমূহ ধারণা দিচ্ছে। এগুলো আমাদের জোরালো মনিটরিংয়ে রাখা দরকার। সংশ্লিষ্টরা জানান, ক্যাপিটাল মেশিনারি আমদানির ডিউটি খুবই কম। অধিকাংশের শুল্ক শূন্য। কোনটির ৩ শতাংশ। এর বেশি নয়। সে কারণে এই পণ্য আমদানির এলসি খুলতে শুল্ক বাবদ খুব একটা খরচ হয় না। এই সুযোগে ওভার ইনভয়েসের মাধ্যমে ক্যাপিটাল মেশিনারির এলসি খোলার মাধ্যমে বিদেশে অর্থ পাচার করা হচ্ছে। সূত্রে জানা গেছে, আমদানির নামে মুদ্রা পাচারের উদ্দেশ্যে অসাধুচক্র এলসি খোলার সময়ে পণ্যের সুনির্দিষ্ট বিবরণ উল্লেখ করছে না। এমনকি এইচ এস কোডও উল্লেখ করা হচ্ছে না। ফলে কোন পণ্য বন্দরে আসার পর তার শুল্কায়ন করার ক্ষেত্রে বড় ধরনের জটিলতার সৃষ্টি হচ্ছে। এছাড়া এইচ এস কোড নম্বর না থাকায় পণ্যের আন্তর্জাতিক বাজার দর, এর সঠিকতা যাচাই করা সম্ভব হচ্ছে না। ফলে অসাধু আমদানিকারকরা এক পণ্যের এলসি খুলে অন্য পণ্য আমদানি করছে। এর মাধ্যমে মুদ্রা পাচার করা হচ্ছে বলে সন্দেহ প্রকাশ করা হচ্ছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ম. মাহফুজুর রহমান জনকণ্ঠকে বলেন, ব্যাংকিং চ্যানেলে অর্থ পাচারের সুযোগ খুবই কম। বাংলাদেশ থেকে যে অর্থ পাচার হয় তার বেশিরভাগই হয় হুন্ডির মাধ্যমে। দুই হাজার কোটি টাকার আমদানি বিল বকেয়া ॥ রফতানিকারক চাহিদা অনুযায়ী পণ্য সরবরাহ করলে আমদানিকারকের ব্যাংক শর্ত অনুযায়ী রফতানিকারক ব্যাংকের অর্থ পরিশোধ করতে বাধ্য থাকে। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে যথাযথভাবে পণ্য সরবরাহ করা হলেও রফতানিকারককে টাকা পরিশোধ করেন না আমদানিকারক। এ ক্ষেত্রে ইমেজ সঙ্কটে পড়ে দেশ ও দেশের ব্যাংকগুলো। এর পরিণাম দেশকেই বহন করতে হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান হতে দেখা যায়, দেশী-বিদেশী মিলে প্রায় দুই হাজার কোটি টাকার আমদানি বিল বকেয়া রয়েছে। জানা গেছে, বেশির ভাগ বিলই মামলাধীন রয়েছে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, মোট তিন হাজার ২৩১টি বিলের মধ্যে দুই হাজার তিনটি মামলাই বর্তমান বিচারাধীন রয়েছে। রফতানিকারকেরা আমদানি-কারকদের বিপরীতে বিল পরিশোধ না করায় আদালতে মামলা করেছেন। এসব মামলার বিপরীতে প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকার আমদানি বিল আটকে রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, যেসব বকেয়া আমদানি বিলের বিপরীতে মামলা রয়েছে ওই সব বিল আদায়ের ব্যাপারে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কোন বক্তব্য নেই। কেননা এটা আদালতেই নিষ্পত্তি হবে। কিন্তু যেসব বিলের বিপরীতে কোন মামলা নেই কেবল ওই সব বিল আদায়ের ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তৎপরতা রয়েছে বলে ওই সূত্র জানিয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জনকণ্ঠকে বলেন, বকেয়া আমদানি বিলের ব্যাপারে কঠোর অবস্থান নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। পণ্যের বিবরণ ছাড়া এলসি খোলা যাবে না ॥ যে কোন পণ্য আমদানির জন্য এলসি খোলার সময় সুনির্দিষ্ট বিবরণ লিখতে হবে। পণ্যের সুনির্দিষ্ট বিবরণ ছাড়া কোন এলসি খোলা যাবে না। একই সঙ্গে আমদানি করা পণ্যের এইচ এস কোড বা পণ্য শনাক্তকরণ কোড নম্বর সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করতে হবে। যে কোন এলসির ক্ষেত্রে এই দুটি তথ্য সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ না করলে কোন ব্যাংক এলসি খুলতে পারবে না। একই সঙ্গে এলসির বিপরীতে কোন ব্যাংক এলসি অথরাইজেশন ফরম ইস্যু করতে পারবে না। গত ১৭ এপ্রিল এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে একটি সার্কুলার জারি করে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের (এমডি) কাছে পাঠানো হয়। এর আগে গত ১৬ মার্চ বেনাপোল কাস্টম হাউস থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে পাঠানো এক চিঠিতে বলা হয়েছে, এই বন্দরের মাধ্যমে আমদানি করা পণ্য খালাসের সময় পণ্যের এলসি এবং এলসি অথরাইজেশন ফরম জমা দিতে হয়। ওইসব ফরমে পণ্যের সঠিক বিবরণ উল্লেখ না থাকায় আমদানি করা পণ্যের সঙ্গে এলসিতে উল্লিখিত পণ্যের সঠিক মিল পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে পণ্যের শুল্কায়ন করতে সমস্যা হচ্ছে। উল্লেখ্য, আমদানিনীতিতে পণ্য আমদানির সময় এলসিতে পণ্যের পূর্ণাঙ্গ পরিচিতি এবং এইচ এস কোড নম্বর লেখার বিধান রয়েছে।
×