ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কাপুরুষ সৃষ্টি করেনি কখনও

প্রকাশিত: ০৬:১৪, ৩০ আগস্ট ২০১৫

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কাপুরুষ সৃষ্টি করেনি কখনও

হার্টগের ইচ্ছে ছিল আলিগড় থেকে এ এফ রহমানকে আনা। কিন্তু রিডার হওয়ার মতো উপযুক্ত যোগ্যতা তাঁর ছিল না। তারপরও হার্টগ শিক্ষা বিভাগের পরিচালক হর্নেলকে লিখেছিলেন, ইতিহাস বিভাগের প্রফেসর ও চেয়ারম্যান পদের প্রার্থী হিসেবে এ এফ রহমানের দরখাস্ত তিনি দেখেছেন এবং তিনি ব্যক্তিগতভাবে তাঁকেই নিতে ইচ্ছুক। গতকালের পর আজ পড়ুন পঞ্চম কিস্তি... কমিশন ভূমিকায় উল্লেখ করেছে- ‘একটি স্বাধীন সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রের সরকারী চাকুরেগণের মধ্যে শ্রেণী বিভাজন মোটেও কাম্য নয়। তাই এর বিলুপ্তিকরণ সুপারিশ করা হয়েছে। এখন থেকে একজন সরকারী চাকুরের গ্রেড বা স্কেল দ্বারা তাঁর আপেক্ষিক অবস্থান জানা যাবে।’ যৌক্তিক অবস্থান। তা’হলে আমি এখন ১ থেকে ৫ (বা ৬ চলে আসব)? হবুচন্দ্র রাজার দেশে আছি বোধহয়। ১ থেকে আমি উপরে উঠতে না পারি, ৫/৬-এ আমাকে নামানো হবে এটি কোন্ ধরনের যৌক্তিকতা বা ন্যায়বিচার? বিবেকবান প্রধানমন্ত্রীর কাছে এ প্রশ্ন রইল। বিশ্ববিদ্যালয়ের যেসব খ-কালীন শিক্ষক ছিলেন এই কমিশনে তাদেরও এ প্রশ্নের জবাব দিতে হবে। মূল বেতন নিয়ে আলোচনা করেছি। ভাতা নিয়ে নয়। আমরা সিভিল অফিসারদের ভাতার বিষয় জানি, সেনাবাহিনীর নয়। কারণ, তাদের সব তথ্যই গোপন তথ্য বলে বিবেচনা করা হয়। কিন্তু সিভিল আমলাতন্ত্র কী ভাতা পান সেটিও জানা দরকার। বাড়ি ভাড়া ও চিকিৎসা ভাতা সবাই কমবেশি পায়, আমরাও পাই। এ নিয়ে আলোচনার কিছু নেই। কিন্তুÑ ১. সরকারি উর্ধতন কর্মকর্তারা [বর্তমানে ১-৩] সার্বক্ষণিক গাড়ি পান। বিকল্প আরেকটি ব্যবস্থা আছে। গাড়ি কেনার জন্য তিনি ২৫ লাখ টাকা সুদবিহীন ঋণ পেতে পারেন। এর সঙ্গে মাসে পাবেন গাড়ি রক্ষণাবেক্ষণ ও অন্যান্য খরচের জন্য ৪৫,০০০ টাকা। ২. শিক্ষা সহায়তা ভাতা তাদের বাড়ানোর সুপারিশ করা হয়েছে। এক সন্তানের জন্য ১,০০০, একাধিকের জন্য ২,০০০ টাকা। ৩. ভৃত্যভাতা মাসিক ৩,০০০ টাকা পেতেন, পাবেন। ৪. আপ্যায়ন ভাতা সর্বোচ্চ ৩,০০০ টাকা, সর্বনিম্ন ১,৫০০ টাকা প্রতি মাসে। ৫. আবাসিক টেলিফোন। ৬. পার্বত্য অঞ্চলে বদলি হলে অতিরিক্ত ভাতা মাসে ৫,০০০ টাকা। ৭. অষ্টম গ্রেডে বা চাকরিতে ঢোকাকালীন স্থিতি ভাতা ১০,০০০ টাকা। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকরা এর কোন সুবিধাই পান না। দাবিও করেননি কখনও। এটা ঠিক সরকার পক্ষ থেকে বলা হতে পরে, স্বইচ্ছায় আপনি শিক্ষক হয়েছেন, না পোষালে চলে যান। এই কথা তা’হলে সর্বক্ষেত্রেই প্রযোজ্য হতে হবে। ড. ফরাসউদ্দিন ও তার সহকর্মীরা সেনাবাহিনীর বেতন ভাতা নিয়ে কোন উচ্চবাচ্য করেননি। হতে পারে, তারা সরকারের বাইরে। বা তারা জানেন কাদের সম্পর্কে বলতে হয়, কাদের সম্পর্কে নিশ্চুপ থাকতে হয়। কাদের তোষামোদ করতে হয়, কাদের দলন বা অপমান করতে হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক মকসুদ কামাল ‘দৈনিক প্রথম আলো’য় এক প্রবন্ধে বাংলাদেশসহ পার্শ্ববর্তী দেশসমূহের অধ্যাপকদের বেতনের তুলনামূলক বিচার করেছেন। সেখানে দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশ থেকে সব দেশেই শিক্ষকদের বেতন বেশি। আমি সে প্রসঙ্গে যাব না। আমাদের দেশের সম্পদের তুলনায়ই আমরা বিচার করব। তিনি মর্যাদার কথাও তুলেছেন। তার প্রবন্ধ পড়লে পাঠকরা সমিতির যুক্তিগুলো অনুধাবনের সুযোগ পাবেন। আমি তার পুনরাবৃত্তি করছি না। অষ্টম পে স্কেলের বিজ্ঞজনরা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সম্পর্কে তাদের মূল্যবান একটি বক্তব্য রেখেছেন। তাদের মতে ‘সরকারী মঞ্জুরিপ্রাপ্ত বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে কর্মরত শিক্ষকগণ সরকারী বেতন কাঠামোর অনুরূপ বেতন-ভাতাদি পেয়ে থাকেন [বক্তব্য সঠিক নয়]। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকগণ একটি দায়িত্বপূর্ণ পেশায় নিয়োজিত থেকে শিক্ষার্থীগণকে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলেন। তাঁদের এ বিশেষায়িত পেশার কারণে সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকগণ উচ্চতর বেতন স্কেল সম্বলিত স্বতন্ত্র বেতন-কাঠামো প্রত্যাশা করেন। কিন্তু সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী নয়, বরং সম্পূর্ণভাবে সরকারী মঞ্জুরির ওপর নির্ভরশীল। তাই কমিশন মনে করে যে, সরকারী অনুদানের ওপর নির্ভরতা কমিয়ে আর্থিকভাবে সম্পূর্ণ স্বাবলম্বী না হওয়া পর্যন্ত পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের জন্য উচ্চতর স্কেলের আলাদা বেতন কাঠামো প্রণয়ন করা সমীচীন হবে না।’ [পৃ. ১৩৯] সেনাবাহিনী ও সরকারী কর্মচারীদের জন্য এটি প্রযোজ্য হবে না? কেন? সেনাবাহিনী, সরকারী আমলারা যদি একটি প্রতিষ্ঠান হয়, বিশ্ববিদ্যালয়ও একটি প্রতিষ্ঠান। সেনাবাহিনী ও সরকারী আমলারা উৎপাদনমুখী কোন কর্মের সঙ্গে যুক্ত নয়, বরং বিশ্ববিদ্যালয়গুলো উৎপাদনের সঙ্গে যুক্ত। তাদের যে আয় বিশেষ করে সেনাবাহিনীর যে ব্যবসা ও আয় তা দিয়েই তো তাদের বেতন দেয়া যেতে পারে। সরকারের বেতনের দরকার কী? সরকারী কর্মচারীদের এত বেতন-ভাতা দিতে হবে কেন, তাদের তো নিজস্ব কোন আয় নেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যে জমি ছিল তা সরকার কেড়ে নিয়েছে, ব্যবসাপাতির সুযোগ নেই। থাকলে এ প্রশ্ন উঠত না। কেন ড. ফরাসউদ্দিনের মনে হলো না সেনাবাহিনী ও সরকারী কর্মকর্তাদের ক্ষেত্রেও এ মন্তব্য প্রযোজ্য হতে পারে? এর কারণ হচ্ছে, তারা শিক্ষাকে এখন সম্পূর্ণ পণ্য হিসেবে বিবেচনা করছেন; কিন্তু যখন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছেন তখন শিক্ষাকে পণ্য হিসেবে বিবেচনা করেননি। তবে তারা মনে করেনÑ ‘তবে দেশ ও জাতির অগ্রবর্তী চলার পথে বিশেষ ও নিরন্তর অবদানের জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বুয়েটকে বিশেষ মর্যাদা দানের বিষয় বিবেচনা করা যেতে পারে’। তাদের করুণার জন্য ধন্যবাদ। তারা কি মনে করেন সামরিক ও বেসামরিক আমলাতন্ত্র ‘দেশ ও জাতির অগ্রবর্তী চলার পথে বিশেষ ও নিরন্তর অবদান রাখছে?’ এ মন্তব্য তারা করেননি, কারণ তারা যথেষ্ট জ্ঞানী ও বুদ্ধিমান, জানেন যে এ ধরনের মন্তব্য হাস্যকর মন্তব্য বলে বিবেচিত হবে। তাই যদি হয়, যারা দেশের জন্য নিরন্তর অবদান রাখছেন, কোন্্ লজিকে যারা রাখছেন না, তাদের চেয়ে কম মর্যাদা ও বেতন পেতে হবে? ॥ চার ॥ ড. ফরাসউদ্দিন ও তার কমিশন সদস্যরা যে সুপারিশ করেছেন তার একটি ভিত্তি আছে। তারা কে কোন্ পেশায় ছিলেন সে বিশ্লেষণে আমি যাব না। কিন্তু মনোভঙ্গিটি এসেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় [অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়] সম্পর্কে নিরন্তর কুৎসা প্রচারণায়। এসব কুৎসা-অভিযোগ-প্রচারণা এলিট ও আমলাতন্ত্রের। সেগুলো কী? ১. বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকরা ক্লাস নেন না। ২. তারা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ান ও কনসালটেন্সি করেন। ৩. তারা রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। ৪. ছাত্ররা রাজনীতি করে, অপকর্ম করে বেড়ায়, তারা শিক্ষিত না। ৫. শিক্ষকরা দ্রুত প্রমোশন পান। ৬. যোগ্য শিক্ষক নিয়োগ পান না। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকরা ক্লাস নেন না, তো কী করেন? ভেরেন্ডা ভাজেন। ক্লাস না নিলে পরীক্ষা হয় কিভাবে, ক্লাস না হলে ছাত্ররা পরীক্ষা দেয় কিভাবে, নিয়মিত ফল প্রকাশিত হয় কিভাবে? আমলাতন্ত্রে যারা আছেন, তারা বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস না করে পরীক্ষা না দিয়ে সার্টিফিকেট পেয়েছেন? প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৮০০ শিক্ষকের মধ্যে কয়জন পড়ান? বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কয়টি বিভাগ আছে এবং কী কী? বাণিজ্যহীন বিভাগ তারা রেখেছেন? প্রাইভেটে বাণিজ্য সংক্রান্ত বিভাগে বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষক পড়ান। তার হার কি ১%-এর বেশি হবে? তারা কি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস না করে সেখানে পড়ান? বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের মালিকরা যে শিক্ষা মন্ত্রণালয়/মঞ্জুরি কমিশনের কোন নির্দেশ মানে না সেজন্য কি প্রবল প্রতাপান্বিত মন্ত্রী ও আমলারা ব্যবস্থা নিতে পেরেছেন? আমলাদের কত পার্সেন্ট প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে জড়িত? কনসালটেন্সি আমলারা বেশি করেন না শিক্ষকরা? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় ১৮০০ শিক্ষক কি কনসালটেন্সি করেন? করার সুযোগ আছে? চলবে...
×