ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

অনলাইন গণমাধ্যম নীতিমালার খসড়া হাতে হাতকড়া, পায়ে ডাণ্ডাবেড়ি নেই

প্রকাশিত: ০৬:১৭, ৩০ আগস্ট ২০১৫

 অনলাইন গণমাধ্যম নীতিমালার খসড়া হাতে হাতকড়া, পায়ে ডাণ্ডাবেড়ি নেই

একটি অনলাইন পত্রিকার সম্পাদক শরীফ আহমেদ জোরালোভাবে বললেন, অনলাইন নীতিমালার পঞ্চম অধ্যায় বাতিল না করলে সেটি গণমাধ্যমের গলা টিপে মারবে। একই সঙ্গে তিনি নিবন্ধন বাতিল করা এবং কমিশনের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন তুললেন। শরীফ আহমেদকে ধন্যবাদ যে, তিনি অনলাইন গণমাধ্যম নিয়ে প্রশ্ন তুললেন। সচরাচর কেউ এসব বিষয়ে মাথা ঘামান না। বরং নীতিমালা প্রণীত হওয়ার পর সেই নীতিমালা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। তবে এটিও ভাল ছিল যে, তার প্রশ্নগুলোর জবাব সেখানে দেয়া হয়। আমি কথা বলি। কথা বলেন ইকবাল সোবহান চৌধুরী। আমাদের কথার মূল সুরটা হচ্ছে সংবিধান আমাকে মত প্রকাশের এবং বাকস্বাধীনতার অধিকার দিয়েছে। তবে তার মানে এই নয় যে, আমি যা খুশি তাই করতে পারব। আমি এই কথাও বলেছি যে, দেশের প্রচলিত আইনের বাইরে একটি শব্দও তাতে ব্যবহৃত হয়নি। জনাব ইকবাল সোবহান চৌধুরী অবশ্য আরও গভীরে কথা বলেন। তিন প্রশ্ন তোলেন যে, স্বাধীনতা মানে কি কাবা শরীফের গিলাফের ছবিকে সাঈদীর মুক্তির দাবির ছবি বানানো না সাঈদীকে চাঁদে দেখা? তিনি যুদ্ধাপরাধের বিচারবিরোধী ও জঙ্গীবাদের প্রসারে সহায়তার বিষয়টির প্রতিও দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। তিনি স্বাধীনতা মানে নিজের স্বাধীনতার পাশাপাশি অন্যের মত প্রকাশের স্বাধীনতা রক্ষার অঙ্গীকারের কথা বলেন। প্রসঙ্গটি হচ্ছে গত ২৭ আগস্ট ২০১৫ তারিখে ঢাকার প্রেস ইনস্টিটিউটে আয়োজিত হয় বাংলাদেশ অনলাইন মিডিয়া সমিতির (বোমা) সেমিনার। এই সেমিনারে প্রধান অতিথি ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর তথ্য উপদেষ্টা ইকবাল সোবহান চৌধুরী। আরও ছিলেন পিআইবির ডিজি শাহ আলমগীর। আলোচ্য বিষয় ছিল জাতীয় অনলাইন নীতিমালা ২০১৫। আমি ছিলাম মুখ্য আলোচক। দুয়েকজন কথা বলার পর আমি মূল আলোচনা শুরু করি। সেখানেই মারুফ আহমেদ নামক একজন সম্পাদক রীতিমতো ঘোষণা দিলেন যে, অনলাইন নীতিমালার খসড়া যারা প্রণয়ন করেছি তারা না বুঝি ডিজিটাল না বুঝি অনলাইন। বিষয়টি নিয়ে পরের দিনের অনেক মিডিয়ায় বেশ সরব আলোচনাই হয়েছে। তবে সব সময়েই বস্তুনিষ্ঠ আলোচনা হয় সেটি নয়। তবে আলোচনা হওয়া উচিত। ২০১৪ সালের এপ্রিল মাসের তৃতীয় সপ্তাহে বাংলাদেশের পত্রিকা ঢাকা ট্রিবিউন খবরটি প্রথম ছাপে। তারই সূত্র ধরে প্রিয় ডট কমসহ কয়েকটি অনলাইন সাইটে খবরটি পুনর্প্রকাশিত হয়। খবরে বলা হয় যে, আমার নেতৃত্বে গঠিত একটি সাব কমিটি অনলাইন গণমাধ্যম নীতিমালার খসড়া চূড়ান্ত করেছে; যাতে ৫ লাখ টাকার লাইসেন্স ফিস প্রদানের বিধান রাখা হয়েছে। অনলাইন নিউজপোর্টাল পরিচালনা করেন এবং তথ্যপ্রযুক্তি সাংবাদিকতার সঙ্গে যুক্ত অনেকেই সেই সূত্র ধরে আমাকে ফোন করতে থাকেন। আমি প্রিয় ডট কমে খবরটি পড়ে এর নির্বাহী জাকারিয়া স্বপনকে জানাই যে, আমার সঙ্গে এ বিষয়ে কেউ কথা বলেনি এবং অনলাইন গণমাধ্যম নীতিমালার খসড়ায় এ ধরনের কোন বিষয়ের উল্লেখও নেই। জাকারিয়া স্বপন আমার কথাগুলো বিশ্বাস করেন এবং খবরটি প্রত্যাহার করেন। একই সঙ্গে অনলাইন নিউজপোর্টাল মালিকদের দুটি সংগঠন বনপা ও বোমার কর্মকর্তারা আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেন এবং আমি তাদের জানাই যে, আপনারা যে খসড়াটি তৈরি করেছেন সেটিই প্রকৃত খসড়া। অন্য কোন খসড়ার খবর আমি জানি না। আমার জানা মতে সরকারের কেউ তেমন কোন আলাদা খসড়ার কথাও জানে না। তবে অনলাইন গণমাধ্যম নীতিমালার আরও একটি খসড়া ২০১২ সালে প্রকাশিত হয়েছিল। তখন সেটি নিয়ে আমার একটি লেখাও প্রকাশিত হয়েছিল। ‘হাতে হাতকড়ি পায়ে ডা-াবেড়ি’ শিরোনামে প্রকাশিত সেই লেখাটি আবার পাঠ করে আমি বুঝতে পেরেছি যে, ঢাকা ট্রিবিউন সেইটিকেই অনলাইন গণমাধ্যম নীতিমালার খসড়া হিসেবে গ্রহণ করে খবরটি তৈরি করেছে। দেশের কোন গণমাধ্যমের পক্ষ থেকে এমন দায়িত্বজ্ঞানহীন আচরণ কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। আসুন আগে সেই বিতর্কিত খসড়াটি আমরা দেখি। এরপর আমরা যে খসড়াটি তৈরি করেছি সেটি তুলে ধরা যাবে। অনলাইন গণমাধ্যম নীতিমালা নিয়ে যাদের আগ্রহ আছে তারা ধারাবাহিকভাবে আমার এই কলামটি পাঠ করতে পারেন। অনলাইন গণমাধ্যম নীতিমালার প্রথম খসড়া নিয়ে প্রকাশিত আমার লেখাটি শুরু হয়েছিল এভাবে: ‘বাংলাদেশ সরকারের তথ্য মন্ত্রণালয় গত ২৬ সেপ্টেম্বর ২০১২ ঢাকার প্রেস ইনস্টিটিউট মিলনায়তনে ‘অনলাইন গণমাধ্যম নীতিমালা ১২’-এর খসড়ার ফলোআপ নিয়ে একটি সভা করেছে। সভায় তথ্য সচিব (সাবেক) হেদায়েতুল্লাহ আল মামুন সভাপতিত্ব করেন। ২২ সেপ্টেম্বর’ ১২ উল্লেখিত খসড়া সম্পর্কে মতামত দেবার তারিখ নির্ধারিত থাকার প্রেক্ষিতে সময় উত্তীর্ণ হওয়ার ৪ দিনের মাঝে এই সভার আয়োজন খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। বিশেষ করে সভায় খসড়া নীতিমালাটিকে স্ক্র্যাপ করার ঘোষণা সংশ্লিষ্ট মহলে স্বস্তির বাতাস প্রবাহিত করেছে। সচরাচর কোন ইস্যুতে এত দ্রুত সরকারের প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায় না। এমনকি এত তাড়াতাড়ি কোন এ্যাকশনও পাওয়া যায় না। এজন্য বিশেষত তথ্য মন্ত্রণালয়কে এত তাড়াতাড়ি হুঁশ হওয়ার জন্য ধন্যবাদ জানাই। তবে স্মরণ করিয়ে দেয়া উচিত যে, এই কাজটিতে সরকারের গণতান্ত্রিক ও প্রযুক্তিপ্রেমিক ইমেজের কিছুটা ক্ষতি ইতিমধ্যেই হয়ে গেছে। সচেতন থাকলে এই ক্ষতিটা এড়িয়ে যাওয়া যেত। ২৬ সেপ্টেম্বরের সভায় তথ্য সচিব হেদায়েতুল্লাহ আল মামুন, সাংবাদিক ইকবাল সোবহান চৌধুরী ও প্রয়াত বেবি মওদুদসহ স্ট্যাক হোল্ডারদের অনেকেই কথা বলেন। সভায় উপস্থিত থেকে সূচনা বক্তব্যটি অবশ্য আমি পেশ করেছিলাম। সভার চূড়ান্ত ফলাফল হিসেবে উল্লেখিত খসড়া নীতিমালার বদলে নিউজ ওয়েব পোর্টাল সহায়ক নীতিমালা প্রণয়নের জন্য একটি কমিটি গঠন করা হয়েছিল। তৎকালীন প্রধান তথ্য অফিসার আমিনুল ইসলাম এই কমিটির চেয়ারম্যান ও পিআইবির তৎকালীন ডিজি দুলাল বিশ্বাস কমিটির সদস্য সচিবের দায়িত্ব পালন করেন। আমি অন্তর্ভুক্ত ছিলাম প্রস্তাবিত ১৩ সদস্যের এই কমিটিতে। সভায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে বক্তব্যটি তথ্য সচিব পেশ করেন সেটি হচ্ছে যে, সরকার সামগ্রিক অর্থে ইন্টারনেট বা নির্দিষ্টভাবে ফেসবুক-টুইটারের মতো সামাজিক যোগাযোগ নেটওয়ার্কিংসমূহ, ব্লগসাইটসমূহ বা নিউজ মিডিয়ার কোন কিছুকেই নিয়ন্ত্রণ করতে চায় না। ইন্টারনেটের স্বাধীনতা হরণ করাও সরকারের উদ্দেশ্য নয় বলে তিনি জানান। তিনি অত্যন্ত স্পষ্ট করে এটি জানান, যে খসড়াটি পেশ করা হয়েছিল সেটি তো চূড়ান্ত দলিল নয়ই, বরং তার পুরোটাই বদলে ফেলা যেতে পারে। তিনি নীতিমালা প্রণয়নের জন্য সরকারের উদ্দেশ্যটিও স্পষ্ট করেন। তার মতে, সরকার বিশেষত নিউজপোর্টালগুলোকে সহায়তা করতে চায়। প্রস্তাবিত নীতিমালায় এমন কিছু ব্যবস্থা করার উপায় খোঁজা হচ্ছে যাতে নিউজপোর্টালগুলো সরকারী বিজ্ঞাপন, এক্রিডিটেশন কার্ড রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ, বিদেশে সরকারী প্রতিনিধি দলে অন্তর্ভুক্তকরণ ও অন্যান্য সহায়তা পেতে পারে। তিনি দুঃখ করে বলেন যে, সরকারের কার্যক্রমটির সঠিক খবর সকলের কাছে সঠিকভাবে পৌঁছেনি এবং এর ফলে যথেষ্ট ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়েছে। তবে আমরা যতটা জেনেছি, তথ্য সচিব নিজেই নীতিমালার মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করার বিষয়টি খসড়া নীতিমালা প্রকাশের সময় উল্লেখ করেছিলেন এবং ভুল বোঝাবুঝির সূত্রপাত সেখান থেকেই হয়েছে। অন্যদিকে আমি মনে করি যে, তখন সরকারের তথ্য মন্ত্রণালয় কোনভাবেই তাদের এখন যে উদ্দেশ্যের কথা বলছে সেই উদ্দেশ্য জনগণের সামনে উপস্থাপন করতে পারেনি। বিশেষ করে তারা যে নীতিমালাটির খসড়া জনসমক্ষে প্রকাশ করে তাতে ভুল বোঝাবুঝি তো বটেই, একটি ভুল সঙ্কেত পাওয়া গিয়েছিল। যে কথাগুলো তথ্য সচিব ২৬ সেপ্টেম্বরের সভায় বলেছেন সেটি নীতিমালার খসড়া সংক্রান্ত উদ্দেশ্যের বিবৃতিতে বলা যেত। সরকারের ইতিবাচক কাজ যে কিভাবে নেতিবাচক হয়ে উঠতে পারে এটি তেমন আরও একটি দৃষ্টান্ত। অন্য কোন মন্ত্রণালয় এই অদক্ষতার পরিচয় দিলে তেমন মনে করার কিছু ছিল না; কিন্তু তথ্য মন্ত্রণালয় মিডিয়া নিয়ে এমন গুবলেট পাকাবে সেটি কারও প্রত্যাশিত নয়। তবে এটি সুখবর যে, তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনুও সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য একটি নীতিমালা প্রণয়নে সরকারের সদিচ্ছার কথা বলেছেন। এই বিবরণ থেকে এটি জানা যায় যে, ২৬ সেপ্টেম্বর ২০১২ সরকার অনলাইন গণমাধ্যম নীতিমালা প্রণয়নের জন্য একটি ১৩ সদস্যবিশিষ্ট কমিটি করে। সেই কমিটির সভা সাবেক প্রধান তথ্য অফিসার আমিনুল ইসলামের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত হয় এবং সেখান থেকে একটি খসড়া প্রণয়ন করার জন্য আমাকে প্রধান করে সাব-কমিটি গঠন করা হয়। নতুন খসড়াটি নিয়ে আলোচনা করার আগে আমি পুরনোটি নিয়ে আলোচনা করেছিলাম। সেই আলোচনাটি নি¤œরূপ: বাতিল হওয়া খসড়া নীতিমালার বিভ্রান্তি : যাহোক, সামনের দিকে তাকাবার আগে আমরা একটু পেছনে ফিরে তাকাতে পারি। ২৬ সেপ্টেম্বরের সভার আগে তথ্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে যে অনলাইন গণমাধ্যম পরিচালনা নীতিমালা ২০১২ নামক একটি নীতিমালার খসড়া প্রকাশ করা হয় সেটি নিয়ে এরই মাঝে সংশ্লিষ্ট মহলে ব্যাপক বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে। কোন মহলই সেই নীতিমালাটিকে গ্রহণ করেনি। অনলাইনে তুমুল আলোচনা ছাড়াও ২১ সেপ্টেম্বর বিকেলে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে এই নীতিমালার বিরুদ্ধে একটি গণস্বাক্ষর কর্মসূচীও পালন করা হয়েছে। প্রযুক্তিতে বাংলাদেশ নামক একটি সংগঠন এই মানববন্ধনের আয়োজন করে। এটি নিয়ে কটি আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয় এবং এই উপলক্ষে অনলাইন গণমাধ্যমের সঙ্গে যুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলো একাধিক সংগঠনও গড়ে তুলেছে। কটি সেমিনার-সিম্পোজিয়ামের কথা আমরা শুনেছি। ঢাকা, ২৮ আগস্ট, ২০১৫ লেখক : তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, দেশের প্রথম ডিজিটাল নিউজ সার্ভিস আবাস-এর চেয়ারম্যান, বিজয় কীবোর্ড ও সফটওয়্যারের জনক ॥ ই-মেইল : সঁংঃধভধলধননধৎ@মসধরষ.পড়স ওয়েবপেজ: িি.িনরলড়ুবশঁংযব.হবঃ, িি.িনরলড়ুফরমরঃধষ.পড়স
×