ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

মোজাম্মেল খান

আমাদের অধ্যাপকদের কি আত্মহত্যা করা উচিত?

প্রকাশিত: ০৩:৪১, ২ সেপ্টেম্বর ২০১৫

আমাদের অধ্যাপকদের কি আত্মহত্যা করা উচিত?

গত দুইদিন ধরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যে ছবিটা সবচেয়ে বেশি শেয়ার করা হয়েছে সেটা হলো : এক স্তম্ভিত অধ্যাপক জাফর ইকবালের ছাতাটা পাশে রেখে বিমূঢ়ভাবে বসে বৃষ্টিতে ভেজার নিরুপায় দৃশ্য। শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলনরত শিক্ষকদের ওপর ‘জয় বাংলা সেøাগান দিয়ে ছাত্রলীগের হামলার ঘটনায় তীব্র ক্ষোভ প্রকাশের বহির্প্রকাশ ঘটিয়েছেন অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবাল এভাবে বৃষ্টিতে ভিজে। অধ্যাপক জাফর ইকবাল বিশ্বাস করতে পারেননি তাঁর চোখের সামনে যা কিছু ঘটেছে। ক্ষুব্ধ জাফর ইকবাল বলেন, ‘এখানে যে ছাত্ররা শিক্ষকদের ওপর হামলা চালিয়েছে, তারা আমার ছাত্র হয়ে থাকলে আমার গলায় দড়ি দিয়ে মরে যাওয়া উচিত।’ তিনি সব সময় ছাত্রদের দাবি-দাওয়ার পক্ষে দাঁড়িয়ে নিজেকে দল-মত নির্বিশেষে সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের শ্রদ্ধা অর্জন করেছেন। আমরা যারা উন্নত জীবন-যাপনের আশায় বিদেশে অবস্থান করছি তাদের কাছ তিনি এক পূজনীয় ব্যক্তিতে পরিণত হয়েছেন। পৃথিবীর ইপ্সিত দেশগুলোর অন্যতম যুক্তরাষ্ট্রের অতি সম্মানীয় চাকরি ছেড়ে নিজের দেশকে সেবা করার মানসে তিনি ফিরে গেছেন মাতৃভূমিতে, যে দেশের স্বাধীনতার বেদিমূলে তাঁর পিতা আত্মাহুতি দিয়েছিলেন। দেশপ্রেম তাড়িত হয়ে তিনি যে সাহসী এবং অভূতপূর্ব দেশপ্রেমিক পদক্ষেপ নিয়েছিলেন সেটা আমাদের মতন বেশিরভাগ প্রবাসীই অনুকরণ করতে পারেননি। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা যারা হৃদয়ে ধারণ করেন তাদের কাছে অধ্যাপক জাফর ইকবাল নিজেকে জাতির বিবেক হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছেন। বছরের পর বছর তিনি দেশের বিভিন্ন শহরে সশরীরে উপস্থিত হয়ে স্কুল ছাত্রছাত্রীদের মুক্তিযুদ্ধের অবিকৃত ইতিহাস তুলে ধরেছেন। সে কারণেই অতি ক্ষোভের সঙ্গে তিনি বলেছেন, ‘যে জয় বাংলা সেøাগান দিয়ে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল, সেই সেøাগানের এত বড় অপমান আমি আমার জীবনে দেখিনি।’ যে ন্যক্কারজনক ঘটনা কিছুসংখ্যক ছাত্র নামধারী দুষ্কৃতকারীরা ঘটিয়েছে সেটাকে ধিক্কার জানানোর জন্য এ ঘটনার খুব গভীরে যাওয়ার প্রয়োজন নাই। প্রত্যক্ষদর্শীদের বিবরণ অনুযায়ী, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সূত্র ও দুইপক্ষের অভিযোগ এবং পাল্টা অভিযোগ থেকে জানা গেছে, ঘটনার দিন সকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কাউন্সিল ও বোর্ড অব এ্যাডভান্সড স্টাডিজের বৈঠক হওয়ার কথাছিল। এ দুটি বৈঠককে প্রতিহত করতে উপাচার্যবিরোধী শিক্ষকরা ঘটনার দিন সকাল নয়টা থেকে বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত উপাচার্যের কার্যালয়ের সামনে অবস্থান নেয়ার সিদ্ধান্ত নেন। আগের রাতে বিষয়টি জানতে পেরে ঐদিন ভোর ছয়টার দিকে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ব্যানারে ছাত্রলীগের কর্মীরা উপাচার্যের কার্যালয়ের সামনে অবস্থান নেন। সকাল সাড়ে সাতটার দিকে আন্দোলনকারী পাঁচ-ছয়জন শিক্ষক সেখানে যান। তাঁরা ছাত্রলীগের কর্মীদের উপাচার্যের কার্যালয়ের সামনে অবস্থানের কারণ জানতে চান। ছাত্রলীগের কর্মীরা বলেন, তাঁদের ভর্তি ও একাডেমিক বিভিন্ন বিষয় নিয়ে ওই দুটি বৈঠকে সিদ্ধান্ত নেয়ার কথা রয়েছে। এ নিয়ে কথা বলার একপর্যায়ে আন্দোলনকারী শিক্ষকদের সঙ্গে ছাত্রলীগ কর্মীদের বাগ্বিতণ্ডা হয়। এরপর সকাল আটটার দিকে উপাচার্য আমিনুল হক তাঁর কার্যালয়ে ঢুকতে গেলে আন্দোলনকারী শিক্ষকরা তাঁকে বাধা দেন। উপাচার্যকে আন্দোলনকারী শিক্ষকরা ঘিরে ফেলেন। একপর্যায়ে টানাহেঁচড়া ও ধস্তাধস্তি শুরু হয়। তখন প্রক্টরিয়াল বডির সদস্য ও ছাত্রলীগের কর্মীরা উপাচার্যকে সেখান থেকে মুক্ত করে তাঁর কার্যালয়ে নিয়ে যান। এ সময় ছাত্রলীগ কর্মীদের হাতে অধ্যাপক জাফর ইকবালের সহধর্মিণী এবং আদর্শিক সহচর অধ্যাপক ইয়াসমিন হক, অধ্যাপক সৈয়দ শামসুল আলমসহ আন্দোলনকারী কয়েক শিক্ষক লাঞ্ছিত হন। এছাড়া ছাত্রলীগের একদল কর্মী শিক্ষকদের হাতে থাকা ব্যানার কেড়ে নিয়ে যান। ‘উপাচার্যকে আন্দোলনকারী শিক্ষকরা ঘিরে ফেলেন’ এ তথ্য সত্য হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান নির্বাহী হিসেবে তাঁর নিজের অফিসে পৌঁছানোর জন্য তিনি আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সহায়তা নিতে পারতেন। কোন ছাত্র গ্রুপেরই, তারা যে দলেরই হোক না কেন, তাঁকে শিক্ষকদের ‘ঘেরাও’ থেকে রক্ষা করা তাদের দায়িত্ব নয়। অধ্যাপক ইয়াসমিনের মতে, হামলার জন্য ছাত্রলীগের কিছু সমর্থক দায়ী। তাঁর ভাষায়, ‘ছাত্রলীগ সমর্থকরাই শিক্ষকদের ওপর শারীরিক হামলা চালিয়েছে। গত ২৫ বছরের মধ্যে এই ক্যাম্পাসে এমনটা ঘটেনি। তাদের এত বড় স্পর্ধার শক্তির উৎস কী? এটা অবশ্যই উপাচার্য।’ প্রত্যক্ষদর্শীর বক্তব্য বিশ্বাসযোগ্য মিডিয়া রিপোর্টে প্রকাশিত হয়েছে এবং টিভি ফুটেজ অধ্যাপক ইয়াসমিন হকের সাক্ষ্যকেই সমর্থন করছে। সে সময় ঘটনাস্থল থেকে হাত দশেক দূরে বিশ্ববিদ্যালয়ের গোলচত্বরে একাকী বসেছিলেন অধ্যাপক জাফর ইকবাল। হামলার বিবরণ দিতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘আজ আমার জীবনে একটা নতুন অভিজ্ঞতা হলো। আজ যা দেখলাম, আমার জীবনে এ ধরনের ঘটনা দেখব তা আমি কখনও কল্পনা করিনি।’ জাফর ইকবাল বলেন, গলায় দড়ি দিয়ে না মরলেও ‘তীব্র মানসিক যন্ত্রণায়’ তাঁকে ভুগতে হচ্ছে। কিভাবে আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আমার শিক্ষকদের লাঞ্ছিত করতে পারল, আর আমাকে সেটা এখানে বসে বসে দেখতে হলো!’ তিনি অভিযোগ করেন, উপাচার্যই ছাত্রলীগকে শিক্ষকদের ওপর ‘লেলিয়ে’ দিয়েছেন। অধ্যাপক জাফর ইকবালের হতাশাময় খেদোক্তি গত দুইদিন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী বিবেকবান বাঙালীদের টাইম লাইনের পাতায় পাতায় অতি বেদনার ধিক্কারের সঙ্গে অনুরণিত হয়েছে। আমার শিক্ষকতা জীবন ৪৩ বছরের, যার প্রায় সবটাই যুক্তরাষ্ট্র থেকে শুরু করে বিদেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহে। যে দেশেই শিক্ষকতা করেছি সে দেশের ছাত্র এবং শিক্ষকদের সামনে স্বগর্ভে আমাদের সংস্কৃতিতে গুরুভক্তির শ্রেষ্ঠত্ব তুলে ধরেছি। আমার অগণিত আমাদের উপমহাদেশের ছাত্রছাত্রীরা বিশেষ করে সমাবর্তন অনুষ্ঠানে হাজার হাজার দর্শকের সামনে যখন আমার পা ছুঁয়ে, আমার আশীর্বাদ কামনা করে তখন মিলনায়তনে উপচেপড়া মানুষের করতালিতে আমাদের সংস্কৃতির শ্রেষ্ঠত্ব সমস্ত বিশ্বকে জানান দেয়। আজকে শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে যা ঘটল সেটা শুধু ড. ইয়াসমিন হক এবং অন্য অধ্যাপকদের ওপর তথাকথিত কিছু ছাত্র নামধারীর হামলা নয়, এটা আমাদের বিশ্বনন্দিত গুরুভক্তির ওপর আক্রমণ। রাজনৈতিক বিশ্বাস নির্বিশেষে সমস্ত ছাত্রছাত্রী এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর সময়। টিভি ক্যামেরার সামনে ‘জয় বাংলা’ সেøাগান দিয়ে এ আক্রমণের উদ্দেশ্য আইনকে জানিয়ে দেয় আমরা তোমাদের ‘লম্বা হাতের’ নাগালের বাইরে। প্রধানমন্ত্রী তথা আইনের কাছে চ্যালেঞ্জ মুক্তিযুদ্ধের মরণজয়ী সে ‘জয় বাংলা’ সেøাগান কি আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেয়ার হুঙ্কারে পরিণত হয়েছে? লেখক : কানাডা প্রবাসী অধ্যাপক
×