ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

এখন কোটি গ্রাহকের হাতে

স্মার্টফোনে বদলে গেছে তরুণ প্রজন্মের জীবন, স্বপ্ন

প্রকাশিত: ০৫:২০, ৩ সেপ্টেম্বর ২০১৫

স্মার্টফোনে বদলে গেছে তরুণ প্রজন্মের জীবন, স্বপ্ন

ফিরোজ মান্না ॥ বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া আতিক। হলে থাকে। পড়া লেখায় ভাল। লেখাপড়াই তার ধ্যান-জ্ঞান। লাইব্রেরির বাইরে তার পড়াশোনার আরেকটি ক্ষেত্র সে নিজেই তৈরি করে নিয়েছে। মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান আতিক ভবিষ্যতে সরকারী চাকরি করবে। এ জন্য তাকে তৈরি হতে হবে। জীবনের এই লক্ষ্য নিয়ে এগিয়ে যেতে সম্প্রতি সে একটি স্মার্ট ফোন কিনেছে। এই ফোন শুধু যোগাযোগের জন্য নয়, এটি সে পড়াশোনার কাজে ব্যবহার করছে। কোন্ বই তাকে পড়তে হবে আর কোন্ শব্দটা তাকে জানতে হবে তা মুহূর্তেই ফোন থেকে বের করে নিচ্ছে। মাধ্যম ওয়্যারলেস ইন্টারনেট। বই ডাউনলোড করে পড়তে পারছে সে। বাজার থেকে বেশি টাকায় কিনতে হচ্ছে না তাকে। স্মার্ট ফোনের কল্যাণে আতিকের মতো লাখ লাখ তরুণ-তরুণী আজ প্রকৃত শিক্ষায় শিক্ষিত হচ্ছে। উল্টো দিকে ভিন্ন চিত্রও রয়েছে। স্মার্ট ফোন ব্যবহার হচ্ছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম হিসেবে। আতিকের স্মার্ট ফোন জ্ঞান অর্জনের একটি বড় মাধ্যম হিসেবে কাজ করছে। বন্ধুদের সঙ্গে পড়া-লেখার বিষয়গুলো শেয়ার করা। অজানাকে জানার একটি বড় যন্ত্র নিয়ে আতিকের স্বপ্ন দেখার শেষ নেই। বিশ্বের নানা ঘটনা নানা ইতিহাস এখন তার হাতের মুঠোয়। নিজের জীবন গড়ে নিতে স্মার্ট ফোনের বিকল্প হিসেবে আর কিছু ভাবতে পারছে না সে। গোটা দেশ মোবাইল নেটওয়ার্কের আওতায় আসায় শহর থেকে গ্রামে গেলেও সে তার স্মার্ট ফোনে সব যোগাযোগই রক্ষা করতে পারছে। আতিকের মতো স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীর স্মার্ট ফোনকে শিক্ষার কাজে লাগাছে। দীর্ঘদিন ধরেই তরুণ প্রজন্মের সবার কাছেই মোবাইল ফোন জীবনের অপরিহার্য অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। মোবাইল ফোন ছাড়া তাদের এক মুহূর্তও এখন আর কাটতে চায় না। কথা বলার পাশাপাশি মোবাইল ফোনে বাড়ছে ইন্টারনেট ব্যবহার। এ কারণে দেশে স্মার্ট ফোনের চাহিদা ও ব্যবহার বাড়ছে দ্রুত গতিতে। মোবাইল ফোন ইমপোর্টার্স এ্যাসোসিয়েশনের কর্মকর্তা ফয়সল আলীম বলেন, দেশে এখন প্রায় এক কোটি গ্রাহকের হাতে রয়েছে স্মার্ট ফোন। গত এক বছরে বৈধ পথেই দেশে এসেছে সাড়ে ২৪ লাখ স্মার্ট ফোন। আগামী এক বছরে আসবে আরও ৫০ লাখের বেশি স্মার্ট ফোন। দিন দিন এই ফোনের চাহিদা বাড়ছে। এখন তো খুব কম টাকায় স্মার্ট ফোন পাওয়া যাচ্ছে। আগামী তিন বছরের মধ্যে ৮০ ভাগ মোবাইল ব্যবহারকারীর হাতে চলে যাবে স্মার্ট ফোন। দামও হাতের নাগালে চলে এসেছে। এখন ৪ থেকে সাড়ে হাজার টাকার মধ্যে স্মার্ট ফোন পাওয়া যাচ্ছে। দেশের বিপুল সংখ্যক মানুষ বিদেশে কর্মরত রয়েছে, তারা দেশে আসার সময় একটি স্মার্ট ফোন বা আই ফোন নিয়ে আসেন। তাতেও বিপুলসংখ্যক স্মার্ট ফোন ও আই ফোন দেশে আসছে। তথ্য প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞরা বলেন, মোবাইল ফোন জীবনকে অনেক সহজ করে দিয়েছে। এসএসসি-এইচএসসি পরীক্ষার ফল এখন মোবাইল ফোনে পাওয়া যায়। বিদ্যুত পানির বিল মোবাইলের মাধ্যমে পরিশোধ করা যাচ্ছে। স্কুল-কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি ফরম কিনতে লাইনে দাঁড়াতে হচ্ছে না। মোবাইল ফোনেই সব কাজ শেষ করা যাচ্ছে। চালু হয়েছে মোবাইল ব্যাংকিং। একই সঙ্গে স্মার্ট ফোন তরুণ প্রজম্মকে বিশ্বকে হাতের মুঠোয় তুলে দিয়েছে। স্মার্ট ফোন আর ইন্টারনেটের কল্যাণে তরুণ প্রজন্মের বড় একটি অংশ সুশিক্ষায় শিক্ষিত হচ্ছে। আবার একটি অংশ উচ্ছন্নেও চলে যাচ্ছে। প্রযুক্তির যেমন ভাল দিক রযেছে তেমনি খারাপ দিকও রয়েছে। এখন এটা নির্ভর করে ব্যবহারের ওপরে। তবে তথ্যপ্রযুক্তিবিদ মোস্তফা জব্বার স্মার্ট ফোন ব্যবহার নিয়ে ভিন্ন মত পোষণ করেছেন। তিনি বলেছেন, স্মার্ট ফোন দিয়ে লেখাপড়া করা সম্ভব নয়। কারণ স্মার্ট ফোনের মনিটর ২ থেকে ৪ ইঞ্চি। এত ছোট মনিটরে কোন ছাত্রছাত্রী লেখা করতে পারবে না। লেখাপড়া করতে হলে ন্যূনতম ট্যাব লাগবে। স্মার্ট ফোনেও ছাত্রছাত্রীরা লেখাপড়া করতে পারত যদি সেখানে বাংলাদেশের কনটেন্টগুলো থাকত। বেশিরভাগ কনটেন্ট হচ্ছে বিদেশী। বিদেশী কনটেন্ট থেকে তরুণ প্রজন্ম খুব একটা বেশি কিছু জানতে পারে বলে আমার মনে হয় না। ওই সব কনটেন্ট তৈরি করা হয়েছে ওই সব দেশীয় সংস্কৃতিতে। বাংলাদেশেও এটা করা সম্ভব হতো যদি কর্তৃপক্ষ যথাযথ কাজ করতো। কিছু কনটেন্ট ব্যক্তি উদ্যোগে তৈরি হলেও সরকারী পর্যায়ে এগুলো এখন পর্যন্ত ব্যবহার শুরু করতে পারেনি। অনেক আগে থেকেই এই কনটেন্টগুলো সরকারীভাবে মোবাইল ফোনে স্থাপন করার সুপারিশ করা হয়েছে। অল্প কিছু দিন আগে কিছু কনটেন্ট মোবাইলে প্রতিস্থাপন করা হয়েছে। তাতে যে খুব বেশি কিছু আছে তা মনে করার কারণ নেই। ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় কনটেন্ট তৈরি করা না পর্যন্ত স্মার্ট ফোনে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলো ব্যবহারের মধ্যেই সীমা বদ্ধ থাকবে। এই মুহূর্ত এর বাইরে আমি অনন্ত আর কিছু আশা করতে পারছি না। বিটিআরসি জানিয়েছে, দেশে বর্তমানে মোবাইল ফোনের গ্রাহক সংখ্যা সাড়ে ১২ কোটি ৩ লাখ ছাড়িয়ে গেছে। আর ইন্টারনেটের গ্রাহক সাড়ে ৪ কোটি। ইন্টারনেট গ্রাহকদের মধ্যে ৩ কোটি ৩২ লাখ মানুষ মোবাইল ফোনে ইন্টারনেট ব্যবহার করেন। বাকিরা ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট ব্যবহার করছে। ইন্টারনেটের ব্যবহার দিন দিন বেড়েই চলেছে। আগামী দু-এক বছরের মধ্যে ইন্টারনেটের ব্যবহার দ্বিগুণেরও বেশি হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। সম্প্রতি গবেষণা প্রতিষ্ঠান গার্টনারের এক জরিপে দেখা গেছে, বিশ্বব্যাপী ইন্টারনেট ব্যবহারে সক্ষম যন্ত্রের বিক্রি বহুগুণ বেড়েছে। একই হারে দেশেও ইন্টারনেট ব্যবহারের যন্ত্র বাড়ছে। এর মধ্যে স্মার্ট ফোন, ট্যাব, ল্যাপটব, কম্পিউটার অন্যতম। বর্তমানে টিভিতেও ইন্টারনেট ব্যবহার হচ্ছে। তবে সব কিছুর পরে মোবাইলেই ইন্টারনেট বেশি ব্যবহার হচ্ছে। ডেস্কটপ কম্পিউটারের চেয়ে গ্রাহকদের মূল পচ্ছন্দে পরিণত হয়েছে ইন্টারনেট ব্যবহারের সুবিধাসংবলিত মোবাইল ডিভাইসগুলো। এ ডিভাইসগুলোর অন্যতম স্মার্ট ফোন। মোবাইল ডিভাইসগুলোর বিক্রির পরিমাণ ২০১৩ সালে শতকরা ৫ দশমিক ৯ ভাগ বেড়ে যায়। ২০১৪ সালে তার দ্বিগুণ হয়ে গেছে। এ বছরের হিসাব জানা না গেলেও প্রযুক্তির ব্যবহার সবচেয়ে বেশি হচ্ছে। বিশ্বব্যাপী ইন্টারনেটযুক্ত মোবাইল ডিভাইসের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২শ’ ৩৫ কোটির। মোবাইল ডিভাইসের সংখ্যা বৃদ্ধির পেছনে গ্রাহকদের আগ্রহই বড় ভূমিকা পালন করছে। জরিপে বলা হয়েছে, চলতি বছর প্রচলিত ডেস্কটপ কম্পিউটারের বিক্রি শতকরা ১০ দশমিক ৬ ভাগ কমে যাবে। কারণ এই জায়গাটি দখল করবে স্মার্ট ফোন। সূত্র জানিয়েছে, ১৯৮৯ সালে দক্ষিণ এশিয়ায় প্রথম মোবাইল ফোন আসে বাংলাদেশে। দেশের প্রথম মোবাইল ফোন হচ্ছে সিটিসেল। দেড় লাখ টাকা দামের সেই মোবাইল ফোনে কথা বলতে প্রতি মিনিটে খরচ হতো ৩২ টাকা। অভিজাত ব্যবসায়ী বা সরকারী উর্ধতনরাই তখন এই মোবাইল ফোন ব্যবহার করতেন। মোবাইল সেটটির সাইজও ছিল অনেক বড়। ২০০০ সালে নোকিয়া আর সিমেন্স প্রথম ছোট আকৃতির মোবাইল ফোন বাজারে আনে। সেই বিশাল সেট বদলে মানুষের হাতে আসতে থাকে ছোট আকৃতির ফোন। প্রতিযোগিতায দামও কমতে শুরু করে। ১৯৯৮ সালে গ্রামীণফোন দেশে আসে। এরপরই দ্রুত বদলে যেতে থাকে সবকিছু। আর ২০০৬ সালে মোবাইল ফোনে ডেটা সার্ভিস চালু হয়। তখন থেকেই মোবাইল সেটের দাম কমতে শুরু করে, কমে যায় কল রেটও। এরপর বাজারে আসে কম দামের স্মার্ট ফোন। এই স্মার্ট ফোন বদল করে দিয়েছে গোটা দেশ। মোবাইল ফোন অপারেটরস অব বাংলাদেশের (এমটব) এক কর্মকর্তা বলেন, যে কোন প্রযুক্তির খারাপ ও ভাল দুটো দিকই আছে। এখন এটাকে কিভাবে ব্যবহার করছে সেটাই দেখার বিষয়। মানুষের সঙ্গে তথ্যপ্রযুক্তির সর্বক্ষণিক যোগ সূত্র ঘটিয়েছে মোবাইল ফোন। আর তরুণদেরই যে কোন নতুন প্রযুক্তিই বেশি করে টানে। তাই তরুণরা দ্রুত নতুন প্রযুক্তির সঙ্গে মিশে যেতে পারে। তবে তরুণদের বড় একটি অংশকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেই দিকেই বেশি টানে। একটা সময় তারা সেখান থেকে সরে গিয়ে জ্ঞান অর্জনের দিকেও চলে যায়। শুধু তাই নয়, বারকোর্ড গ্রাহকরা ব্যক্তিগত এ্যাকাউন্ট থেকে কেনাকাটাসহ সব ধরনের ইউটিলিটি বিল পরিশোধ করতে পারছেন। এই কার্যক্রম প্রচলিত মোবাইল ব্যাংকিংয়ের চেয়ে আলাদা। প্রচলিত মোবাইল ব্যাংকিংয়ে এসএমএস কিংবা মোবাইল ইন্টারনেটের মাধ্যমে নির্ধারিত ব্যাংকের এ্যাকাউন্ট ব্যবহার করতে হয়। এই সার্ভিসে তা করতে হয় না। মোবাইল ফোন দেশের মানুষের জীবনযাত্রার মানে নানাভাবে পরিবর্তন এনে দিয়েছে। বিশেষ করে স্মার্ট ফোন গোটা বিশ্বকে হাতের মুঠোয় এনে দিয়েছে। আজকে যা ইউরোপ আমেরিকায় ঘটছে সঙ্গে সঙ্গে তা জানতে পারছে স্মার্ট ফোন গ্রাহকরা। সম্প্রতি প্রকাশিত আন্তর্জাতিক এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, বাংলাদেশের জনজীবনে সর্বাধিক প্রভাব ফেলেছে স্মার্ট ফোন। মোবাইল ফোন প্রযুক্তির পণ্যটি এই মুহূর্তে বিশাল জনগোষ্ঠীর হাতে হাতে রযেছে। টেলিযোগাযোগ নয়, হাতে ধরে রাখা যন্ত্রটি একই সঙ্গে হয়ে উঠে বিনোদন ছবি তোলার যন্ত্র হিসেবে। শোনা যায় রেডিও। একই সঙ্গে অনেক সেবা পাওয়া যাচ্ছে মোবাইল ফোনে। গান শোনা বা ছবি তোলা নয় জানতে পারছেন প্রতিমুহূর্তের গুরুত্বপূর্ণ সব সংবাদ, ফেসবুকে বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়স্বজনদের প্রতিমুহূর্তের খবর পেয়ে যাচ্ছেন। সূত্র জানিয়েছে, স্মার্ট ফোন প্রযুক্তির মূল সুবিধা হচ্ছে সহজে ইন্টারনেট এ্যাকসেস পাওয়া। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও পৌঁছে গেছে ইন্টারনেট প্রযুক্তি। দূর গ্রামাঞ্চল থেকেও বিশ্বকে পেয়ে যাচ্ছে চোখের সামনে। দ্রুত ডেটা আদান প্রদান করতে স্মার্ট ফোনের কোন বিকল্প নেই। দেশের তরুণদের ভেতর স্মার্ট ফোনের জনপ্রিয় হলেও এখন পর্যন্ত বয়স্কদের কাছে এই প্রযুক্তির আগ্রহ তেমন একটা দেখা যাচ্ছে না। যেটা উন্নত দেশে রয়েছে। টেলিকম গবেষকরা মনে করেন, দেশে স্মার্ট ফোন জনপ্রিয় হলেও রাজনীতিক, আমলাসহ বিভিন্ন দফতরের বেশির ভাগই তথ্য প্রযুক্তির বাইরে রয়ে গেছেন। জানা গেছে, ২০১৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশে মোবাইল ফোনের গ্রাহক সংখ্যা ১২ কোটি ৩ লাখ বলে জাতীয় সংসদে জানিয়েছেন ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্য প্রযুক্তি মন্ত্রী। ২০১৫ সালে এ সংখ্যা বেড়ে সাড়ে ১৩ কোটিতে দাঁড়াতে পারে। আর এ বছরই এক কোটি গ্রাহকের টু জি মোবাইল থেকে থ্রিজিতে উন্নতি হবে। এই এক কোটি গ্রাহকই স্মাট ফোন ব্যবহার করবেন।
×