ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

রৌমারীর উপদ্রুত এলাকায় ত্রাণের জন্য হাহাকার

কুড়িগ্রামের বন্যাকবলিত মানুষ খাদ্য ও পানির চরম সঙ্কটে

প্রকাশিত: ০৫:৫৩, ৪ সেপ্টেম্বর ২০১৫

কুড়িগ্রামের বন্যাকবলিত মানুষ খাদ্য ও পানির চরম সঙ্কটে

রাজু মোস্তাফিজ, রৌমারীর বন্যা কবলিত গ্রাম ঘুরে এসে ॥ দুপুর পৌনে ১২টা। রৌমারী ইউনিয়ন পরিষদের সামনে কয়েক শ’ বন্যা কবলিত মানুষ। তারা টানা দু’দিন এক প্রকার উপোস থেকে চেয়ারম্যানের কাছে ছুটে এসেছে ত্রাণ পাবার আশায়। চেয়ারম্যান আবদুর রাজ্জাক এত মানুষ দেখে অসহায় হয়ে পড়েছেন। তিনি কীভাবে এই সামান্য ত্রাণ এত মানুষের মধ্যে বিতরণ করবেন ভেবে পাচ্ছেন না। তিনি জানান, তার ইউনিয়নে প্রায় ৩৪ হাজার মানুষ পানি বন্দী জীবন কাটাচ্ছে। চরম খাদ্য এবং পানির কষ্টে পড়েছে বন্যা কবলিত এসব মানুষ। এবারের বন্যায় দু’কিস্তিতে মাত্র তিন মেট্রিক টন চাল বরাদ্দ পেয়েছেন তিনি। প্রথম দফায় এক মেট্রিক টন চাল বিতরণ করেছেন এক সপÍাহ আগে। দ্বিতীয় কিস্তির ত্রাণের চাল বৃহস্পতিবার অল্প অল্প করে সকলের মাঝে ভাগ করে দিয়েছেন তিনি। ব্রক্ষপুত্র, জিঞ্জরাম ধরনী হলহলিয়া নদীর অববাহিকার কুড়িগ্রাম জেলার দুটি উপজেলা রৌমারী ও রাজিবপুর। দুর্গম এ উপজেলা দুটি কুড়িগ্রাম শহর থেকে ৫০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। উপজেলা দুটির যেদিকে তাকাই শুধু পানি আর পানি। এখানকার অধিকাংশ এলাকা অবিরাম বৃষ্টি আর পাহাড়ী ঢলের পানিতে তলিয়ে গেছে। রৌমারী ইউনিয়নের লোকসংখ্যা ৫৯ হাজার। এখানকার খাটিয়ামারী, নওদাপাড়া, নতুন বন্দর, বেপারীপাড়া, মোল্লাপাড়া, চান্দারচর, বয়তুল্লার চর, চর ইটালুকান্দা, উত্তর ফুলবাড়ী মৌজার গ্রামগুলো বন্যার পানিতে তলিয়ে রয়েছে তিনÑচারদিন ধরে। এখানকার গ্রামীণ সড়ক, কালভার্ট, ধানক্ষেত সব কিছুই পানির নিচে ডুবে আছে। একমাত্র যোগাযোগের মাধ্যম নৌকা আর ভেলা। বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, পানিবন্দী মানুষের দুর্ভোগ যে কতটা ভয়াবহ পর্যায়ে পৌঁছেছে তা চোখে না দেখলে বোঝা যাবে না। শহরের মানুষ দূর থেকে অনুধাবন করতে পারবেন না কী কষ্টের মধ্যে আছেন এসব এলাকার মানুষ। বিরাট এক জনগোষ্ঠী শুকিয়ে কঙ্কালসার হচ্ছে না খেয়ে থাকতে থাকতে। পেটে-পিঠে এক হয়ে যাওয়া মানুষ আহাজারি করছে। এখানকার মানুষগুলো ঘরের চৌকির মাচানের ওপর কর্মহীন জীবন কাটাচ্ছে। এসব মানুষের রান্না করে খাওয়ার মতো অবস্থা নেই। তারা চায় শুধু শুকনা খাবার। কাঁঠালবাড়ী, চাকতোপাড়া, মীর্জাপাড়া, উত্তরফুলবাড়ী গ্রামের ৫ শতাধিক মানুষ গ্রাম ছেড়ে আশ্রয় নিয়েছে বিভিন্ন উঁচু জমিতে এবং বাঁধের ওপর পলিথিন টাঙ্গিয়ে খোলা আকাশের নিচে রাত কাটাচ্ছে। জিঞ্জিরাম আরধরনীর নদীর তীব্র স্রোতে সুতিরপাড়, ইজলামারী, গাটিয়ামারী, নওদেশপাড়া এলাকার ওয়াপদা বাঁধের বিভিন্ন জায়গায় প্রায় তিন কিলোমিটার এলাকা ভেঙ্গে গিয়ে প্রবল স্র্রোতে পানি ঢুকে গ্রামের পর গ্রাম প্লাবিত হচ্ছে। রৌমারী ইউনিয়েনের চেয়ারম্যান আরও জানান, প্রতিদিন বন্যা কবলিত মানুষ সকাল থেকে মধ্য রাত পর্য়ন্ত এ ভিড় করে। তারা শুধু খাবার চায়। পাশের ইউনিয়ন শোলমারী। এখানকার গ্রামগুলো হচ্ছে চর বোয়ালমারী, চরেরগ্রাম, নতুন শোলমারী, গয়টাপাড়া, চেংটাপাড়া, পাতারগ্রাম, সবুজপাড়া, চাতলাকান্দা, বেহুলারচর, মাঝিপাড়া, ভুনকির চর। এখানকার ৩০ গ্রামের মধ্যে ১৬ গ্রামের ২৮ হাজার মানুষ পানিবন্দী জীবন কাটাচ্ছে। লাউবাড়ি গ্রামের আনিসুল (৭) পানিতে ডুবে মারা গেছে। ঘর-বাড়িতে পানি ওঠায় চেংটাপাড়া, সবুজপাড়া, নতুন শোলমারী এবং ঝাউবাড়ি গ্রামের মানুষ গয়াটাপাড়া বিওপি ক্যাম্পে এবং বিভিন্ন রাস্তায় দুই থেকে তিন হাজার মানুষ খোলা আকাশের নিচে পলিথিন টাঙ্গিয়ে মানবেতর জীবন কাটাচ্ছে। গয়াটাপাড়ার আসমত (৪৫), খিজির উদ্দিন ফকির (৬৫) নতুন শোলমারী গ্রামের মোবারক হোসেন (৪৫), মোসলেমা (৪৬), মহিমা খাতুন (৩৮) জানান, ৫দিন থেকে তাদের বাড়িতে এক কোমর পানি। তারা ঘরের মাচানের ওপর বসবাস করছে। বন্যার কারণে এ অঞ্চলের পুরুষরা কর্মহীন জীবনযাপন করছে। ধার-দেনা করে কোনমতে জীবনটাকে বাঁচিয়ে রেখেছে। তাদের অনেকেই কোন সরকারী ত্রাণ পায়নি। শোলমারী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান মিঠু জানান, মাত্র দুই মেট্রিক টন চাল বরাদ্দ পেয়েছি। এখন এই সামান্য ত্রাণ নিয়ে গেলে বন্যাকবলিত মানুষরা ছিনতাই করে নিয়ে যাবে। চরম অবস্থায় দিন কাটাচ্ছি। জিঞ্জিরাম নদীর পানির তীব্র স্রোতে চাতলা কান্দর ডাসবাংলা ব্রীজ এবং ম-লপাড়ার ৪০ মিটার পাকা রাস্তা ভেঙে গেছে। দ্রুত ত্রাণ বরাদ্দের দাবি জানান তিনি। উপজেলার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা শঙ্কর কুমার বিশ্বাস জানান, ছ’টি ইউনিয়নের বেশির ভাগ জায়গা বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে। মানুষ খাদ্য সঙ্কটে পড়েছে। তিনি বলেন, এখন পর্যাপ্ত ত্রাণ দরকার বন্যাকবলিত গ্রামগুলোতে। এ পর্যন্ত ২৫ মেট্রিক টন চাল এবং ২০ হাজার টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। যা প্রয়োজনের তুলনায় খুব কম। তবে আমরা জেলা প্রশাসককে জানিয়েছি যে, আমাদের আরও ত্রাণ দরকার ।
×