ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

ব্যয় ৩শ’ কোটি

যমুনার ভাঙ্গন রোধে তীর সংরক্ষণ প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে

প্রকাশিত: ০৬:০২, ৫ সেপ্টেম্বর ২০১৫

যমুনার ভাঙ্গন রোধে তীর সংরক্ষণ প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে

সমুদ্র হক ॥ ভাঙ্গন প্রতিরোধে যমুনাকে বশে আনতে ৩শ’ কোটি টাকারও বেশি ব্যয়ে নদীর তীর সংরক্ষণের ৬ কিলোমিটার দীর্ঘ একটি বড় প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে। গেল মাসের শেষে জাতীয় অর্থনৈতিক কমিটির অর্থনৈতিক কাউন্সিলের (একনেক) সর্বশেষ বৈঠকে প্রকল্পটি অনুমোদিত হয়েছে। চলতি অর্থবছরেই যমুনা তীরের সারিয়াকান্দিতে বৃহৎ এই প্রকল্পের কাজ শুরু হবে। প্রসঙ্গত তীব্র ভাঙ্গনপ্রবণ যমুনা তীর ভেঙ্গে ক্রমেই পশ্চিমে সরে বাঙ্গালীর কাছে গিয়েছে। দুই নদী একত্রিত হলে ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি হয়ে ভূমিকম্পের বিপর্যয়ের মতোই হবে। প্রকল্পটি বাস্তবায়িত যমুনা তীরের কয়েক লাখ মানুষ তাদের বসতভিটা জমি জিরাত এলাকার অবকাঠামো রক্ষা পাবে। উল্লেখ করা যায় বগুড়ার সারিয়াকান্দি ও সিরাজগঞ্জ এলাকায় ১৯৯৮ সালে ভাঙ্গন রোধ ও বন্যা নিয়ন্ত্রণে ৫শ’ ৮৫ কোটি টাকা ব্যয়ে হার্ড পয়েন্ট ও প্রায় ৩ কিলোমিটার দীর্ঘ রিভেটমেন্ট নির্মিত হয়। পরবর্তী সময়ে ভাঙ্গন রোধ ও নিয়ন্ত্রণ না হলে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে ডিজাইনে ত্রুটি মেলে। বলা হয়, যমুনা একমাত্র নদী যার আচরণ বোঝা যায় না। মেয়েদের চুলের বেণীর মতো এঁকেবেঁকে চলা এই নদীকে বশে এনে ভাঙ্গন প্রতিরোধে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে বগুড়া-১ আসনের সংসদ সদস্য মোঃ আব্দুল মান্নান ক’বছর ধরে তীর সংরক্ষণের নক্সাবিদ সেটেলাইট ইমেজ প্রকৌশলীদের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক করে বিষয়টি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দৃষ্টিতে এনেছেন। প্রধানমন্ত্রী নিজেও এই অঞ্চল সম্পর্কে অবহিত থাকায় প্রকল্পটি অগ্রাধিকার পেয়ে অনুমোদিত হয়েছে। এই সময়টায় সারিয়াকান্দি বন্যাকবলতি। এমন একটি প্রকল্প বাস্তবায়নের খবরে নদী এলাকার মানুষ আশান্বিত হয়েছে। সূত্র জানায়, কয়েকটি গবেষণার ফল নিয়ে নদী তীর সংরক্ষণের এই প্রকল্পটি এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে যাতে স্রোতের গতি মাঝপথেই নিয়ন্ত্রিত হয়ে দুর্বল হয়ে পড়ে। যমুনার স্রোত সামন্যতেই ব্যাকফ্লো করে তীব্র গতিতে সম্মুখ পানে যায়। প্রকৌশলীরা সেটেলাইট ইমেজে গভীরতা ও বেড লেভেল (নদী শয্যা) পর্যালোচনা করে নক্সা বানিয়েছেন যাতে মূল জায়গাটিতে প্রোটেকশন দেয়া যায়। এই প্রকল্পে সারিয়াকান্দি উপজেলার কর্নিবাড়ি থেকে চন্দনবাইশা পর্যন্ত ৫ দশমিক ৯০ কিলোমিটার দীর্ঘ রিভেটমেন্টের আদলে শক্ত কাঠামো নির্মিত হবে। ব্যয়ের প্রাক্কলন ধরা হয়েছে ৩শ’ ২ কোটি টাকা। দু’বছরের মধ্যেই প্রকল্পের কাজ শেষ হবে। ব্রহ্মপুত্র বন্যা নিয়ন্ত্রণ মূল বাঁধকে সংযুক্ত করে জিও ব্যাগ ও সিসি ব্লক থেকেও উন্নত আধুনিক নির্মাণ শৈলীতে তীর সংরক্ষণ করা হবে। পূর্বের রিভার ব্যাংক প্রোটেকশন প্রজেক্টের (আরবিপিপি) ভুল-ত্রুটিগুলো চিহ্নিত ও বিশ্লেষণ করে প্রকল্প সফলের কাঠামো তৈরি করা হয়েছে যাতে ভাঙ্গন প্রতিরোধ চিরস্থায়ী হয়। এই প্রকল্পের কাজ শুরুর আগে ভূমি অধিগ্রহণ করা হবে। তবে ভূমি অধিগ্রহণে যাতে বেশি ক্ষতি না হয় সে বিষয়টি লক্ষ্য রাখা হবে। যমুনায় বঙ্গবন্ধু সেতু নির্মাণের সময় ভূমি অধিগ্রহণে ক্ষতিগ্রস্তদের গুচ্ছগ্রাম বানিয়ে যেভাবে পুনর্বাসিত করা হয়েছিল এক্ষেত্রেও প্রয়োজনে সে ব্যবস্থা করা হবে। তবে ক্ষতিগ্রস্তরা যাতে উপযুক্ত মূল্য পায় সেদিকেই আগে দৃষ্টি দেয়া হবে। সূত্র জানায়, দীর্ঘ সময় পর এ অঞ্চলে ভাঙ্গন প্রতিরোধে এটাই বড় প্রকল্প। এ অঞ্চলে বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও যমুনার ভাঙ্গন প্রতিরোধে ষাটের দশক থেকেই একের পর এক প্রকল্প হাতে নেয়া হয়। পঞ্চাশের দশকে প্রথমে ব্রিটিশ ক্রুগ মিশন জরিপ করে রিপোর্ট দেয়। তা বাস্তবায়িত হয়নি। এরপর ব্রহ্মপুত্রের পশ্চিম তীর বরাবর উজানের রংপুরের কাউনিয়া থেকে ভাঁটির পাবনার বেড়া পর্যন্ত ২শ’ ২০ কিলোমিটার মাটির বাঁধ নির্মিত হয়। স্থানীয়ভাবে তা ওয়াপদা (তৎকালীন ওয়াটার এ্যান্ড পাওয়ার ডেভেলপমেন্ট অথিরিটি) বাঁধ নামে পরিচিতি পায়। আজও প্রবীণরা এই নামেই ডাকে। মূল এই বাঁধ ভাঙ্গতে ভাঙ্গতে এমন পর্যায়ে এসেছে যে সেদিনের সেই বাঁধের অস্তিত্ব চেনা কঠিন। একের পর এক রিং বাঁধ, নতুন বাঁধ, স্পারসহ নানা কাঠামো তৈরি হয়ে সবই বিফলে যায়। যমুনাকে নিয়ন্ত্রণ করাই যায় না। এদিকে নদী ভাঙ্গনের থাবা বেড়ে গিয়ে এমনই অবস্থা বসতভিটা জমি-জিরাত হারিয়ে কত যে গৃহস্থ ও বড় কৃষক দিনমজুরে পরিণত হয়েছে তার হিসেব নেই। নিত্য বছর গ্রাম-গঞ্জ অবকাঠামো ফসলের মাঠ যমুনা গর্ভে যাচ্ছে। ভিটে হারিয়ে কত মানুষ আশ্রয় নিচ্ছে ভিন গাঁয়ে। হয়ে পড়ছে ভূমিহীন বাস্তুহারা। এদিকে যমুনা ক্রমেই পশ্চিমের দিকে সরে আসছে। যমুনা ও বাঙালী নদীর মধ্যেকার দূরত্ব কমে ক্রমেই সঙ্কুচিত হচ্ছে। কোন কারণে এই দুই নদী একত্রিত হলে এমন ভয়াবহ অবস্থা হবে যে তা সামল দেয়াই কঠিন হয়ে পড়বে। সুদূরপ্রসারী ভাবনায় সবকিছুই বিশ্লেষণ করে বিরাট এক এলাকাকে রক্ষা করতে প্রায় ৩শ’ কোটি টাকার বড় এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে।
×