ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

কিংবদন্তি শিল্পী আব্দুল আলীমের মৃত্যুবার্ষিকীতে শ্রদ্ধাঞ্জলি

প্রকাশিত: ০৬:৪৬, ৫ সেপ্টেম্বর ২০১৫

কিংবদন্তি শিল্পী আব্দুল আলীমের  মৃত্যুবার্ষিকীতে শ্রদ্ধাঞ্জলি

সাজু আহমেদ ॥ বাংলাদেশের লোক সঙ্গীতের প্রাণ পুরুষ, লোক সঙ্গীতের মুকুটবিহীন সম্রাট, মরমী শিল্পী আব্দুল আলীম। স্বাধীনতা যুদ্ধের ৩ বছর পর ১৯৭৪ সালের ৫ সেপ্টেম্বর আজকের দিনে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। আজ তাঁর ৪১তম মৃত্যুবার্ষিকী। বাংলাদেশের লোক সঙ্গীতের উৎকর্ষতায় তার অবদান অবিস্মরণীয়। তবে মৃত্যুর পর অনেকটাই অবহেলার শিকার তিনি। বিশেষ করে আজ তাঁর মৃত্যুবার্ষিকীতে নেই কোন অনুষ্ঠান। বাংলাদেশের সঙ্গীতাঙ্গণে যার এতবড় অবদান স্বাধীনতার ৪০ বছরেই অনেকেই ভুলে গেছে তাকে। অথচ বার্হিবিশ্বে বাংলা গান বিশেষ করে লোকগানকে তিনি পরিচিত করেছেন তার অসাধারণ কণ্ঠ মাধুর্যে। বাংলা গানের প্রবাদপ্রতীম এই শিল্পীকে কেউ সেভাবে মনে রাখেনি। শুধুমাত্র কয়েকটি চ্যানেলে তার গান গাওয়ার মধ্যেই স্মরণ করা তাকে। তাও পুত্রকন্যা ছাড়া আর কাউকে ঠিক সেভাবে তাঁর গান গাইতেও দেখা যায় না। এ অবস্থায় বাংলা গানের কিংবদন্তী এই শিল্পীর ৪১তম মৃত্যুবাষির্কীতে শ্রদ্ধাঞ্জলি। ভারতের পশ্চিম বঙ্গের মুর্শিদাবাদের তালিবপুর গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে ১৯৩১ সালের ২৭ জুলাই জন্ম গ্রহণ করেন সঙ্গীত প্রতিভা আব্দুল আলীম। তাঁর বাবার নাম মোহাম্মদ ইউসুফ আলী। বাল্যকাল থেকেই আব্দুল আলীম সঙ্গীতের প্রবল অনুরাগী ছিলেন। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ার সময় গ্রামোফোন রেকর্ডে গান শুনে গান গাওয়ার জন্য আগ্রহ জন্মে। ছোটবেলায় তাঁর সঙ্গীত গুরু ছিলেন সৈয়দ গোলাম আলী। অল্প বয়স হতেই বাংলার লোক সঙ্গীতের এই অমর শিল্পী গান গেয়ে নাম করেছিলেন। আর বিভিন্ন পালা পার্বণে সেগুলো গাইতেন। এভাবে পালা পার্বণে গান গেয়ে তিনি বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করেন। মাত্র তেরো বছর বয়সে ১৯৪৩ সালে তাঁর গানের প্রথম রেকর্ড হয়। রেকর্ডকৃত গান দুটি হলো ‘তোর মোস্তফাকে দে না মাগো’ এবং ‘আফতাব আলী বসলো পথে’। এতো অল্প বয়সে গান রেকর্ড হওয়া সত্যিই বিস্ময়কর। অবশ্য পরে তা আর বিস্ময় হয়ে থাকেনি, তিনি হয়ে উঠেছিলেন বাংলার লোক সঙ্গীতের এক অবিসংবাদিত কিংবদন্তি পুরুষ। বাংলা লোক সঙ্গীতের এই অমর শিল্পী লোক সঙ্গীতকে অবিশ্বাস্য এক উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিলেন যেখানে জীবন জগৎ এবং ভাববাদী চিন্তা একাকার হয়ে গিয়েছিল । পরবর্তীকালে তিনি কলকাতায় যান এবং সেখানে আব্বাসউদ্দিন ও কাজী নজরুল ইসলামের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হয়ে গান করেছেন। দেশ ভাগের পরে আব্দুল আলীম ঢাকায় চলে আসেন এবং রেডিওতে স্টাফ আর্টিস্ট হিসেবে গান গাইতে শুরু করেন। তিনি লোক ও শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের ওপর দীক্ষা নিয়েছেন বেদার উদ্দিন আহমেদ, ওস্তাদ মোহাম্মদ খসরু, মমতাজ আলী খান, আব্দুল লতিফ, কানাই লাল শীল, আব্দুল হালিম চৌধুরী প্রমুখের কাছে। লেটো দলে, যাত্রা দলে কাজ করেছেন। পরবর্তীতে তিনি কবি জসিমউদ্দিন, কানাইলাল শীল, এম ওসমান খান, আব্দুল লাতিফ, শমশের আলীর সংস্পর্শে এসে গান করেন। পরে টেলিভিশন সেন্টার চালু হলে সেখানেও তিনি সঙ্গীত পরিবেশন শুরু করেন। এছাড়াও তৎকালীন বাংলাদেশের প্রথম চলচ্চিত্র ‘মুখ ও মুখোশ’ সহ বিভিন্ন বাংলা চলচ্চিত্রে আব্দুল আলীম গান করেছেন। আব্দুল আলীমের উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্র হলো ‘লালন ফকির’। আব্দুল আলীম তাঁর আধ্যাত্মিক ও মরমী মুর্শিদী গানের জন্য অমর হয়ে থাকবেন। পেশাগত জীবনে আবদুল আলীম ছিলেন ঢাকা সঙ্গীত কলেজের লোকগীতি বিভাগের অধ্যাপক। প্রতিভাধর এই শিল্পী বিদেশে যেখানেই গেছেন সেখান থেকে সঙ্গীত পরিবেশন করে দেশের জন্য সম্মান বয়ে নিয়ে এসেছেন। বিশেষ করে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের সাংস্কৃতিক দলের সদস্য হয়ে ১৯৬৪ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং ১৯৬৬ সালে চীন সফর করেন। এই দুই দেশেও তিনি সুখ্যাতি অর্জন করেন। বিদেশে বাংলাদেশের লোকসঙ্গীতের মান বৃদ্ধি করার ক্ষেত্রে শিল্পী আবদুল আলীমের অবদান অনস্বীকার্য। বলতে গেলে, আবদুল আলীমই বিদেশে আমাদের লোকসঙ্গীতকে পরিচিত করেছেন। শিল্পী বাংলাদেশ টেলিভিশন ও রেডিও ছাড়া দেশের বিভিন্ন চলচ্চিত্রে অসংখ্য গানে কণ্ঠ দিয়েছেন। তিনি প্রথম প্লেব্যাক গায়ক হিসেবে কণ্ঠ দেন তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের প্রথম চলচ্চিত্র মুখ ও মুখোশ-এ। এ পর্যন্ত শিল্পীর ৫০০ গান রেকর্ড হয়েছে, এছাড়াও স্টুডিও রেকর্ডেও অসংখ্য গান আছে। সঙ্গীতে বিশেষ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ আব্দুল আলীম বেশ কয়েকটি জাতীয় পুরস্কার পেয়েছেন; এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য একুশে পদক, পূর্বাণী চলচ্চিত্র পুরস্কার এবং বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সাংবাদিক সমিতি পুরস্কার। পাকিস্তান মিউজিক কনফারেন্স, লাহোরে সঙ্গীত পরিবেশন করে আব্দুল আলীম পাঁচটি স্বর্ণ পদক পেয়েছিলেন। বাংলাদেশ সরকার ১৯৭৭ সালে তাঁকে মরণোত্তর একুশে পদক প্রদান করে সম্মানিত করে। তাঁর অবিস্মরণীয় গানগুলোর মধ্যে ‘যার আপন খবর আপনার হয় না’, ‘নাইয়া রে নায়ের বাদাম তুইলা’, ‘সর্বনাশা পদ্মা নদী’, ‘হলুদিয়া পাখী’, ‘মেঘনার কুলে ঘর বাঁধিলাম’, ‘এই যে দুনিয়া’, ‘দোল দোল দুলনি’, ‘দুয়ারে আইসাছে পালকি’, ‘কেনবা তারে সঁপে দিলাম দেহ মন প্রাণ’, ‘মনে বড় আশা ছিল যাবো মদীনায়’ কেহ করে বেচা কেনা কেহ কান্দে’, ‘সব সখিরে পার করিতে নেব আনা আনা’ প্রভৃতি। প্রসঙ্গত, আব্দুল আলীমের মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে বড় ধরনের কোন অনুষ্ঠান না হলেও বিটিভিসহ দেশের স্যাটেলাইট চ্যানেলগুলো বিশেষ অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে। এর মধ্যে আজ এটিএন বাংলা রাত ৮-৩০ মিনিটে প্রচার করবে বিশেষ সঙ্গীতানুষ্ঠান ‘ও যার আপন খবর’। সেলিম দৌলা খানের পরিচালনায় অনুষ্ঠানে সঙ্গীত পরিবেশন করবেন আব্দুল আলীমের দুই পুত্র জহির আলিম ও আজগর আলিম। অনুষ্ঠানটি উপস্থাপনা করবেন দেশ বরেণ্য গীতিকার মোহামম্মদ রফিকুজ্জামান। এ ছাড়া আব্দুল আলীমের কন্যা নূরজাহান আলীমও একাধিক চ্যানেলে বাবার স্মরণে সঙ্গীত পরিবেশন করবেন বলে জানা গেছে।
×