ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

বেআইনী সিদ্ধান্ত পাল্টাতে বাধ্য হলেন প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহা

প্রকাশিত: ০৫:৩৮, ৭ সেপ্টেম্বর ২০১৫

বেআইনী সিদ্ধান্ত পাল্টাতে বাধ্য হলেন প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহা

স্টাফ রিপোর্টার ॥ সুপ্রীমকোর্টের আপীল বিভাগের বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিকের পেনশন প্রক্রিয়া আটকে দেয়ার বেআইনী সিদ্ধান্ত থেকে অবশেষে সরে এসেছেন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা। গত ২ সেপ্টেম্বর এ সংক্রান্ত একটি চিঠি বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরীকে দেয়া হয়েছে। ওই চিঠিতে প্রধান বিচারপতির নির্দেশিত হয়ে স্বাক্ষর করেছেন সুপ্রীমকোর্টের ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার জেনারেল মোঃ জাকির হোসেন। রবিবার ওই চিঠির একটি অনুলিপি জনকণ্ঠের হাতে এসেছে। ওই চিঠির একটি অংশে বলা হয়েছে, বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী আগামী ১ অক্টোবর অবসর গ্রহণ করবেন। তিনি যেহেতু ব্রিটিশ পাসপোর্টধারী এজন্য প্রধান বিচারপতির মনে সংশয় সৃষ্টি হয়েছে, অবসর গ্রহণের পর অপেক্ষমাণ রায়গুলো না লিখেই বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী যদি বিদেশে চলে যান, তাহলে অপেক্ষমাণ মামলাসমূহের রায় লেখার ক্ষেত্রে জটিলতা সৃষ্টি হবে। বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিকের পেনশন সংক্রান্ত আবেদন যথারীতি প্রক্রিয়াকরণ করা হবে বলেও চিঠিতে উল্লেখ করা হয়। এর আগে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিকের পেনশন প্রক্রিয়ার ওপর বিধি নিষেধ আরোপের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন, যা গত ২৫ আগস্ট একটি চিঠির মাধ্যমে তাকে অবহিত করা হয়। প্রধান বিচারপতির নির্দেশে ওই চিঠিতে স্বাক্ষর করেন সুপ্রীমকোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল সৈয়দ আমিনুল ইসলাম। ওই চিঠিতে বলা হয়েছে, প্রধান বিচারপতির নির্দেশিত হয়ে জানানো যাচ্ছে যে, আপনার নিকট (বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরীর মানিক) নিষ্পত্তিকৃত মামলার (হাইকোর্ট ও আপীল বিভাগ) অপেক্ষমাণ রায় স্বাক্ষর না হওয়া পর্যন্ত আপনার পেনশন সংক্রান্ত কোন পদক্ষের গ্রহণ করা যাবে না। পরে গত ৩১ আগস্ট বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী ওই চিঠির জবাবে প্রধান বিচারপতিকে একটি চিঠি দেন, যেখানে তার পেনশন প্রক্রিয়া স্থগিত করার সিদ্ধান্তকে বেআইনী, অসাংবিধানিক ও বৈষম্যমূলক বলে দাবি করেন তিনি। এ ধরনের কাজ প্রধান বিচারপতি শপথ ভঙ্গে শামিল বলেও বিচারপতি মানিক চিঠিতে উল্লেখ করেন। বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক ওই চিঠিতে আরও বলেন, আমার কাছে হাইকোর্ট বিভাগের কোন রায় অপেক্ষমাণ নেই। আপীল বিভাগের বিষয়ে তিনি বলেন, আমি যেদিন অবসরে যাব সেদিনও অনেক মামলায় রায় দিতে হবে। শেষ দিনেও ওইসব রায় অপেক্ষমাণ থাকবে। সব রায় শেষ করে অবসরে যাওয়া কোন বিচারপতির পক্ষেই সম্ভব নয়। তিনি বলেন, এর আগে যেসকল বিচারপতিগণ অবসরে গিয়েছেন, তাদের সকলের কাছেও অনেক অপেক্ষমাণ রায় ছিল। তারা অবসরের পরেও ওইসব রায় লিখেছেন। অপেক্ষমাণ রায় থাকার কারণে এর আগে কোন বিচারপতিরই পেনশন প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হয়নি। ওই চিঠিতে বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী আরও বলেন, যেহেতু শেষ কর্মদিবসেও একজন বিচারপতি মামলায় সিদ্ধান্ত দেন, রায় লেখার জন্য একজন বিচারপতিকে অনেক গবেষণামূলক কাজ করতে হয়, অনেক লেখাপড়া করে একটি রায় লিখতে হয়, সেহেতু একজন বিচারপতির অবসরে যাওয়ার পরও রায় অপেক্ষমাণ থাকবে এটাই স্বভাবিক। কারণ বিচারপতি কোন জাদুর চেরাগ দ্বারা রায় লেখেন না। স্বাভাবিক কারণেই একজন বিচারপতির রায় লিখতে সময় প্রয়োজন হয়। যা সকল বিচারপতির ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। তিনি চিঠিতে বলেন, এর আগে সকল বিচারপতিদের মতোই বর্তমান প্রধান বিচারপতিও তার শেষ কর্মদিবসে অনেক মামলার রায় দিবেন, শেষ কর্মদিবসে পরেও নিশ্চিতভাবে তার কাছে অনেক মামলার রায় অপেক্ষমাণ থাকবে। বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী আরও বলেন, বর্তমান প্রধান বিচারপতির কাছেও কয়েক মাস ধরে বেশ কয়েকটি মামলার রায় স্বাক্ষরের জন্য অপেক্ষমাণ রয়েছে এবং সেটাই স্বাভাবিক। তিনি আরও বলেন, বিচারপতিরা বিচার কার্জ চলাকালীন সময়ে কোর্টে বসে কোন রায় লেখেন না। ফলে সকল বিচারপতিকেই কোর্টের সময়ের পরে এবং ছুটির দিনেই রায় লিখতে হয়। এর আগে যে সকল বিচারপতিগণ অবসরে গিয়েছেন, তারাও অপেক্ষমাণ রায় লিখা শেষ করার সময় পর্যন্ত অফিস স্টাফসহ সকল সুযোগ-সুবিধা পেয়েছেন। বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী তার জবাবে সর্বশেষ অবসরে যাওয়া প্রধান বিচারপতি মোঃ মোজাম্মেল হোসেনসহ কয়েকজনের নজির উল্লেখ করেন। চিঠিতে তিনি বলেন, যারা অবসরে গিয়েছেন তাঁরা সকলেই রায় লেখার জন্য পর্যাপ্ত সময় নিয়েছেন, অনেকে দুই থেকে তিন বছর পর্যন্ত সময় নিয়েছেন। তিনি বলেন, সদ্য অবসরে যাওয়া প্রধান বিচারপতি মোঃ মোজাম্মেল হোসেন গত আট মাস ধরে তাঁর অপেক্ষমাণ রায়গুলো এখনও লিখছেন। এ জন্য তিনি অফিসসহ সকল সুযোগ-সুবিধাও পাচ্ছেন। সাবেক প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক অবসরে গিয়েছিলেন ২০১১ সালের ১৭ মে। তাঁর সব রায় শেষ করতে অনেক লেগেছিল। তাঁর পেনশন প্রসেস করতেও কোন বাধা দেয়া হয়নি। সাবেক প্রধান বিচারপতি মোঃ তোফাজ্জল ইসলাম অবসরে গিয়েছিলেন ২০১০ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি। তিনি তাঁর রায় শেষ করেছেন কয়েক মাস আগে। তারও তো পেনশন আটকে যায়নি। বিচারপতি মমতাজ উদ্দিন আহমেদ, সাবেক প্রধান বিচারপতি ফজলুল করিম, বিচারপতি শামসুল হুদা, বিচারপতি সৈয়দ আমিরুল ইসলাসসহ সকলেই অবসরে পরেও রায় লিখেছেন। তাঁদেরও পেনশন প্রসেস হতে কোন সমস্যা হয়নি। বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরীর ওই চিঠিতে দেখা গেছে, চিঠির অনুলিপি রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, আইনমন্ত্রী এবং সুপ্রীমকোর্টের উভয় বিভাগের (হাইকোর্ট বিভাগ ও আপীল বিভাগ) বিচারপতিদের দেয়া হয়েছে। জানা গেছে, বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরীর ওই চিঠির বিষয়ে গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশের পর প্রধান বিচারপতির এই বেআইনী সিদ্ধান্ত নিয়ে বিভিন্ন মহলে প্রতিক্রিয়া ও গুঞ্জনের সৃষ্টি হয়। পরে প্রধান বিচারপতি তার ওই বৈষম্যমূলক ও অসাংবিধানিক সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করতে বাধ্য হন, যা গত ২ সেপ্টেম্বর এক চিঠির মাধ্যমে বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিককে জানানো হয়।
×