ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

দু’দশক পর জলাশয়ই থাকবে না রাজধানীতে

দখলের থাবা

প্রকাশিত: ০৬:০৫, ৯ সেপ্টেম্বর ২০১৫

দখলের থাবা

রাজন ভট্টাচার্য ॥ ‘খালের নাম বাসাবো খাল, খালের মালিক গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার, তত্ত্বাবধানে -ঢাকা ওয়াসা। ‘ঢাকা মহানগরীর জলাবদ্ধতা সমস্যামুক্ত রাখার জন্য খালের প্রবাহ স্বাভাবিক রাখতে সহযোগিতা করুন। খালের জমির অবৈধ দখল প্রক্রিয়া থেকে নিজে বিরত থাকুন এবং অন্যকে বিরত রাখুন। সরকারী জমিতে ময়লা ফেলানো দ-নীয় অপরাধ। আপনার স্বার্থেই খাল বাঁচিয়ে রাখুন।’ নগরীর সবুজবাগ এলাকার ৫ নম্বর ওয়ার্ডের ওয়াসা রোডের খালে এরকম বেশ কয়েকটি সাইনবোর্ড ঝুলছে। কিন্তু সাইনবোর্ডের নির্দেশনা কেউ মানছে না। খাল রক্ষায় কারও তৎপরতাও নেই। এখানে খাল দখলের মহোৎসব চলছে রীতিমতো। ইচ্ছেমতো খালের জায়গায় করা হচ্ছে অসংখ্য স্থায়ী অস্থায়ী স্থাপনা। স্থানীয়রা জানিয়েছেন, দখলবাজদের উৎসাহিত করতে অর্ধেকের বেশি জায়গা ছেড়ে খালের জমিতে সীমানা প্রাচীর করেছে ওয়াসা কর্তৃপক্ষ। তাতেও শেষ রক্ষা হচ্ছে না। ময়লা আবর্জনায় খালের স্মৃতি চিহ্ন পর্যন্ত এখন বোঝা যায় না। সংশ্লিষ্টরা নির্দেশনা টানিয়েই খালাস। রক্ষণাবেক্ষণের দায় যেন কারও নেই। সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন উঠেছে- খালগুলো দেখভালের দায়িত্ব আসলে কার? কদমতলার অভয় বিনোদিনী স্কুলের পাশের স্থানীয় বাসিন্দা মনির হোসেন জানান, ৩০ বছরের বেশি সময় আগে খালের পরিধি ছিল বর্তমানের চেয়ে তিনগুণ। ২০০৫ সালের পর কদমতলা ব্রিজ থেকে মুগদার ভেতরের রাস্তাটি করা হয়েছে খালের জমিতে। এরপর খালের জায়গা নিজেদের ইচ্ছেমতো দখল করেছে স্থানীয় বাসিন্দারা। কেউ খালের জমিতে বাড়ি, দোকানসহ বিভিন্ন স্থাপনা করেছে। ইচ্ছেমতো ফেলা হচ্ছে ময়লা আবর্জনা। এক পর্যায়ে পরিস্থিতি বেগতিক দেখে খালের দু’পাশে কিছু অংশে সীমানা প্রাচীর দেয়া হয়েছে। ওয়াসা রোডের আরেক বাসিন্দা বিল্লাল জানান, ২০০১ সালের দিকে এই এলাকাটি ছিল নিম্নাঞ্চল। দ্রুত খাল ও বিল দখল করে নগরায়ন হয়েছে সবার চোখের সামনে দিয়েই। অথচ তখন কেউ বাধা দেয়নি। এখনও সাইনবোর্ড টানিয়ে রেখেই খালাস। স্থানীয়রা আরও জানিয়েছেন, প্রায় তিন বছর আগে উন্নয়ন কাজের নাম করে কদমতলা ব্রিজের নিচে মাটি ফেলে খালের নদী প্রবাহ বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। মাটিতে ঘর তুলে বসবাস করত শ্রমিকরা। দীর্ঘদিন এই অবস্থা চলার সুযোগে নিয়ে খালের জমি দখল করেছে প্রভাবশালীরা। এই খালের একটু সামনেই মা-া খাল। মদিনাবাগের একাংশের ভেতর দিয়ে মা-ার দিকে প্রবাহিত হয়েছে এই খালটি। খালের ওপর অসংখ্য ভবন। কোথাও পিলার। কোথাও ভবনে ওঠার সিঁড়ি বা পাটাতনের রাস্তা করা হয়েছে। মা-া ব্রিজের ডানপাশের অংশে খালটির চিত্র আরও করুণ। খালের জমি দখল করেই পাড় দিয়ে রাস্তা করা হয়েছে। ময়লা আবর্জনায় ঢাকা পুরো খালটি। এমন চিত্র ঢাকার সব খাল থেকে শুরু করে জলাশয়গুলোর! সিটি করপোরেশন ও ওয়াসা সূত্রে জানা গেছে, বাসাবো খাল যা ৬০ ফুট ছিল এক সময়ে। এখন রয়েছে ২৫ ফুটেরও কম। বেগুনবাড়ী খাল, মহাখালী খাল যেখানে ৬০ ফুটের পরিবর্তে রয়েছে ৩০ ফুট মাত্র। রামচন্দ্রপুর খালে ১১০ ফুটের পরিবর্তে আছে ৬০ ফুট। দ্বিগুণ খালে ২০০ ফুটের পরিবর্তে আছে ১৫০ ফুট। আবদুল্লাহপুর খালে ১০০ ফুটের পরিবর্তে আছে ৬৫ ফুট এবং কল্যাণপুর খালে ১২০ ফুটের পরিবর্তে রয়েছে ৬০ ফুট। এছাড়া রয়েছে গুলশান, বনানী, কাটাসুর, ইব্রাহিমপুর, বাউনিয়া, দিয়াবাড়ী, শাহজাদপুর খাল। এগুলোর অস্তিত্ব থাকলেও খালগুলো এখন ভূমিদস্যু ও দখলদারদের কারণে সঙ্কুচিত হয়ে যাচ্ছে। হারিয়ে যাওয়া খাল সম্পর্কে ওয়াসা সূত্র জানায়, কল্যাণপুর শাখা খাল-গ, বাইশটেকি, হাউজিং, পরীবাগ, রাজারবাগ, হাজারীবাগ, চরকামরাঙ্গীচর, সেগুনবাগিচা, আরামবাগ, গোপীবাগ, শাহজাহানপুর, খিলগাঁও-বাসাবো, দক্ষিণগাঁও-নজীপাড়া, রাজারবাগ-কান্দিপাড়া, মুতিতোলা, বাউশার, গোবিন্দপুর ও ডুমরি খালের অস্তিত্ব এখন বিলীন বললেই চলে। সেগুনবাগিচা থেকে মানিকনগর পর্যন্ত ৩ দশমিক ৮৮ কিলোমিটার দীর্ঘ সেগুনবাগিচা খালের অস্তিত্ব এখন দৃশ্যমান হয় না। ধানম-ি খালের অস্তিত্ব এখন বিলীন প্রায়। এক দশমিক ৭ কিলোমিটার দীর্ঘ পরীবাগ খালের অবস্থাও একই রকম। গোপীবাগ খালের ওপর নির্মিত হয়েছে রাস্তা। ভরাট হয়ে গেছে রূপনগর খাল, পলাশনগর বাউনিয়া খাল, কালশী খাল, বাইশটেকি খাল, দুয়ারীপাড়া খাল। এসব খালের ওপর নির্মিত হয়েছে বিভিন্ন হাউজিং কোম্পানির বিল্ডিং। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাজধানীতে বর্তমানে জলাভূমির পরিমাণ ১০ ভাগ। বিগত ৩৫ বছরে জলাশয় কমেছে অন্তত ৩৪ ভাগ। সব মিলিয়ে সাড়ে তিন দশকে হারিয়ে গেছে ঢাকার ১০ হাজার হেক্টর বা ৫০ শতাংশের বেশি জলাভূমি, খাল ও নিম্নাঞ্চল। তিন দশক আগেও রাজধানী ঢাকা ও আশপাশে খাল ছিল ৬৪টি। এর মধ্যে বর্তমানে অস্তিত্ব আছে মাত্র সর্বোচ্চ সাতটির। এ সময়ের ব্যবধানে নিম্নভূমি কমেছে ৫৪ দশমিক ১৮ ও নদী-খাল ৬৫ দশমিক ৪৫ শতাংশ। ৩০ বছরে হারিয়ে গেছে নগরীর প্রায় দুই হাজার পুকুর। ভূমিদস্যুদের আগ্রাসনে ডোবা ও বিলের কোন অস্তিত নেই। দখলে, দূষণে ঢাকার চারপাশের চার নদী এখন মৃতপ্রায়। নদীর চারপাশজুড়ে দখলের স্মৃতিচিহ্ন। মোট রাস্তা ও ফুটপাথের অর্ধেক দখলে। আড়াই হাজার কিলোমিটার ড্রেনের প্রায় অর্ধেকই ভরাট। ঢাকার বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে থাকা নিম্নভূমি তথা প্লাবনভূমিগুলোর অস্তিত্ব এখন খুঁজে পাওয়াই কঠিন। সব মিলিয়ে গোটা রাজধানীতেই দখলের থাবা। একারণেই জলাবদ্ধতা সঙ্কট দিন দিন বাড়ছে। পাল্লা দিয়ে বাড়ছে নাগরিক নানা সঙ্কট। এমন বাস্তবতায় ২০৩৫ সালে রাজধানীতে জলাশয়ের কোন অস্তিত্ব পাওয়া যাবে না। বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য, জলাবদ্ধতা থেকে মুক্তি পেতে হলে নদী-খাল-ড্রেন দখলমুক্ত ও পরিষ্কার করে নাব্যতা ফিরিয়ে আনতে হবে। পুকুর, ডোবাসহ দখল হওয়া সরকারী সকল জলাভূমি উদ্ধার করার বিকল্প নেই। নাব্যতা বাড়াতে হবে সব নদীর। ড্রেনগুলোর পরিধি আরও বাড়াতে হবে। রাস্তায় নির্মাণ সামগ্রী রেখে ড্রেন ভরাটকারীদের বিরুদ্ধে নিতে হবে কঠোর ব্যবস্থা। কোন অবস্থাতেই এলাকার উচ্চতা বাড়ানো যাবে না। পাশাপাশি কঠোর আইন প্রয়োগের বিকল্প নেই। এজন্য সরকারের সদিচ্ছার পাশাপাশি রাজনৈতিক অঙ্গীকার জরুরী বলেও মনে করেন তারা। বিশিষ্ট পরিবেশ বিজ্ঞানী ও বুয়েটের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. মাফিজুর রহমান জনকণ্ঠকে বলেন, রাজধানীতে এখন ১০ ভাগও জলাশয় নেই। উন্নয়ন বৈষমের কারণে দিন দিন রাজধানীতে মানুষ বাড়ছে। পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ভুক্তভোগী মানুষের সংখ্যাও। তাই অন্যান্য জেলার সঙ্গে রাজধানীর উন্নয়ন বৈষম্য কমিয়ে আনার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, পানি সব সময় উপর থেকে নিচে নেমে আসে। তাই পানি প্রবাহ মাধ্যমগুলো নিচু করতে হবে। সবার আগে নদীকে পানি ধারণের ক্ষমতা বাড়াতে হবে। এরপর খাল, পরবর্তীতে ড্রেনের পানি ধারণের ক্ষমতা বাড়ানোর বিকল্প নেই। একটি পরিকল্পিত নগরীর জন্য ২৫ ভাগ জলাশয় থাকা স্বাভাবিক একথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, প্রাকৃতিকভাবে পানি চলাচলের ব্যবস্থা ঢাকায় নেই। গোটা নগরীকে একটি বালতিতে পরিণত করা হয়েছে। তাই পানি প্রবাহের ব্যবস্থা করা জরুরী। নগরীর পূর্বদিকে এখনও কোন বাঁধ দেয়া হয়নি। তাই এই অঞ্চলে পানির স্বাভাবিক গতি প্রবাহ ঠিক রাখতে করণীয় সবই নিশ্চিত করার সুযোগ আছে বলে মনে করেন এই বিশেষজ্ঞ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রায় ১৫ বছর আগেও ৩০০ মিলিমিটার বৃষ্টিতে ঢাকা ডুবত না। এখন প্রায় ৮০ মিলিমিটার বৃষ্টিতে গোটা শহর খালে পরিণত হয়। খাল, জলাশয়, দখলসহ নদী হারিয়ে যাওয়াই জলাবদ্ধতার মূল কারণ। তাছাড়া ঢাকার ড্রেনেজ সিস্টেমের সঙ্গে ১৪টি প্রতিষ্ঠান জড়িত থাকলেও ২/১টি ছাড়া ড্রেন সংরক্ষণে কেউ কাজ করে না। ওয়াসার ৩৬০ কিলোমিটার ও সিটি করপোরেশনের দুই হাজার কিলোমিটার ড্রেন রয়েছে। যার প্রায় অর্ধেক রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে দখল থাকে। জলাবদ্ধতা, দখল ও সঙ্কট সমাধান প্রসঙ্গে পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের চেয়ারম্যান আবু নাসের খান জনকণ্ঠকে বলেন, রাজধানীর ৪৩টি খালের মধ্যে সর্বোচ্চ ৭টি খালের অস্তিত্ব এখন আছে। যা মোটেও কারও কাম্য ছিল না। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন উন্নয়ন ফান্ডের টাকায় রাজধানী উন্নয়নের কাজ করার না করার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, প্রথমেই আমাদের নিজ উদ্যোগে সঙ্কট নিরসনের মানসিকতা তৈরি করতে হবে। জনঘনত্ব ও সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাতের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে সঙ্কট নিরসনের উদ্যোগ নিতে হবে সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে। ড্রেনেজ সিস্টেমকে উন্নত করার পাশাপাশি খাল ও নদী দখলমুক্ত করার পরামর্শ দেন তিনি। দখলে চলে গেছে ঢাকার পুকুর ॥ ৩০ বছরের ঢাকা শহরের দুই হাজার পুকুর ভরাট হয়ে গেছে। এগুলোর প্রায় সবই গেছে দখলদারদের পেটে। সেসব পুকুরের কোন তথ্য নেই ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনের কাছে। এছাড়া বর্তমানে ঢাকা শহরে পুকুরের সংখ্যা কত তার সঠিক হিসাব নেই কর্পোরেশনে। সংস্থার সম্পত্তি বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, তাদের মালিকানাধীন কোন পুকুর নেই। যদিও দুই সিটি করপোরেশনের কিছু পুকুর এখন রয়েছে। পুকুরগুলো হচ্ছে- মহানগর নাট্যমঞ্চ পুকুর, গুলিস্তান পুকুর, ওসমানী উদ্যান পুকুর ও ধোলাইখাল পুকুর। উত্তর সিটি করপোরেশনের পুকুর হচ্ছে- উত্তরার ট্যাংকপাড়া পুকুর। নাম প্রকাশ না করার শর্তে ডিএসসিসির সম্পত্তি বিভাগের সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ২০-২৫ বছর আগে সিটি করপোরেশনের শতাধিক পুকুর ছিল। দখল আর ভরাটের কারণেই পুকুরগুলো এখন খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। এদিকে ২০১১ সালের শুরুর দিকে অবিভক্ত ঢাকা সিটি করপোরেশনের ১০টি অঞ্চলে পুকুর ও ঝিলের মোট পরিমাণ ছিল ৫ হাজার ১শ’ ৪২ বিঘা। সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর অবহেলা ও দুর্নীতির কারণে একের পর এক ভরাট ও দখল হয়ে গেছে রাজধানীর এসব পুকুর। এদিকে, মৎস্য অধিদফতরের এক জরিপ থেকে জানা গেছে, ১৯৮৪ ও ১৯৮৫ সালে ঢাকায় পুকুরের সংখ্যা ছিল ২ হাজার। ২০০৮ সালে তা নেমে আসে দু’শতে। দখল ফুটপাথ ॥ নগরীর মোট আয়তন ৩৬০ কিলোমিটারের বেশি। রাস্তা ২ হাজার ২৮৯ কিলোমিটারের কিছু বেশি। ফুটপাথ ১৬৩ কিলোমিটার। মেডিয়ান ২০০ কিলোমিটার। সরকারী-বেসরকারী বিভিন্ন পরিসংখ্যান বলছে, মোট ফুটপাথের অর্ধেকের বেশি দখলে থাকে। রাস্তার ক্ষেত্রে পরিসংখ্যান প্রায় কাছাকাছি। যদিও চলতি বছরের জুন মাসে নগরীর ফুটপাথ ও রাস্তা দখলমুক্ত করার ঘোষণা দিয়েছিলেন সড়ক পরিবহন মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। নির্বাচনের আগে ক্লিন ঢাকা গড়ে তোলার প্রতিশ্রুতি ছিল নবনির্বাচিত দুই মেয়রের। বাস্তবতা হলো ক্লিন ঢাকা গড়া সম্ভব হয়নি এখনও। দখল উচ্ছেদে ছোট্ট পরিসরে হলেও কাজ শুরু হয়েছে। তবে রাস্তা ও ফুটপাথে দখলবাজরা আছে বহাল তবিয়তে। আগামী বছরের মধ্যে নগরীর প্রতি ওয়ার্ডে ৭০ ভাগ ময়লা আবর্জনা পরিষ্কার থাকার কথা জানিয়েছেন উত্তরের মেয়র আনিসুল হক। নগরীর গুরুত্বপূর্ণ এলাকা বলেই কথা নয়, রাজপথ থেকে অলিগলি পর্যন্ত যেখানেই তাকানো যাবে সেখানেই শুধু দখল আর দখল। ফুটপাথসহ রাস্তা দখল করে হচ্ছে নানা রকমের বাণিজ্য। এ নিয়ে আছে পুলিশ ও ব্যবসায়ীদের মধ্যে পরস্পরবিরোধী বক্তব্য। পুলিশ বলছে, রাজনৈতিক কারণে এ সব সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। দখলকারীদের বক্তব্য, পুলিশকে টাকা দিয়েই ফুটপাথে ব্যবসা করেন তাঁরা। ফুটপাথ আর রাস্তা দখলের কারণে যানজটের মাত্রা কমিয়ে আনা সম্ভব হচ্ছে না। তেমনি জলাবদ্ধতারও নিরসন হচ্ছে না। বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য, জলজট ও যানজটমুক্ত নগরী গড়ে তুলতে রাস্তা-ফুটপাথ দখলমুক্ত রাখার বিকল্প কিছু নেই। ঢাকা ওয়াসার ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার কামরুল আলম চৌধুরী (অপারেশন) এক গবেষণায় বলছেন, ৩০ বছরে ঢাকা উন্নয়নের সঙ্গে ড্রেনেজ পদ্ধতি মানানসই নয়। তাছাড়া চলমান ড্রেনগুলো ময়লা আবর্জনায় পূর্ণ থাকা, রাস্তার পাশে নির্মাণসামগ্রী রাখার কারণেও ড্রেন ভরাট হচ্ছে। সঙ্গত কারণেই পানি প্রবাহ কমছে দিন দিন। জলাবদ্ধতা কমাতে দ্রুত খালগুলো উদ্ধারের পরামর্শ দেন তিনি। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের গবেষণা ॥ মাত্র তিন দশক আগেও রাজধানীর ঢাকা ও আশপাশে ৬৪টি খাল ছিল। এর মধ্যে বর্তমানে ৬/৭টির অস্তিত্ব থাকলেও ক্রমশ তা ভরাট হচ্ছে। কোনটি এরই মধ্যে সরু নালায় পরিণত হয়েছে। জলাভূমিগুলোর অবস্থাও একই। আর ঢাকার বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে থাকা নিচুভূমি তথা প্লাবনভূমিগুলোর অস্তিত্বই পাওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে। সব মিলিয়ে সাড়ে তিন দশকে ১০ হাজার হেক্টরের বেশি জলাভূমি, খাল ও নিম্নাঞ্চল হারিয়ে গেছে। ইনস্টিটিউট অব ওয়াটার মডেলিংয়ের (আইডব্লিউএম) সমীক্ষায় উঠে এসেছে রাজধানীর বিভিন্ন জলাভূমি, নিচুভূমি ও খাল হারিয়ে যাওয়ার চিত্র। এতে বলা হয়, ১৯৭৮ সালে ঢাকা ও আশপাশে বিভিন্ন এলাকায় জলাভূমির পরিমাণ ছিল দুই হাজার ৯৫২ হেক্টর ও নিচুভূমি ১৩ হাজার ৫২৮ হেক্টর। সে সময় ঢাকা ও আশপাশে খাল ও নদী ছিল দুই হাজার ৯০০ হেক্টর। ফলে বৃষ্টির পানি চলে যেত রাজধানীর চারপাশে ছড়িয়ে থাকা খাল ও এরপর নদীতে। ২০১৪ সালে ঢাকা ও আশপাশে জলাভূমি কমে দাঁড়িয়েছে এক হাজার ৯৩৫ হেক্টর। নিচুভূমি ছয় হাজার ১৯৮ হেক্টর এবং নদী-খাল ১ হাজার ২ হেক্টর। অর্থাৎ ৩৫ বছরে জলাশয় কমেছে যথাক্রমে ৩৪ দশমিক ৪৫, ৫৪ দশমিক ১৮ ও ৬৫ দশমিক ৪৫ শতাংশ। এ প্রবণতা অব্যাহত থাকলে ২০৩১ সাল নাগাদ ঢাকায় জলাশয় ও নিচুভূমির মোট পরিমাণ এর আয়তনের ১০ শতাংশের নিচে নেমে যাবে বলে আশঙ্কা করা যায়। পানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক আইনুন নিশাত সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে বলেন, পানি নিষ্কাশন এলাকা হিসেবে চিহ্নিত ঢাকার উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের বাড্ডা, সাঁতারকুল, খিলক্ষেত, রামপুরা, দক্ষিণখান ও উত্তরখানের বেশির ভাগ এলাকা একসময় জলাভূমি ও নিম্নাঞ্চল ছিল। গত এক যুগে এসব জলাভূমি ও নিম্নাঞ্চলের ৯০ শতাংশ ভরাট হয়ে গেছে। মোহাম্মদপুর ও গুলশান আবাসিক এলাকায় কংক্রিটের আচ্ছাদন নেই, এমন এলাকা মাত্র ৪ শতাংশ। এজন্য অপরিকল্পিত নগরায়ন যেমন দায়ী, একইভাবে দায়ী সরকারের বিভিন্ন সংস্থার সমন্বয়হীনতা ও অবহেলা। এ অবস্থা চলতে থাকলে ঢাকার জলাবদ্ধতা কমানো সম্ভব হবে না। ২০৩৫ সালের মধ্যে জলাশয় হারিয়ে যাবার আশঙ্কা ॥ ঢাকাকে বিশ্বের দ্বিতীয় শীর্ষ বন্যাপ্রবণ শহর হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে ‘বাংলাদেশ আরবান রেজিলিয়েন্স প্রজেক্ট : এনভায়রনমেন্টাল ম্যানেজমেন্ট ফ্রেমওয়ার্ক’ শীর্ষক প্রতিবেদনে। তাতে বলা হয়েছে, বন্যাপ্রবণ শহর হিসেবে চীনের সাংহাইয়ের পরই ঢাকার অবস্থান। সরকারের কয়েকটি মন্ত্রণালয়ের অধীন পরিচালিত এ সংক্রান্ত সমীক্ষায় ঢাকার বিভিন্ন সমস্যাও উঠে এসেছে। ঢাকার জন্য অন্যতম প্রধান ঝুঁকি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে বন্যা ও ড্রেনেজ ব্যবস্থার স্বল্পতাকে। ফলে চারপাশে নদীবেষ্টিত হওয়ার পরও ঢাকায় কয়েক দফা বড় ধরনের বন্যা দেখা দেয়। বুয়েটের নগর অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক ইশরাত ইসলামের পিএইচডি গবেষণায় বলা হয়েছে, রাজধানীতে যেভাবে নগরায়ন হচ্ছে তাতে ২০৩৫ সালের মধ্যে জলাশয় নামে কোন স্থান থাকবে না। ২০১২ সালে জলাভূমির পরিমাণ কমেছে বছরে আড়াই হাজার হেক্টর। এখন জলাভূমির পরিমাণ মোট ভূমির মাত্র ১০ শতাংশ।
×