সংসদ রিপোর্টার ॥ প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ নেতা শেখ হাসিনা বিএনপি-জামায়াতসহ কিছু অপশক্তি ব্যক্তিস্বার্থে দেশবিরোধী ষড়যন্ত্রে লিপ্ত এমন অভিযোগ করে বলেছেন, শুধু খুনী-যুদ্ধাপরাধীই নয়, এসব ষড়যন্ত্রকারীরও বিচার একদিন বাংলার মাটিতে হবে। আমি জাতির পিতার মেয়ে। আমি দেশের মানুষের জন্য রাজনীতি করি। দেশের মানুষের মাথা হেট হয় এমন কোন কাজ জীবন থাকতে কাউকে করতে দেব না। ভবিষ্যতে আর কেউ দেশের মানুষের ক্ষতি করতে পারবে না। আমি জীবনের পরোয়া করি না। জীবনবাজি রেখে মানুষের কল্যাণে রাজনীতি করছি বলেই দেশ আজ সবদিক থেকে এগিয়ে যাচ্ছে, এগিয়ে যাবে। দেশের এই অগ্রযাত্রা কেউ রুখতে পারবে না।
বুধবার ডেপুটি স্পীকার এ্যাডভোকেট ফজলে রাব্বি মিয়ার সভাপতিত্বে সংসদে প্রধানমন্ত্রীর জন্য নির্ধারিত ৩০ মিনিটের প্রশ্নোত্তর পর্বে একাধিক সম্পূরক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নাম উল্লেখ না করে বলেন, পরাশক্তি নয়, বরং দেশের ভেতরের কিছু অপশক্তি বাংলাদেশের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালায়। এরা ঘরের শত্রু বিভীষণ। কোন একজন ব্যক্তি কেবল একটি পদের জন্য অর্থাৎ মামলা করে ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা (এমডি) পদ ফেরত না পেয়ে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণœ করছেন। এদের কাছে দেশের মানুষ, শ্রমিক, মেহনতি মানুষের কোন মূল্য নেই, তাদের কথা চিন্তা করে না। শুধু ব্যক্তিস্বার্থের কারণে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণœ করে, দেশের মানুষের ক্ষতি করে।
জিএসপি সুবিধা স্থগিতের জন্য বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া ও জামায়াতে ইসলামীকেও দায়ী করে শেখ হাসিনা বলেন, বিএনপি-জামায়াত বিপুল অর্থ ব্যয় করে লবিষ্ট নিয়োগ করে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশবিরোধী অপপ্রচার চালাচ্ছে, এদের অপপ্রচারের কারণেই জিএসপি সুবিধা বন্ধ হয়েছে। এ ধরনের কিছু দালাল ছাড়া বাংলাদেশের মানুষ কারও কাছে মাথানত করে না উল্লেখ করে তিনি বলেন, শুধু ব্যক্তিস্বার্থে খালেদা জিয়া যিনি এক সময়ে প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, বিরোধী দলের নেতাও ছিলেন। এখন তিনি এর কিছুই নন। সেই বিএনপি নেত্রীও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে চিঠি দিয়ে, যুক্তরাষ্ট্রের একটি অখ্যাত পত্রিকায় আর্টিকেল লিখে জিএসপি সুবিধার বিরোধিতা করেছেন।
জিএসপি সুবিধা স্থগিতের পরও বাংলাদেশ থেমে থাকেনি উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, দেশের ভেতরে থাকা ঘরের শত্রু বিভীষণদের বিরোধিতার কারণে জিএসপি সুবিধা স্থগিত হয়েছে, এটা বাংলাদেশের ভাবমূর্তির জন্য ক্ষতিকর। তবে বাংলাদেশ নতুন নতুন বাজার খুঁজে পাচ্ছে। রফতানিও করে যাচ্ছে। হয়ত আমরা আরও অনেক বেশি ভাল করতাম। কিন্তু জিএসপি বন্ধ করে আমাদের থামিয়ে রাখতে পারেনি। আমাদের বিনিয়োগ ও রফতানি বৃদ্ধি পেয়েছে। দেশ এগিয়ে যাচ্ছে, এগিয়ে যাবেই। কেউ এই অগ্রযাত্রা রুখতে পারবে না।
এসব ষড়যন্ত্রকারীর বিচার সংক্রান্ত সরকারী দলের সংসদ সদস্য কামাল আহমেদ মজুমদারের সম্পূরক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এদের বিচারের ভার এদেশের জনগণের। দেশের মানুষই এদের বিচার করবে। তবে আমরা বঙ্গবন্ধুর খুনীদের বিচার করেছি। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু করেছি, রায়ও কার্যকর হচ্ছে। এই বিচারের সময় বিশ্বের অনেক বড় বড় হোমড়া-চোমড়ারাও ফোন করেছেন, যেন রায় কার্যকর না হয়। অনেক ভাল কাজে ফোন না পেলেও এ কাজে ফোন পেয়েছি। তবে আমারও ন্যায়-অন্যায় বোধ রয়েছে। একাত্তরে গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী কাজের জন্য যুদ্ধাপরাধীদের অবশ্যই বিচার হবে। মানবতাবিরোধীদের বিচার চলছে, চলবে। এই বিচার কেউ ঠেকাতে পারবে না।
মিথ্যা জন্মদিন পালন করে খালেদা জিয়া খুনীদের উৎসাহিত করেন ॥ প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশের ইতিহাস থেকে জাতির পিতার নাম মুছে ফেলার জন্য বহু ষড়যন্ত্র হয়েছে। ইতিহাস বিকৃত করা হয়েছে। ১৯৭৫ সালের পর যারা জন্ম নিয়েছিল যারা ছোট্ট ছিল তারা ভুল ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়ে বড় হয়েছে। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর প্রকৃত ইতিহাস তুলে ধরার ফলে তারা সেই ভ্রান্তি ভুলে যেতে বসেছে। ধীরে ধীরে এটা ভুলে যাবে। এবার ১৫ আগস্ট যে ব্যাপকভাবে উদযাপন হয়েছে এটা অভূতপূর্ব। এতেই বোঝা যায় বঙ্গবন্ধু দেশের মানুষের হৃদয়ের মনের মণিকোঠায় ঠাঁই করে নিয়েছেন। আর কোন চক্রান্তই শুধু দেশ নয়, পৃথিবীর কোথাও থেকে বঙ্গবন্ধুর নাম মুছে ফেলতে পারবে না।
১৫ আগস্ট মিথ্যা জন্মদিন পালন করায় বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়ার কঠোর সমালোচনা করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ১৫ আগস্ট কারও জন্মদিন হতে পারে, এদিন জন্মদিন হবে না সেটা তো না, কিন্তু যার জন্মদিন না, তিনি রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় থেকে মিথ্যা জন্ম দিন ঘোষণা দিয়ে, বিশাল বিশাল কেক যত বয়স তত বড় কেক কেটে উৎসবে পরিণত করে অর্থাৎ খুনীদের উৎসাহিত করা, খুনকে, হত্যাকে স্বীকৃতি দেয়ার মতো তাঁর (খালেদা জিয়া) বিকৃত মানিসকতাও দেখছি। তিনি বলেন, এখনও তিনি এসব করে যাচ্ছেন, কোন পরিবর্তন হয়নি। তবে সময়ের বিবর্তনে এসব অবশ্যই মুছে যাবে।
সরকারী দলের আবদুল মতিন খসরু, উপাধ্যক্ষ আবদুস শহীদ এবং স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য ডাঃ রুস্তম আলী ফরাজীর পৃথক পৃথক সম্পূরক প্রশ্নের জবাবে সংসদ নেতা আরও বলেন, মিথ্যা জন্মদিনের বিষয়ে দেশের মানুষ আজ বুঝতে পেরেছে। এ ধরনের ঘটনাকে সাধারণ মানুষ ধিক্কার দিচ্ছে। তিনি বলেন, ব্যক্তিকে হত্যা করা যায় আদর্শকে হত্যা করা যায় না। জাতির পিতাকে শুধু হত্যা নয়, হত্যা করে তার নাম মুছে ফেলে ইতিহাস বিকৃত করে মানুষের মন থেকে মুছে ফেলার চেষ্টা হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, একসময় জাতির পিতার নাম-ছবি সবই নিষিদ্ধ ছিল, কিন্তু সত্যকে কেউ নির্বাসিত করতে পারেনি, সত্যটা উদ্ভাসিত হবেই, হয়েছে। আমরা আইন করতে পারি, আবার সেটা রিপিলও করতে পারি- সেটা হয়েছে। তবে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন দেশবাসীর সচেতনতা, মানুষ যদি সত্যটাকে গ্রহণ করে ধারণ করে, তাহলে নিশ্চয়ই বাংলাদেশের ইতিহাস থেকে জাতির পিতার নাম আর কখনও কেউ মুছে ফেলতে পারবে না।
প্রধানমন্ত্রী নিজের অভিজ্ঞতার বর্ণনা করে বলেন, ’৮১ সালে দেশে ফিরে আসলেও আমাকে ৩২ নম্বরের বাড়িতে মিলাদটুকু করার জন্য প্রবেশ করতে দেয়া হয়নি। বঙ্গবন্ধুর নাম মুছে ফেলতে এমন কোন কাজ নেই যা করা হয়নি। আর আমার জীবনেও এই অভিজ্ঞতা আছে যখন বাংলাদেশের পাঠ্যপুস্তকে বঙ্গবন্ধুর নাম ছিল না, তখন কিন্তু পৃথিবীর অন্য দেশে বাংলাদেশের ইতিহাস পাঠ করা হলেই বঙ্গবন্ধুর নাম থাকত, ছিল। তবে ভবিষ্যতে সেই দুর্দিন আর আসবে না, দেশের মানুষ শোষিত হবে, নির্যাতিত হবে। সেই দিন আর আসবে না। সংবিধানে বঙ্গবন্ধুর নাম আছে তাই নতুন করে আর আইন করা লাগবে না।
৪৯ কিলোমিটার বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত ॥ সংসদ সদস্য মোস্তাফিজুর রহমান চৌধুরীর প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী জানান, সাম্প্রতিক বন্যা ও ঘূর্ণিঝড়ে সারাদেশে ৪৯ কিলোমিটার বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর মধ্যে উপকূলীয় অঞ্চলের প্রায় ৩৪ কিমি এবং সারাদেশে প্রায় ১৫ কিমি। এবারের বন্যায় ৩৪ জেলায় আবাদকৃত বিভিন্ন ফসলের ৩৯ হাজার ১০২ হেক্টর জমির ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
তিনি আরও জানান, ক্ষতিগ্রস্ত বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের মধ্যে আপদকালীন জরুরী কাজের আওতায় ক্ষতিগ্রস্ত ৪ কিলোমিটার বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ও ২০ কিমি বেড়িবাঁধের মেরামত কার্যক্রম হাতে নেয়া হয়েছে। এছাড়া ৪৫ কিমি বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বন্যার পানি নেমে গেলে পরবর্তীতে চূড়ান্ত ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ করে পুনর্বাসন কার্যক্রম হাতে নেয়া হবে।
সরকারী দলের গোলাম দস্তগীর গাজীর অপর এক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী জানান, বন্যাকবলিত জনগণের স্বাস্থ্য সুরক্ষা করার জন্য সারাদেশে জেলা সদর হাসপাতাল ও উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের অধীনে প্রশিক্ষিত চিকিৎসক, প্যারামেডিক্স এবং মাঠকর্মীদের সমন্বয়ে ১ হাজার ১৭৯টি মেডিক্যাল টিম গঠন করা হয়েছে। এছাড়া রিজার্ভ মেডিক্যাল টিম প্রস্তুত রাখা হয়েছে। বন্যা পরবর্তী স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে জেলা সদর হাসপাতাল ও উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ওষুধের বাফার স্টক গঠন করা হয়েছে এবং পর্যাপ্ত পরিমাণ জীবন রক্ষাকারী প্রয়োজনীয় ওষুধসহ পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট, খাবার স্যালাইন ও চিকিৎসা সামগ্রী সরবরাহ করা হয়েছে।
তিনি জানান, বন্যাকবলিত এলাকার পরিস্থিতি সার্বক্ষণিক মনিটরিং করা হচ্ছে। তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, দফতর, পরিদফতর, মিডিয়াসমূহে অবহিত করার লক্ষ্যে স্বাস্থ্য অধিদফতরের ন্যাশনাল হেলথ ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্ট সেন্টার ও কন্ট্রোল রুম ২৪ ঘণ্টা সক্রিয় রয়েছে।