ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

ছয় দশক ধরে অভিনয় করছেন চলচ্চিত্রে এবং মঞ্চে। বয়স আশি পেরিয়েছে গত জানুয়ারীতে। সমান তালে পত্রিকা ;###;সম্পাদনা করেছেন, কবিতা লিখেছেন। ভাল চিত্রশিল্পী এবং সেই সঙ্গে ভাল আবৃত্তিকার। এতো যার গুণ মানুষটি কে? ;###;মানুষটি ওপার বাংলার। তবে, সীমানার কাঁটাতার তাকে

সত্যজিতের অপু

প্রকাশিত: ০৭:০০, ১০ সেপ্টেম্বর ২০১৫

সত্যজিতের অপু

প্রতিভা নাকি সর্বকালে সর্বদেশেই বিরল। উক্তিটি যার তিনি বিখ্যাত চিত্রনির্মাতা সত্যজিৎ রায়। সেই প্রতিভাবান পরিচালক সত্যজিতের সঙ্গে সবচেয়ে বেশি সিনেমায় অভিনয় করেছেন অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। শুক্রবার রাতে নিজের অভিনয় দিয়ে মুগ্ধ করলেন ঢাকার দর্শকদের। এরপর শনিবার সকালে ঢাকার সংস্কৃতিকর্মী এবং সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপচারিতায় মেতে উঠেছিলেন তিনি। শুরুতেই ধন্যবাদ জানালেন সবাইকে এই আড্ডায় আসার জন্য। সৌমিত্রের বাবা ছিলেন পেশায় উকিল, তবে তিনি নাটক ভালবাসতেন এবং নিজে খুব ভাল আবৃত্তি করতে পারতেন। তাই সৌমিত্রের অভিনেতা হওয়ার জন্য পারিবারিক বাধা খুব একটা ছিল না। তাকে একবার সাক্ষাতকারে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল অভিনেতা না হলে কি হতেন? চিত্রশিল্পী? জবাবে কিছুটা বিব্রত হয়ে পড়েছিলেন এই বর্ষীয়ান অভিনেতা। জানান, ছোটবেলা থেকেই আমার কিছু শিল্পী বন্ধুবান্ধব ছিল। নিজেও টুকটাক আঁকাআঁকি করতাম। তবে লোক দেখানোর জন্য আঁকিনি কখনই, মনের খোরাকের জন্য এঁকেছি। আনন্দবাজারে দেয়া এক সাক্ষাতকারে বলেছেন, ‘ সিনেমা জগতের অনেকেই নেই। অনুপকুমার নেই। রবি ঘোষ নেই। এরা আমার বন্ধু ছিলেন। নির্মলকুমার আছেন কিন্তু কাজের মধ্যে নেই। সমসাময়িকদের মধ্যে সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায় এখনও কাজ করে যাচ্ছে। আমার কাছের বন্ধু। প্রযুক্তির ব্যাপার-স্যাপার খুব একটা ভাল বোঝেন না। চারদিকে যখন সোশ্যাল মিডিয়ার তারকাদের সরব উপস্থিতির ছড়াছড়ি তখন সৌমিত্র এসবে খুব একটা অভ্যস্ত নন। নিজের অকপট সরল স্বীকারোক্তি, ‘আমি কম্পিউটার বুঝি না। বোঝার আগ্রহও নেই। জীবনের পড়ন্ত বেলায় আর ওসব শিখে কি হবে? আমি পড়তে এবং লিখতেই ভালবাসি। এতেই জীবন কেটে যাবে। জীবন প্রত্যেকদিনই নতুন করে শুরু হয়। কথা প্রসঙ্গে তিনি জানান, কলকাতায় আসার পর থেকে থিয়েটার দেখতে শুরু করেন। ‘শিশির ভাদুড়ীর অভিনয় দেখেছি আমি। বিখ্যাত এই অভিনেতার অভিনয় দেখে আমার বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হওয়ার মতো অবস্থা। আমি যথেষ্ট ভাগ্যবান ছিলাম। কারণ পরবর্তীতে তিন বছর তাঁর সংস্পর্শে আসার সুযোগ হয়েছিল আমার। আমার অভিনয়ের ভিতটা তিনিই গড়ে দিয়েছিলেন। এরপরে রেডিওতে কিছুদিন কাজ করেন তিনি। সেই প্রসঙ্গে মজার এক ঘটনার কথা বললেন। ‘আমি ছিলাম ঘোষক। আমাকে অপেক্ষা করে বসে থাকতে হতোÑ কখন একটা গান শেষ হবে আর আমি নতুন ঘোষণা দেব। কাজটা ছিল বিরক্তিকর। হাসতে হাসতেই জানালেন তবে এই কাজটি করতে গিয়ে নিজের ধৈর্যশক্তি বেড়ে যায়। যা পরবর্তী জীবনে বেশ কাজে লেগেছে। মাইক্রোফোন ব্যবহার করাটা দারুণভাবে শিখে যাই সেই সময় থেকেই। সিনেমায় অভিনয়ের তৃঞ্চা ছিল তাঁর। সত্যজিৎ রায় তাঁর প্রথম চলচ্চিত্র ‘পথের পাঁচালী’ নির্মাণ করে ফেলেছেন ইতোমধ্যে। তাঁর পরবর্তী সিনেমার জন্য একটি কলেজ পড়ুয়া ছেলের দরকার ছিল। এক বন্ধুর মাধ্যমে সত্যজিতের বাড়িতে গিয়ে দেখা করার প্রস্তাব পেলেন তিনি। তবে, আশাহত করার মতো ব্যাপার হলো, সত্যজিৎ রায় সৌমিত্রকে দেখে বলেছিলেন, ‘এ হে আপনি যে বড্ড বড় হয়ে গেলেন।’ তবে সৌমিত্রকে একবারে বাতিল করে দেননি তিনি। সেদিন মানিক বাবু অনেক কথা বলেছিলেন সৌমিত্রের সঙ্গে। সৌমিত্রের ভাষায়, ‘প্রচুর কথা বললাম তাঁর সঙ্গে। আসলে পরে বুঝেছি আমার কথা বলার ঢং, উচ্চারণ, ব্যক্তিত্ব সবকিছু বুঝে নেয়ার চেষ্টা করছিলেন তিনি।’ সত্যজিৎ তখন একসঙ্গে দুটো ছবি করছেন। জলসাঘর এবং পরশপাথর। সৌমিত্রকে একদিন অভিনয় দেখতে আসতে বললেন। মূলত ক্যামেরার ভীতি কাটিয়ে উঠতেই তাকে আসতে বলা। সেই সময়ের স্মৃতি দারুণ মনে আছে সৌমিত্রের তথা বাংলা সিনেমার অমর চরিত্র অপুর। একদিন ‘জলসাঘর’ সিনেমার শূটিং দেখে সত্যজিৎ রায়কে বললেন, ‘মানিক বাবু আমি কি এবার যাব?’ কোন জবাব না দিয়ে তিনি বললেন, ‘আসুন, ছবি বিশ্বাসের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেই।’ প্রখ্যাত সেই অভিনেতার সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন তিনি। তখনও বুক ধুকপুক করছে। হঠাৎই সত্যজিত রায় ছবি বিশ্বাসকে বললেন, ‘ছবি দা, এই আমার অপুর সংসারের অপু। তখন আমার কি যে অবস্থা বলে বোঝাতে পারব না। এভাবেই সিনেমার শুরু।’ তবে অপুর সংসার মুক্তি পাবার পর দর্শক এক নতুন অভিনেতাকে আবিষ্কার করল। কিন্তু এরপরের পথটা সৌমিত্রর জন্য খুব একটা মসৃণ ছিল না। মানিক বাবু মানে সত্যজিতের সঙ্গে ১৪টি সিনেমায় অভিনয় করেছেন তিনি। সম্পর্কটা কেমন ছিল দুজনের অবধারিতভাবেই এই প্রসঙ্গ উঠে এলো। তিনি বললেন, ‘আসলে প্রতিভার বিপুল পার্থক্য সত্ত্বেও মানিক বাবুর সঙ্গে আমার দারুণ একটা সম্পর্ক হয়েছিল। এই মহান শিল্পীর কাছ থেকে প্রথম পদক্ষেপগুলো শেখার সুযোগ পেয়েছিলাম আমি। দুজনের বোঝাপড়া ভাল ছিল। ফলে তার সঙ্গে কাজ করতে সুবিধে হতো। তিনিও হয়ত কিছু সুবিধা পেয়েছিলেন আমার কাছ থেকে, নইলে আমাকে তার ১৪টা সিনেমায় নেবেন কেন? এই মানুষটির সঙ্গে যে কোনভাবেই হোক আমি থাকতে চেয়েছি। কোন ছবিতে আমি না থাকলেও সে ছবির স্ক্রিপ্ট নিয়ে আমার সঙ্গে কথা বলতেন সত্যজিৎ বাবু।’ শুধুই অভিনেতা নন । সৌমিত্র চট্টোপাধায় একজন কবিও। কবিতার সঙ্গে কিভাবে? এমন প্রশ্নের জবাবে কিছুটা লাজুক হেসে বললেন, কবিতা আসলে আমাকে নিজেকে মেলে ধরার সুযোগ করে দিয়েছিল। স্কুলে পড়ার সময় থেকেই কবিতা লিখতাম। বলতে লজ্জা করছে। কারণ, ওই বয়সে মেয়েদের প্রতি ভাল লাগার একটা ব্যাপার শুরু হয়। তারপর বিশেষ কোন মেয়েকে ভাল লাগার দিন আসে। যার জন্য প্রথম কবিতা লেখা সেই প্রচেষ্টা সফল হয়েছিল বলে জানান এই সদা হাস্য অভিনেতা। নিজে শুধু কবি নন, ভাল এবজন আবৃত্তিকারও বটে। এই প্রসঙ্গে জানালেন, ‘আবৃত্তি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কণ্ঠ দিয়ে আর জিহ্বা দিয়ে কাজ করা তো অভিনেতার প্রথম শর্ত। আমি নিজে রোজ সন্ধ্যায় জোরে জোরে আবৃত্তি ও গান করতাম। এই শিক্ষা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছ থেকে গ্রহণ করেছিলাম।’ অনেকেই হয়তো জানেন না, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় প্রায় তিরিশটির অধিক নাটক লিখেছেন। অবাক করার মতো ব্যাপার আসলেই। অভিনয় করে, কবিতা লিখে এই বয়সে এতো সময় তিনি পান কোথায়? আলাপচারিতা আর আড্ডার একপর্যায়ে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় জানান, পশ্চিমবঙ্গে বাংলাদেশের স্যাটেলাইট চ্যানেলের অনুষ্ঠান সম্প্রচার করা হয় না। এটা আমরা সাংঘাতিকভাবে মিস করি। এ দেশের প্রতি পশ্চিবঙ্গের সাধারণ মানুষের প্রচ- আগ্রহ থাকলেও এ রকম একটি প্রতিবন্ধকতার কারণে আমরা বঞ্চিত হচ্ছি। এর উত্তরণ জরুরী। আড্ডার একদম শেষ পর্যায়ে জানালেন, মানুষের ভালবাসা ছাড়া অভিনয় করা যায় না। বেশ আর্দ্র কণ্ঠেই বললেন, ‘আমি তো এখন অভিনয় ছাড়া আর কিছু ভাবতেই পারি না। একজন অভিনেতাকে চার অক্ষরের একটি শব্দকে আঁকড়ে রাখতে হয়, তা হলো- ভালবাসা। ভালবাসা ছাড়া কিছু হয় না।’ এভাবে নানা বিষয়ে এগিয়ে চলে আলোচনা। শেষ হয় না। শেষ করতে হয়। সবার কাছে আবারও কৃতজ্ঞতা জানিয়ে শেষ করেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়।
×