ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

বেতন বৃদ্ধি ॥ বেসরকারী খাতের লোকজনদের কী হবে?

প্রকাশিত: ০৫:৩১, ১১ সেপ্টেম্বর ২০১৫

বেতন বৃদ্ধি ॥ বেসরকারী খাতের লোকজনদের কী হবে?

ড. আর এম দেবনাথ ॥ সরকারী কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের বেতন বৃদ্ধির ওপর লেখা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। বিষয়টি স্পর্শকাতরও। কারণ এর সঙ্গে অনেকের স্বার্থ, আনুমানিক প্রায় ২০ লাখ লোকের স্বার্থ জড়িত। এর মধ্যে সাধারণ কর্মচারী যেমন আছেন, তেমনি এমন সব কর্মকর্তা যাদের সুনামে সরকার উপকৃত হয় এবং যাদের বদনামে সরকারের বদনাম হয়। অবশ্য বদনামই বেশি হয়। এমতাবস্থায় ঠিক করেছিলাম এই বিষয়ে লিখব না। শেষ পর্যন্ত লিখতেই হচ্ছে একটা বৈপরীত্য দেখে। এই মুহূর্তে দেশের গণ্যমান্য সবাই বলছেন বেসরকারী খাত অনেক দক্ষ, সরকারী খাত কম দক্ষ অথবা দক্ষতাবিহীন। যদি তাই হয় তাহলে সরকারের দক্ষতা বাড়ানো দরকার। সুশাসন কায়েম করা দরকার। দক্ষতা বাড়াতে হলে বেসরকারী খাতের মতোই সরকারী খাতেরও ব্যবহার করা উচিত। অর্থাৎ বেসরকারী খাত যে অবস্থায়, যেভাবে বেতন বাড়ায়, পদোন্নতি দেয়, ভাতা দেয়, ইনক্রিমেন্ট দেয় ঠিক একইভাবে সরকারেরও তা দেয়া উচিত। এমন উদাহরণ কী আছে যে, বেসরকারী খাতের ব্যাংক, বীমা, অ-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠান, বিদেশী কোম্পানি, স্বদেশী কর্পোরেট খাত এক লাফে তাদের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা হরেদরে দ্বিগুণ বৃদ্ধি করেছে? আমার জানা নেই। বেসরকারী খাত বেতন-ভাতা বাড়ায় তার ক্ষমতা অনুসারে। আয় বাড়লে অর্থাৎ প্রফিট বাড়লে সেই অনুপাতে তারা বেতন-ভাতা বাড়ায়। বিক্রয় বাড়লে, মুনাফা বাড়লে সেই হারে তারা বেতন বাড়ায়। বেতন বাড়ানোর যুক্তি খালি মূল্যস্ফীতি নয়। মূল্যস্ফীতি একটা উপাদান। এখন প্রশ্ন সরকারের আয় (রাজস্ব বিয়োগ রাজস্ব ব্যয়) কী দ্বিগুণ বেড়েছে? মূল্যস্ফীতির হিসাব করে আয় কি দ্বিগুণ বেড়েছে? সরকারের মূল পারফরম্যান্স ‘বাজেট ঘাটতি’ কী অর্ধেকে হ্রাস পেয়েছে? আয় বেড়েছে দ্বিগুণ, খরচ বেড়েছে সোয়া দুইগুণ তাহলে কী দাঁড়াল? সরকারের হিসাব যদি ‘প্রফিট এ্যান্ড লস’ ভিত্তিতে করা হতো তাহলে কী দাঁড়াত? এসব অনেক প্রশ্ন। তবু বলি পারলে বেতন তিনগুণ চারগুণ করা হোক। কিন্তু সেই ক্ষমতা কী সরকারের আছে? নেই বলেই তো ধাপে ধাপে বৃদ্ধি। সরকারের সব রাজস্ব যদি বেতন-ভাতা এবং ঋণের ওপর প্রদত্ত সুদ বাবদ খরচ হয় তাহলে তা দেশের কী উপকারে লাগল? সাদামাটা চোখে দেখা যাচ্ছে আমাদের যত বাজেট ঘাটতি ঠিক প্রায় ততটুকুই উন্নয়ন বাজেটের আকার। এর অর্থ আমাদের উন্নয়নের টাকা নেই-বাজেটের আকার যত বড়ই হোক না কেন? দ্বিতীয় আরও বড় প্রশ্ন- আর সেটা ‘পেনশন’ সম্পর্কিত। পেনশন কিন্তু দীর্ঘমেয়াদী দায় এবং দায়টি সরকারের। এই দায় অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীর প্রতি, তার ছেলেমেয়ের প্রতি, শুনতে পাচ্ছি এই দায় হবে নাতির প্রতিও। বেতন-ভাতা বৃদ্ধির অনুষঙ্গ হিসেবে সরকারের বার্ষিক যে পেনশন দায় মাত্রাতিরিক্ত হারে বাড়ছে- তাও কিন্তু হিসাবে রাখতে হবে। বহু দেশে এখন পেনশন একটা বড় সমস্যা। যেমন গ্রীস। পাশের দেশের পশ্চিমবঙ্গের অবস্থাও তাই আমাদের দেশে অবসরপ্রাপ্ত অনেক শিক্ষক, পাটকল শ্রমিক-কর্মকর্তাসহ বহু শ্রেণীপেশার লোক ‘পেনশন’ নিয়মিত না পেয়ে এখনই ভুগছেন। টাকার অভাব তাই নয় কী? মনে হয় সরকারী কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের ব্যাপারেই সরকার বেশি ভাবিত। এরা সংখ্যায় কত? মনে রাখা দরকার বিশ লাখ কর্মচারীর বাইরে দেশে রয়েছে লাখ লাখ বেসরকারী কর্মচারী ও কর্মকর্তা-সংগঠিত খাতে এবং অসংগঠিত খাতে। দোকান, ছোট বড় দোকান, শপিং মল গার্মেন্টস, ছোট ছোট কারখানা, ছোট ছোট অফিস ইত্যাদিতে কাজ করে সরকারী কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি লোক। সংবাদপত্র-টিভি কর্মী আছে হাজার হাজার। প্রশ্ন, এদের কী হবে? একথা জানা এসব খাতের ব্যাপারে দেশে কোন আইন নেই। মালিকরা যথেচ্ছভাবে বেতন ও মজুরি দেয়। পদোন্নতি কখনও হয়, কখনও হয় না। ইনক্রিমেন্ট আবার কী? ভাতা আবার কী? বেসরকারী খাত বলে কথা। তাই সদাশয় সরকার কিছু বলে না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘এমবিএ’ একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরি করে দশ হাজার টাকা বেতন পায় না। বহু সংবাদপত্র আছে যেখানে যোগদান করলে ৫-৬ হাজার টাকা বেতন দেয়া হয়। দোকান-কর্মচারীরা ৪-৬ হাজার টাকা বেতনের চাকরি করে। আমার প্রশ্ন, সকলেরই প্রশ্ন, এদের কী হবে? সরকারী কর্মকর্তা-কর্মচারীরা তো পহেলা বৈশাখে বোনাস পাবেন। খুবই আনন্দের কথা। কিন্তু বেসরকারী খাতের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আনন্দের ব্যবস্থা কী? সরকার কী এসব ব্যাপারে কিছু ভাবছে? আমার জানা নেই। না ভেবে থাকলে ভাবা উচিত। শত হোক মানুষের জীবন তো। এক ঘোষণায় জিনিসপত্রের দাম বেড়ে গেছে। বলা হচ্ছে ব্যবসায়ীদের কারসাজি। এই ব্যবসায়ীরা কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে সরকারেরই লোক। যার লোকই হোক না কেন তারা জিনিসপত্রের দাম বাড়িয়েছে। আবার গ্যাসের দাম, বিদ্যুতের দাম বাড়িয়েছে খোদ সরকারই। এর সরাসরি ফলের কথা বলি। একজন ড্রাইভার আমাকে বলল তার বাড়িওয়ালা এই উভয়ের জন্য বাড়ি ভাড়া বাড়িয়েছে মাসিক হাজার টাকা। বেতন-ভাতা বৃদ্ধি, তেল-গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি এবং ইতোমধ্যে ঘোষিত বিদ্যুত ও গ্যাসের আরও মূল্যবৃদ্ধিÑ সব মিলিয়ে জনজীবনে তার বোঝা কত হবে? বিভিন্ন লোকের হিসাব বিভিন্ন হবে। কিন্তু যার যার হিসাব যার যার। এতে বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তা ও পরিকল্পনা কমিশনের কর্মকর্তারা কী বললেন তাতে কিছু আসে যায় না। মোদ্দাকথা মূল্যচাপ সৃষ্টি হয়েছে। এর ফলে বেসরকারী খাতেও বেতন-ভাতা বৃদ্ধির দাবি উঠবে এবং তা উঠলে এটা হবে ন্যায্য। সরকার এই দাবিকে আশা করি অগ্রাহ্য করবে না। বরং সহনশীলভাবে ঐ খাতেও একটা বৃদ্ধির ব্যবস্থা করবে। কারণ এটা সরকারেরই দায়িত্ব। বেসরকারী খাত বলে দায়িত্ব এড়িয়ে যাওয়া যাবে না। কাগজে দেখছি নানা প্রতিক্রিয়া। ঘুষ-টুসের কথাও উঠেছে। দক্ষতার কথা আগেই বলেছি। অনেকের ধারণা সরকারী কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা দ্বিগুণ হওয়ার ফলে অফিসে ঘুষ লেনদেন কম হবে। কেউ কেউ প্রত্যাশা ব্যক্ত করে বলেছেন যাতে ঘুষ বাণিজ্য বেতনের মতো দ্বিগুণ না হয়। মূল কথা দক্ষতা বৃদ্ধি। সরকারের বেতন-ভাতা বৃদ্ধি, ইনক্রিমেন্ট যে প্রক্রিয়ায় হয় তাতে আমি মনে করি না বেতন বাড়ানোর ফলে দক্ষতা বৃদ্ধি পাবে। আমার বরং ভিন্ন ইস্যু। যখন জোরেশোরে বেসরকারীকরণ শুরু হয় তখন বলা হয়েছিল সরকারের আকার ছোট হবে। কম্পিউটার ব্যবহার এবং আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের ফলে লোকবল অফিসে অফিসে হ্রাস পাওয়ার কথা ছিল। এমন কী জনপ্রশাসনের অনেক কাজ সহজে সমাধা হয় বলে উপরের শ্রেণীর কর্মকর্তার সংখ্যাও হ্রাস পাওয়ার কথা ছিল। ঢাকা শহরে বসে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর পক্ষেই সব উপজেলার সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করা সম্ভব– এটা প্রযুক্তির কারণেই সম্ভব। কিন্তু দেখা যাচ্ছে সচিবের সংখ্যা, অতিরিক্ত সচিব, যুগ্ম সচিবের সংখ্যা বাড়ছেই। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, শিল্প মন্ত্রণালয়ের কাজ কী এখন? সব তো উদারীকরণ করা হয়ে গেছে। সব নিয়ন্ত্রণ করছে ‘ওয়ার্ল্ড ট্রেড অর্গানাইজেশন’। এমতাবস্থায় সরকারের আকার হ্রাস পাওয়ার পরিবর্তে বৃদ্ধি পাচ্ছে কেন? আমার কাছে কোন জবাব নেই। উল্টো বরং দেখা যাচ্ছে সরকারের পর সরকার তাদের এক মেয়াদেই তিনবার করে কর্মকর্তাদের পদোন্নতি দিচ্ছে। নতুন নতুন বেতনক্রম তৈরি হচ্ছে, পদ তৈরি হচ্ছে যার যেখানে ক্ষমতা আছে সেখানেই তিনি ক্ষমতা প্রয়োগ করে জমি নিয়ে নিচ্ছেন, গাড়ি নিয়ে নিচ্ছেন, পদমর্যাদা বৃদ্ধি করে নিচ্ছেন, বেতন বাড়তি নিচ্ছেন। এসব দৃশ্যমান। এই প্রসঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদেরও কথা উঠেছে। বলা হয়েছে দশ বছরে একজন প্রফেসর হয়ে যাচ্ছেন। কথাটা একদম ভুল তা বলা যাবে না। বিশ্ববিদ্যালয়েও দক্ষতার দারুণ অভাব। পদোন্নতির চোরাগোপ্তা পথ আবিষ্কৃত হয়েছে। এক কথায় কী শিক্ষাব্যবস্থা কী প্রশাসনে বিরাজ করছে এক অরাজক ও অদক্ষতার অবস্থা। এটা একদিনে হয়নি। বলা যায় লিগ্যাসি। কিন্তু এর শেষ কোথায়? আমরা আন্তঃক্যাডার, শিক্ষক বনাম প্রশাসক, প্রশাসক বনাম ব্যাংকার। কেন্দ্রীয় ব্যাংকার বনাম বাণিজ্যিক ব্যাংকারের মধ্যে ঝগড়া চাই না। চাই একটা সমতাভিত্তিক, সম্মানভিত্তিক ব্যবস্থা। দোষারোপ করতে হলে এমন কোন সার্ভিস নেই যার বিরুদ্ধে দুটি কেন চারটি কথা বলা যাবে না। এসবে গিয়ে লাভ নেই। দরকার সবকিছুর ওপর রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ। নিয়ন্ত্রণটা অন্যত্র গেলেই হবে সমস্যা। হচ্ছেও তাই। লেখক : ম্যানেজমেন্ট ইকোনমিস্ট ও সাবেক শিক্ষক, ঢাবি
×