ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

শেখ মেহেদী হাসান

শিল্পী শাহাবুদ্দিনের সঙ্গে নৌভ্রমণ

প্রকাশিত: ০৮:৩৬, ১১ সেপ্টেম্বর ২০১৫

শিল্পী শাহাবুদ্দিনের সঙ্গে নৌভ্রমণ

বিশ্বখ্যাত শিল্পী শাহাবুদ্দিন যাবেন গ্রামের বাড়ি। কফিল ভাই আমাকে ফোন দিলেন সঙ্গী হওয়ার। আমি (২৬ ডিসেম্বর ২০১৪) ভোর ছয়টায় পৌঁছলাম কলাবাগান তার বাড়িতে। নিচে দাঁড়িয়ে আছি, এত সকালে ফোন দিতে সাহস পাচ্ছি না। ছয়টা দশ মিনিট তিনিই আমার খবর নিলেন। শীতের সকাল। সবাই রেডি হয়ে নিচে নেমে এলো। তিনটি গাড়ি রেডি। সাড়ে ছয়টায় আমাদের যাত্রা। হঠাৎ জানতে পারলাম, একজনের স্থান সংকুলান হচ্ছে না। কফিল ভাই গাড়ি থেকে নেমে তাকে স্যরি বললেন এবং প্রতিশ্রুতি দিলেন আগামীতে তাকে সঙ্গে নেবেন। খুব খুশি হলাম তার আচরণে। নিউমার্কেট, ইত্তেফাকের মোড় পেরিয়ে আমাদের গাড়ি চলল নরসিংদী অভিমুখে। হানিফ ফ্লাইওভার হওয়াতে ঢাকার জ্যামটা টের পাওয়া গেল না। মাধবদি বাজার, ভেলানগর পেরিয়ে গাড়ি থামল নীলকুঠি। রাস্তার সঙ্গে দু-তিনটি দোকান। সেখানে চা বিরতি। তারপর আবার যাত্রাÑ রেললাইন পেরিয়ে শাপমারা সবশেষে আলগি বাজার। নীলকুঠি থেকে এক ঘণ্টার পথ। আলগি বাজারে পৌঁছানো মাত্রই শুরু হলো শাহাবুদ্দিন উৎসব। কত শত পরিচিত জন এসে তাকে ঘিরে ধরল। কাউকে জড়িয়ে আলিঙ্গন করছেন। কারও কাঁধে হাত রেখে হাঁটছেন। এক অভূতপূর্ব দৃশ্য। মানুষের ঢল পেরিয়ে গেলাম মুক্তিযোদ্ধা তায়েব উদ্দিন আহমেদ উচ্চ বিদ্যালয়ে। ২০১১ সালে বাবার নামে স্কুলটি প্রতিষ্ঠা করেছেন শিল্পী শাহাবুদ্দিন। সবুজ মাঠের ভিতর অবস্থিত সুন্দর এই স্কুল। আমরা পৌঁছানো মাত্র ছাত্র-শিক্ষক ফুল দিয়ে বরণ করলেন। জল-খাবারের ব্যবস্থা ছিল। শাহাবুদ্দিন ভাইয়ের কনিষ্ঠ খোকা ভাই, প্রামাণ্যচিত্র নির্মাতা তানভীর এবং আমি মাঠের এক কোণে ইউক্যালিপটাসের নিচে দাঁড়ালাম। পাশেই মেঘনা নদী। নিরিবিলি জায়গা। মেঘনা পাড়ের বাতাস। কিছুক্ষণের মধ্যে গ্রামের কয়েকশ’ মানুষ স্কুলের মাঠে হাজির। সবাইকে শীতের কম্বল বিতরণ করলেন শিল্পী শাহাবুদ্দিন। কেউ কেউ খুশিতে তার গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। এক বৃদ্ধা তার নাতির জন্য দ্বিতীয় কম্বল চাইল। তাকেও দিলেন বাড়তি একটি। ওই বৃদ্ধা অঝরে কাঁদলেন। দু’জন সাংবাদিক এসে তার সাক্ষাতকার নিল। স্কুলের আনুষ্ঠানিকতা শেষ হলো ছাত্রদের সঙ্গে ক্রিকেট খেলে। ভাইও শিক্ষার্থীদের সঙ্গে খেললেন। খেলা শেষে হলুদ সরিষা ক্ষেত পেরিয়ে মসজিদের গা ঘেঁষে গেলাম তার গ্রামের বাড়ি। মেঘনার পাড়েই বাড়ি। নদীর ঘাটে চমৎকার উঠোন। দুটো কবর আছে। আমরা জনা কয়েক দাঁড়িয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করলাম। মৌলবী দোয়া পড়ালেন। এরপর ডাবের পানি, মিষ্টি খেলাম। ততক্ষণে মাঝি ডাক দিল ট্রলার রেডি। আমরা নৌভ্রমণে বেরুলাম মেঘনায়। ঠা-া বাতাস আর মেঘনার ঢেউয়ের ঝাপটি এসে লাগল আমাদের নৌকায়। অনেকক্ষণ নৌকা চলে বাঁক ঘুরল। শাহাবুদ্দিন ভাই ট্রলারের ছাদে বসে মুক্তিযুদ্ধের গল্প বললেন। ১৯৭১ কোন স্মৃতিই বিস্মৃত হওয়ার নয়। আমাদের দুুপুরের নিমন্ত্রণ ছিল শাহাবুদ্দিন ভাইয়ের মামার বাড়ি। তারা বার বার কফিল ভাইকে ফোন করছেন। কিছুক্ষণ নৌভ্রমণ শেষে চলে আসি আলগি বাজারে। আরেক দফা মানুষের জটলা। সবাই আন্তরিক ভালোবাসায় শিল্পীকে অভিবাদন জানাচ্ছেন। এতে বিঘœ হচ্ছিল বাজারের নিত্য কর্মকা-। তাতে কিচ্ছু যায় আসে না। উপস্থিত সবাইকে বিদায় জানিয়ে আমরা গাড়িতে উঠলাম। দেড় ঘণ্টায় পৌঁছল মামার বাড়ি। তখন সন্ধ্যা সাতটা। চর্যা সবার মধ্যে খাবার বিতরণ করল। সে খেতে বসল সবার শেষে। শ্রদ্ধেয় আনা ইসলাম এবং শাহাবুদ্দিন ভাইয়ের যোগ্য কন্যা। জš§ প্যারিসে হলেও চর্যা বাঙালীর মূল্যবোধ ধারণ করেছে গভীরভাবে। আত্মীয়দের সঙ্গে সাক্ষাৎ শেষে নয়টায় রওনা হলাম ঢাকার উদ্দেশ্যে। আমরা শিল্পী শাহাবুদ্দিনের কলাবাগানের পাঁচ তলার ছাদে উঠলে এক টুকরো আকাশ দেখি, বাংলাদেশের আকাশ। কফিল ভাইয়ের লাগানো শৌখিন করমচা, কাগজি লেবু, আমড়া, আমসহ বাহারি ফুলের গাছ। ছায়া আর রোদ্দুর খেলা করে। অকস্মাৎ নেমে আসে সন্ধ্যা। আমাদের প্রিয় শিল্পী ইজেলে ক্যানভাস ফেলে চলে আসেন টেনিসের টেবিলে। ডিমের মতো বল নিয়ে দৌড়ায় ফারদিন, শ্রাবণ। কখনও তার খেলার সঙ্গী হয় হান্নান, সবুজ, শাহীন কিংবা কবি ওসমান। খেলা শেষে জমে ওঠে সান্ধ্য আড্ডা। শ্রদ্ধেয় অধ্যাপক আবদুল মান্নান, অধ্যাপক মঈনুদ্দীন খালেদ, অধ্যাপক নিসার হোসেন, শিল্পী মনিরুজ্জামান অনেকেই যোগ দেন ওই আড্ডায়। শাহাবুদ্দিন মন খুলে কথা বলেন, রাজনীতি, বঙ্গবন্ধু, জয়নুল আবেদিন, প্যারিসের প্রবাস জীবন, চিত্রকলা প্রসঙ্গে। তার কথায় থাকে প্রবল দেশপ্রেম। আসর ভাঙলে একরাশ স্বপ্ন নিয়ে ফিরে আসি ঘরে। এই মহান শিল্পীর অকৃত্রিম স্নেহ আমরা উপলব্ধি করি সবসময়। তার পঁয়ষট্টিতম জš§দিনে আমাদের শ্রদ্ধা। জয় বাংলা!
×