ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

সুচি কোন্ পথে

প্রকাশিত: ০৫:৪৩, ১২ সেপ্টেম্বর ২০১৫

সুচি কোন্ পথে

আদর্শের চেয়েও ভোটের রাজনীতি প্রায়শই গুরুত্ববহ, অতীব প্রয়োজনীয় এবং দরকারিও। সেই মনোভাবের পরিচয় উঠে আসছে নিকট প্রতিবেশী মিয়ানমারের সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে। প্রতিবেশীর জন্য এমনিতেই বেশি বেশি করতে হয় বলে প্রবাদ রয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের এই প্রতিবেশী বড়ই অধরা। চারদিকের দুয়ার বন্ধ রেখে নিজেতেই অন্তরীণ হয়ে থাকা দেশটি দীর্ঘকাল ধরে সামরিক শাসনে জর্জরিত। বাক ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা, রাজনীতিচর্চার অধিকারও ছিল না। তাই বিচ্ছিন্নতাবাদী সশস্ত্র আন্দোলন মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে বিভিন্ন প্রদেশে। তাদের দমনে নিপীড়ন, নির্যাতনের পথ বেছে নেয় সামরিক জান্তা সরকার। বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী আরাকানে রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর সশস্ত্র নির্যাতন চালিয়ে দেশছাড়া করে। লাখ লাখ রোহিঙ্গা সেই ১৯৭৭ সাল থেকে বাংলাদেশে শরণার্থী হিসেবে বসবাস করছে। এদের সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে। আন্তর্জাতিক কোন চাপের মুখেও এরা তাদের ফেরত নিচ্ছে না। অবশ্য লোক দেখানোর জন্য কিছু রোহিঙ্গাকে ফেরত নিলেও তারা আবার ফিরে আসছে। এই রোহিঙ্গারা আশ্রয়ের সন্ধানে বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ছে। এমনকি পাচার হয়ে যাচ্ছে। সমুদ্রপথে পাচারকালে বহু রোহিঙ্গার সলিলসমাধি ঘটেছে। মার্কিন চাপে দেশটি সামরিক শাসন থেকে বেসামরিক শাসনের দিকে পরিচালিত হচ্ছে। ২০১১ সালে বেসামরিক সরকারের হাতে ক্ষমতা যায়। অবশ্য এখানেও সেই সামরিক জান্তাদের আধিক্য। বিগত ২৫ বছরের মধ্যে এই প্রথম সংসদ নির্বাচন হতে যাচ্ছে। আগামী ৮ নবেম্বর অনুষ্ঠেয় এই নির্বাচন মিয়ানমারের জন্য ঘুরে দাঁড়ানোর একটি মাহেন্দ্রক্ষণ। প্রথমবারের মতো সে দেশের জনগণ দেশে প্রকৃত পরিবর্তন আনার সুযোগ পাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ৯০টি রাজনৈতিক দল প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে। প্রায় তিন কোটি ভোটার ৪৪৪টি আসনে ভোট দেবেন। দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদের মোট আসন ৬৬৪টি। এরমধ্যে সেনাবাহিনীর জন্য ২৫ ভাগ আসন সংরক্ষিত রয়েছে। অর্থাৎ দেশটির শাসনভার সেনাবাহিনী থেকে সহজেই হাতছাড়া হচ্ছে না। নির্বাচনে ক্ষমতাসীন সেনাবাহিনী সমর্থিত দল ইউএসডিপির প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী গণতন্ত্রকামী নেত্রী হিসেবে পরিচিত ও শান্তিতে নোবেলজয়ী আউং সান সুচির দল এনএলডি। নির্বাচন নিয়ে সংশয়ে থাকা সুচির দল বিপুল ভোটে জয়ী হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। সত্তর বছর বয়সী সুচি দীর্ঘকাল গৃহবন্দী ছিলেন। একটা সময় ছিল যখন সুচিকে এশিয়ার ম্যান্ডেলা বলে অভিহিত করা হতো। কারও কাছে ছিলেন তিনি সাধুসন্তর মতোই একজন। দেশটির মানবাধিকার ও গণতন্ত্রের জন্য সুদীর্ঘ সংগ্রাম ও আত্মত্যাগ তাকে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার এনে দিলেও এবং বিশ্বজুড়ে প্রশংসিত হলেও নিজ দেশে শান্তি প্রতিষ্ঠায় কোন অবদান রাখতে পারেননি। এই ‘আপোসহীন’ নেত্রী রোহিঙ্গা ইস্যুতে কোন শক্ত অবস্থান নেননি। প্রকারান্তরে জান্তাদের মতো তিনিও বিশ্বাস করেন, রোহিঙ্গারা সে দেশের নাগরিক নয়। এবারের নির্বাচনে তার দলের জনপ্রিয় মুসলিম প্রার্থীদেরও মনোনয়ন দেয়া হয়নি। অথচ মুসলমানরা সে দেশে দ্বিতীয় বৃহত্তম জনগোষ্ঠী। নির্বাচনে যে কোন প্রকারে জেতার জন্য সুচি উদগ্রীব। তার জনসভায় বিপুল লোক সমাগম হচ্ছে। দুই-তৃতীয়াংশ আসন পাওয়ার জন্য তিনি নিপীড়িত জনগণ সম্পর্কে উচ্চবাচ্য করছেন না। কট্টরপন্থী বৌদ্ধদের চটাতে চান না তিনি। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস যে, এই সুচিই ‘ফ্রিডম অব ফেয়ার’ বা ভয় থেকে মুক্তি বিষয়ে লিখেছেন। আর সেই তিনি এখন নিজেই ভয় পাচ্ছেন। নির্বাচনে বিজয়ের পর যদি ক্ষমতা পান, তখনও তিনি অবস্থান থেকে সরবেন বলে মনে হয় না। তারপরও প্রতিবেশী দেশে সুচির নেতৃত্বে গণতান্ত্রিক শক্তি ক্ষমতাসীন হোকÑ বাংলাদেশ তাই চায়।
×