ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

পালা বদলের পালায় ॥ বিদায় পুরনো

প্রকাশিত: ০৬:০৬, ১২ সেপ্টেম্বর ২০১৫

পালা বদলের পালায় ॥ বিদায় পুরনো

পাখি সব করে রব রাত্রি পোহাইল। কাননে কুসুম কলি সকলি ফুটিল... শিশু শিক্ষা পুস্তকের এই কবিতাটি এখন সম্পূর্ণ বলুন তো! পারবেন? চেষ্টা করে দেখুন। আচ্ছা ক্লু দিচ্ছি। মাঝের পঙক্তিতে আছে ‘ফুটিল মালতি ফুল সৌরভ ছুটিল...। এখনও পারলেন না! আরেকটি ক্লু, শেষের পঙক্তি ‘আপন পাঠেতে মন করহ নিবেশ। এবার পারবেন? আরেকটি বলুন, সকালে উঠিয়া আমি মনে মনে বলি...। পারলেন না! বলুন তো শিশু শিক্ষা কে লিখেছেন! এটা হয়তো পারবেন নাম- মদন মোহন তর্কালঙ্কার। এবার বইটি কোথাও পাওয়া যায় কিনা তা খুঁজে দেখুন। কষ্ট হবে পেতে। একটা সময় এই শিশু শিক্ষা ও ধারাপাত ছিল শিশুদের জীবন গড়ার শেকড়ের পাঠ। হাতেখড়ি দেয়া হতো এই বই দিয়ে। হাতেখড়ি শব্দটিও আর নেই। হাতেখড়ির সঙ্গে আরেকটি জিনিস থাকত স্লেট পেনসিল। চারিধারে কাঠের বাঁধনে পাথরের স্লেট পাথরের চিকন পেনসিল ছিল লেখার উপকরণ। তা আর নেই। ফাউন্টেন পেন (ঝরনা কলম) খুঁজে পাওয়া যায় না। এই কলমের নিচের অংশে কালি ভরে উপরের নিবের সঙ্গে প্লাস্টিক যুক্ত করে প্যাঁচ দিয়ে এঁটে লিখতে হতো। তারও আগে চিকন কঞ্চি ও পাখির পালকের আগায় নিবের মতো কেটে দোয়াতে চুবিয়ে লেখা হতো। কালির ট্যাবলেট পানিতে গুলে তরল কালি তৈরি হতো। ঝরনা কলম আসার পর দোয়াত ভরা রেডিমেড কালি পাওয়া যায়। এমনি অনেক চেনা ব্যবহার্য জিনিসপত্র আজ আর নেই। তার ওপর এসেছে আধুনিক জীবন ধারার জিনিস। অনেক শব্দও আর নেই। যেমন ট্রানজিস্টর। ছাদে এরিয়াল (এন্টিনা) টাঙিয়ে বড় ব্যাটারির সঙ্গে প্লাগ দিয়ে ঢাউস আকারের রেডিও বাজত। ষাটের দশকের শুরুতে টর্চ লাইটের বারটি বা ছয়টি ব্যাটারি ভরে এক ধরনের রেডিও এল। পরিচিতি পেল ট্রানজিস্টর নামে (আসলে ট্রানজিস্টর হলো বর্তমানের ইন্টিগ্রেটেড সার্কিটের মতো দূর থেকে ভেসে আসা কথা ধারনের যন্ত্রাংশ)। নামটা এতই জনপ্রিয় হয় যে জামাইকে একটা ট্রানজিস্টর না দিলে গোস্বা হয়ে থাকত। এই ট্রানজিস্টর বগলদাবা করে গান শুনতে শুনতেই পথ চলত। এমনকি কৃষক হালের সঙ্গে রেডিও বেঁধে গান শুনে জমি চাষ করেছে। এই রেডিও এখন আর সহজে খুঁজে পাওয়া যায় না। সেদিনের শর্ট ওয়েভ, মিডিয়াম ওয়েভও নেই। সবই এখন ডিজিটাল ওয়েভ। গ্রামের গৃহস্থ ও কিষান বাড়িতেও এখন মাটির হাঁড়ি পাতিল নেই। মাটির থালা সানকিও নেই। মাটির কলস চোখে পড়ে না। কলসি কাঁখে কেউ ঘাটেও যায় না। বনেদি পরিবারে কাঁসার ব্যবহার আভিজাত্য তুলে ধরত। এখন কাঁসার বাসনকোসনের ব্যবহার নেই। বিয়ে শাদির অনুষ্ঠানে কাঁসার বাসন উপহার দেয়া হতো খোদাই করে নাম লিখে। আজকের দিনে তা শুধুই স্মৃতি পটে আঁকা ছবি। শহরে-গ্রামে কারও ঘরে কাঁসার থালা গ্লাস জগ থাকলে তা হয়ত আছে কোন চিলেকোঠায়। খুঁজেও পাওয়া যায় না। কালের আবর্তে এগুলো হারিয়ে গেছে এবং যাচ্ছে। রিপ্লেস হয়ে এসেছে কাঁচ সিরামিক ও ম্যালামাইন। কাঁসা ও পিতল শিল্পে সমৃদ্ধ ছিল দেশের টাঙ্গাইল ও মানিকগঞ্জ। কাঁসার পাশাপাশি অনেক শো পিস বানান হতো। যার কদর ছিল দেশের গ-ি ছাড়িয়ে বিদেশে। এখনও তা কিছুটা আছে। কাঁসার সুরমাদানি কাজলদানি প্রায় প্রত্যেক ঘরেই ছিল। সরষের তেলে সলতে চুবিয়ে মাথায় আগুন ধরিয়ে কাজল দানিতে শিখার সঙ্গে উদগিরীত কালো ধোঁয়া ভরে রাখা হতো। যা ছিল সেদিনের কাজল। নবজাতকের কপালের পাশে কাজলের টিপ দেয়া হতো। এই কাজল চোখে দিত মেয়েরা। কাজলের গান আছে ‘ওগো কাজল নয়না হরিণী’। সুরমাদানির সঙ্গে কাঁসা বা পিতলের সরু কাঠিতে সুরমা ভরে চোখের নিচের অংশে টেনে দেয়া হতো। বিয়েশাদির অনুষ্ঠানে বরকে সুরমা পরতে হতো। ঈদের দিনে সুরমা পরা ছিল রেওয়াজ। কিছুদিন আগেও টাইপরাইটার ছিল অফিশিয়াল কাজের লিখনীর যন্ত্র। অফিসে টাইপিস্ট নামে পদও ছিল। ঢাকা মহানগরীর গুলিস্তান এলাকাসহ দেশের প্রতিটি শহরে কমার্শিয়াল টাইপিস্টরা নির্দিষ্ট জায়গায় সারিবদ্ধ হয়ে বসে কাজ সেরে দিনান্তে কামাইয়ের অর্থ নিয়ে বাড়ি ফিরত। টাইপ মেশিনের সেই খটখট শব্দ রিপ্লেস হয়ে অনেক আগে এসেছে কম্পিউটার কিবোর্ডের মিষ্টি শব্দ। একটা সময় ছাপাখানায় সিসার অক্ষরে লেটার কম্পোজ হতো। এখন সবই কম্পিউটারে। আশির দশকের মধ্যভাগেও টেলিগ্রাম চালু ছিল। আগের দিনের পোস্টমাস্টারদের টেলিগ্রামের টরেটক্কা শব্দ সংকেতে বার্তা লেখার ট্রেনিং ছিল বাধ্যতামূলক। টেবিলের একধারে কিছুটা ভাঁজানো প্রায় ৬ ইঞ্চি শক্ত পিতলের বার আটকানো থাকত। এক প্রান্তে ব্যাটারি সংযুক্ত ছোট্ট চৌকোনা বাক্স। তার ওপর ইংরেজী এইচের মতো ছোট্ট নল বসানো। তারের মাধ্যমে তরঙ্গায়িত হয়ে টরেটক্কা শব্দ ভেসে আসত ইংরেজী ২৬টি এ্যালফাবেটের ভিন্ন ভিন্ন সংকেত নিয়ে। প্রতিটি অক্ষর লিখে সাজিয়ে যে বাক্য হতো তা ছিল টেলিগ্রাম। কারও বাড়িতে এমন জরুরী বার্তার খাম পিয়ন দিলে তা খোলা হতো দুরুদুরু বক্ষে, কী জানি কেমন খবর আসে। আনন্দ ও বেদনার দুই ধরনের খবর থাকত। আজ তা অতীত। টেলিগ্রাম, টেলিফোনের পথ ধরে বর্তমানে এসেছে স্মার্ট সেল ফোন। যা এখন কম্পিউটারের কাছাকাছি। একদার সাদাকালো ফিল্মের ক্যামেরা থেকে আজকের উন্নত ডিজিটাল পিক্সেল স্টিল ক্যামেরা, ৩৫ ও ১৬ মিলিমিটার ফিল্মের মুভি ক্যামেরা থেকে ফিতা ক্যাসেটের ভিডিও ক্যামেরা হয়ে হাই ডেফিনেশনের (এইচডি) ভিডিও ক্যামেরা। স্প্রিংয়ে পাম্প করা ৭৮ আরপিএমের রেকর্ডের ওপর সাউন্ড ট্র্যাকে পিন বসিয়ে ঘুর্ননের গ্রামোফোন (যা কলের গান নামে অধিক পরিচিত) ছিল শ্রুতি গানের বড় আধার। সেখান থেকে স্পুল টেপ রেকর্ডার ক্যাসেট প্লেয়ার থেকে কমপ্যাক্ট ডিস্ক (সিডি) হয়ে হালের মেমোরি কার্ড। বিবর্তনের গতিতে স্মার্ট ফোনে কথা বলা গান শোনা অডিও ভিডিও রেকর্ডিং করা স্থির ও ভিডিও ছবি তোলা সবই আছে ছোট্ট মেমোরিকার্ড ও চিপসে। মনে হবে সকল কাজের ওয়ান স্টপ ইলেকট্রনিক্স বস্তু। একটা সময় পেন্ডুলাম দোলানো দেয়াল ঘড়ি ছিল। সপ্তাহে একদিন চাবি দিলে সাত দিন চলত। এক ঘণ্টা অন্তর সময়ের ঘণ্টা বাজত। এই ঘড়ির পরিচিতি ছিল দম দেয়া ঘড়ি নামে। একটা সময় হাত ঘড়ির সঙ্গে পকেট ঘড়িও ছিল। বয়স্করা চেনের সঙ্গে ঘড়ি এঁটে জামার বুক পকেটে রাখত। কত কি যে পরিবর্তন হচ্ছে। এর মধ্যে ফিরেও আসছে কিছু জিনিস। যেমন হাতলওয়ালা কাঠের চেয়ার নতুন ডিজাইনে ফিরছে। কাঠের আলমারি প্রায় উঠেই গিয়েছিল। নতুন ধারায় তা আসছে। চিকন গুনার নেটে মিটসেফ আর নেই। বাঁশের চিকন কাঠির পর্দা নেই। লম্বা ও সমান্তরালভাবে টানা মোটা রডের সঙ্গে কাঠের জানালা নেই। কাঠের খিল আঁটা দরোজা নেই। সাইকেলে হাওয়া দেয়ার লম্বা পাম্পার নেই। ধান ভানা ঢেঁকি আছে, তবে কাজ নেই। শিলপাটার দিন ফুরিয়ে এসেছে বিদ্যুতচালিত ব্লেন্ডার মেশিন। মাটির চুলার আধুনিকীকরণে কোরোসিন চুলা ও স্টোভ এসে তাও এখন অচল। এসেছে গ্যাস বার্নার। কুপি বা লণ্ঠন কিছু আছে তাও বিদায়ের পথে যেমন চিমনি হারিকেনকে ফেয়ারওয়েল দিয়েছে চার্জার বাতি। ...এভাবে আমাদের চিরচেনা ব্যবহার্য জিনিসগুলো চোখের সামনে দিনে দিনে হারিয়ে সেই একই জিনিস ভিন্নভাবে অতি আধুনিক হয়ে এসে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে সম্মুখ পানে। পুরনো জিনিসগুলো স্মৃতির পাতায় মনের মুকুরে রয়ে যাচ্ছে...। Ñসমুদ্র হক, বগুড়া থেকে
×