ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

হারিয়ে গেছে প্রেমজুড়ি টুস্বি খমক

প্রকাশিত: ০৬:০৬, ১২ সেপ্টেম্বর ২০১৫

হারিয়ে গেছে প্রেমজুড়ি টুস্বি খমক

আহমদ তৌফিক চৌধুরী রচিত ‘শহর ময়মনসিংহের ইতিকথায় আছে- কেউ কেউ রসিকতা করে বলে থাকেন, গু-গবহ-ঝরহম ‘আমার মানুষ গান করে’। এ থেকে বোঝা যায় ময়মনসিংহের মানুষ সঙ্গীতপ্রিয় ছিল। গান বাজনাতে কখনও পিছিয়ে ছিল না ময়মনসিংহ। আদি নাম নাসিরাবাদ ও মোমেনশাহী থেকে ময়মনসিংহ নামের উৎপত্তি। সংস্কৃতি চর্চা ও আয়োজনের একটা বড় অংশ জুড়ে থাকত বিভিন্ন বাদ্য যন্ত্র। কালের বিবর্তনে এবং ডিজিটালের সঙ্গে পাল্লা দিতে গিয়ে হারিয়ে গেছে অতীতের অনেক বাদ্যযন্ত্র। এসব বাদ্যযন্ত্র ঠাঁই নিয়েছে জাদুঘরে। অথবা কোন শৌখিন সঙ্গীত সমঝদারের সংগ্রহশালায়। ডিজিটালের ঢেউ লেগেছে এখন সবখানে। অত্যাধুনিক বাদ্যযন্ত্রের আমদানি এবং ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যবহার জনপ্রিয় হয়ে ওঠার কারণেই নতুন ও তরুণ প্রজন্মের শিল্পী এবং কলাকুশলীদের কাছে পুরনো দিনের বাদ্যযন্ত্রের কদর কমে গেছে। অথচ লোকজ সংস্কৃতি ও হারানো দিনের গানগুলোতে এসব বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহার ছিল ব্যাপকহারে। গাজীপুরের ভাওয়াল রাজার বাড়িতে লোক সঙ্গীতের আসরসহ গাজী কালু চম্পাবতীর পালায় একসময় ব্যবহার হতো ‘সুর সংগ্রহ’ নামের বাদ্যযন্ত্র। কাঠ দিয়ে তৈরি এই বাদ্যযন্ত্রের ওপরে তার ব্যবহার করা হয়েছে। এই বাদ্য যন্ত্রটি এখন আর নেই। এর যন্ত্রীও নেই। তেমনি জারি ও সারি গানসহ নৌকাবাইচে একসময় ব্যবহার ছিল প্রেমজুরি ও মেকুড় বাদ্যযন্ত্রের। মেকুড় তামা ও পিতলের তৈরি পায়ে ব্যবহারের বাদ্যযন্ত্র। আর প্রেমজুড়ি হচ্ছে কাঠের ফ্রেমের ভেতর ঝুনঝুনির ব্যবহার সম্বলিত বাদ্যযন্ত্র। এসব যন্ত্রের এখন ব্যবহার যেমন নেই, তেমনি নেই এর যন্ত্রী। নারকেলের খোসা দিয়ে তৈরি এবং ছর দিয়ে ঘষে বাজানোর যন্ত্র টুস্বি। গ্রামবাংলার পীরের মাজারের জিকির ও বাউলসহ আধ্যাত্মিক গানের আসরে ব্যাপক ব্যবহার ছিল টুস্বির। এই বাদ্যযন্ত্রটি হারিয়ে গেছে। কাঠ দিয়ে ঢোলকের আদলে তৈরি, কিন্তু একপাশ খোলা। এই খোলা অংশ দিয়ে বের হওয়া সুতোয় ধরে বাজানো যন্ত্রের নাম খমক/আনন্দ লহরী। জারি ও ভাটিয়ালি গানে এর ব্যবহার ছিল দীর্ঘদিন। এই বাদ্যযন্ত্রটিও হারিয়ে গেছে। যাত্রাপালা ও কীর্তনে ব্যবহার হতো পিতল ও কাঁসার তৈরি করতাল। যাত্রাপালা হারিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এই বাদ্যযন্ত্র ও এর যন্ত্রী কমে গেছে। ভজন ও ভক্তিমূলক গানে সারিন্দা ও সারেঙ্গীর বিকল্প ছিল না একসময়। ভালুক, বানর ও সাপের খেলায় ব্যবহার করা হতো ডমরু/ ডুগডুগি। এই বাদ্যযন্ত্র দেখা যায় না এখন। রাজকীয় কাজে, খাজনা আদায় ও লাঠিখেলায় ব্যবহার ছিল ‘নাকারা’ নামের বাদ্যযন্ত্রের। কিন্তু এসবের এখন ঠাঁই মিলেছে শৌখিন সঙ্গীত পিপাসুদের সংগ্রহশালায়। উচ্চাঙ্গ ও শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে ব্যবহৃত সিতার ও সরোদের ব্যবহার এখনও রয়েছে। কিন্তু সেই পুরনো দিনের সিতার ও সরোদ আর নেই। তার জায়গা দখল করেছে আধুনিক কাঠামো। গারো আদিবাসীদের ব্যবহৃত শিঙ্গার ব্যবহার থাকলেও সীমিত। তবে পুরনো দিনের গানসহ রবীন্দ্র ও নজরুল সঙ্গীতে ব্যবহৃত মন্দিরার কদর কমেনি এখনও। খ্যাতিমান টিউনার হিসেবে পরিচিত ছিলেন ময়মনসিংহ শহরের মরহুম নবাব আলী। শহরের বড় বাজারে নবাব অ্যান্ড কোং নামে বাদ্যযন্ত্রের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ছিল তার। ভীস্মদেব ভট্টাচার্য, বিপিন দাস, ওস্তাদ মিথুন দে, বাদল চন্দ্র দে, তবলা বাদক পচানন্দ, বিজয় কৃষ্ণ, আভা আলম, মিতালী মুখার্জী, বাউল জালাল খাঁ, উকিল মুন্সি, ওস্তাদ পবিত্র মোহন দে, বাউল সুনীল কর্মকারসহ খ্যাতিমান অনেক সঙ্গীতজ্ঞ এই প্রতিষ্ঠানে যাতায়াত করতেন। Ñবাবুল হোসেন, ময়মনসিংহ থেকে
×