ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

সিডনির মেলব্যাগ ॥ অজয় দাশগুপ্ত

রাজনীতিবিমুখ তারুণ্য ও উজ্জ্বল উদ্ধার

প্রকাশিত: ০৫:৪৪, ১৩ সেপ্টেম্বর ২০১৫

রাজনীতিবিমুখ তারুণ্য ও  উজ্জ্বল উদ্ধার

কিছুদিন থেকে ফুঁসে ওঠা ছাত্রলীগ আর মন্ত্রীদের বড় বড় কথার তোড়ে রাজনীতি প্রায় দিশাহারা। একটা ব্যাপারে বড় বেদনা জাগে। শেখ হাসিনা যখন তাঁর ঘরে-বাইরে দুশমনদের প্রায় ঠা-া করে এনেছেন তখন এরা এমন করে পানি ঘোলা করছে কেন? কেন নিশিদিন বাজে কথা, লাগামহীন কথা বলতে হবে? সিলেটে, ফরিদপুরে, চট্টগামে এ কিসের পদধ্বনি? মনে পড়ে বঙ্গবন্ধুর আমলে শেষ সময়ে এহেন উৎপাত শুরু“হয়ে গিয়েছিল। আওয়ামী লীগের শত্রুর সংখ্যা বিশাল। বিএনপি মৃতপ্রায় সাপ, জামায়াত আছে ঘাপটি মেরে। তারচেয়েও বড় দুশমন এখন নব্য গজানো সুশীলরা। এক শ্রেণীর মিডিয়া ওত পেতে আছে। তারা সুযোগ পেলেই ছোবল মারবে। সিলেটের ঘটনার পর প্রথম আলোর ভূমিকা ছিল ন্যক্কারজনক। জাফর ইকবালের পেছনে লাগার জন্য তারা যে কাজ করেছে, যেসব খবর ছাপিয়েছে, তাতে ছাত্র রাজনীতির বারোটা বাজতে বাধ্য। আসলে এরা চাইছে ছলে বলে কৌশলে ছাত্র রাজনীতি চাপা পড়ে যাক। কারণ তারুণ্য জাগলেই বিপদ। যে কারণে শাহবাগের সময় তারা নোংরা গল্প ও খবর ছাপিয়ে একে দুর্বল করতে চেয়েছিল। এমনিতেই যুবক-যুবতীরা রাজনীতিবিমুখ। তাদের অংশগ্রহণ ছাড়া এদেশে যা থাকবে তার নাম মৌলবাদী রাজনীতি। আমরা কি তাই চাই? দেশের বাইরে যে জরিপ হয় সাধারণত তার পেছনে থাকে নানা ধরনের লবিং। এবার একটা ভাল জরিপ দেখলাম। বিবিসির একটা জরিপে আমাদের তারুণ্য রাজনীতিবিমুখতার কথা বলেছে। তাদের এই বিমুখতা খুব স্বাভাবিক। তার মানে ভাল ছাত্রছাত্রীদের মনে ভয়। সেটাই বেরিয়ে এসেছে। বিবিসি জরিপের ফলাফল বলছে, দেশের শতকরা সত্তর ভাগ তরুণ-তরুণী রাজনীতি পছন্দ করে না। রাজনীতির প্রতি বীতশ্রদ্ধ এই তারুণ্য মনে করছে দুর্নীতি ক্রমবর্ধমান এবং তা দেশের ভাবমূর্তির জন্য বিপজ্জনক। বিবিসিকে অভিনন্দন। সত্য তুলে ধরার মতো নিরপেক্ষতা ও স্বচ্ছতা এখন প্রায় অদৃশ্য; বিরল কাজটি করে অবহেলিত তারুণ্যের চিন্তা-ভাবনাকে সামনে নিয়ে এসেছে তারা। অদ্ভুত এক দেশ আমাদের। কয়েক কোটি তরুণ-তরুণীর বড় হয়ে ওঠাকে থোড়াই কেয়ার করি আমরা। টিভির টকশো, রেডিওর ভারি আলাপ, পত্রপত্রিকার লেখালেখি কিংবা জ্ঞানগর্ভ আলোচনাÑ কোথাও তারা নেই। ভাবখানা এই, দুধের শিশু, এরা আর কী বোঝে? বড় বেদনার, বড় অবহেলার এই ভাবনা। বয়স্কজনরা জায়গা ছেড়ে দিতে ভয় পাবেন এটাই স্বাভাবিক। যত বয়স বাড়ে, যত সময় যায়, মানুষ ততই হিসাবি হয়ে ওঠে। লালন শাহ লিখেছেন, ‘হাড়েরও ঘরখানি চামড়ার ছাউনি/বন্দে বন্দে জোড়া, একদিন জানি খসিয়া পড়িবে, রঙ্গিলা দালানের মাটি।’ এই খসে পড়া প্রকৃতিরই নিয়ম। একে একে অঙ্গ খসে পড়ার মতো চিন্তা-ভাবনা-মগজেও ধস নামে। ফলে তারুণ্য যা পারে প্রৌঢ়ত্ব বা বার্ধক্য তা পারে না। তারুণ্য হচ্ছে অশ্ব বা ঘোড়া, অভিজ্ঞতা বা বয়স হচ্ছে তার রশি। ঘোড়া অর্থাৎ তারুণ্য চলবে, চলমান তাকে পথভ্রষ্ট হতে দেখলে রশি হবে নিয়ন্ত্রক, সে তাকে সামলাবে। কিন্তু রশিই যদি চলতে চায় বা নিয়ন্ত্রক হয় অশ্ব তখন কী করে? গতিহীন হওয়া ছাড়া গত্যন্তর থাকে না তার। এ সত্যটুকু আমাদের রাজনীতি বোঝে না, বুঝলেও মানে না। বয়স্কজনদের ভিড় আর পুরনো মগজের কিলবিল করা রাজনীতিকে তাই ‘না’ জবাব দিয়েছে আজকের প্রজন্ম। কোন্ রাজনীতি করবে তারা? যে রাজনীতি দস্যুবৃত্তি ও ভূলুণ্ঠনে উৎসাহী, যে রাজনীতির দালানকোঠায় বসবাস মানে আগুনে পুড়ে প্রাণ হারানো, রাস্তায় বেরোলে গাড়ির তলায় বেঘোরে প্রাণ দেয়া? বিগত চৌত্রিশ বছরে এমন একজন রাজনীতিবিদও নেই যাকে তারা অনুসরণযোগ্য মনে করতে পারে। শুধু কি তাই, নির্দ্বিধায় বিশ্বাস বা আস্থা রাখার মতো নেতা-নেত্রীও জন্ম দিতে পারেনি দেশের রাজনীতি। আমাদের যৌবন গেছে এরশাদের মতো জেনারেলের স্বৈরশাসনে। অবরুদ্ধ মিডিয়া ও গণতন্ত্র আজ আলোর মুখ দেখছে বটে, তবে সে আলোর পাদপ্রদীপে সেই সেনাশাসকও রয়েছেন উজ্জ্বল ভূমিকায়। এই কি রাজনীতি? এটা কি অনুসরণযোগ্য কিছু? দেশের বুদ্ধিজীবীরা তো বটেই, দীর্ঘকাল প্রবাসী বিশিষ্টজনরাও দলাবেগে আকুল, ভাবাবেগের পরিবর্তে দলীয় আবেগই এদের পুঁজি। ফলে কেউ এ দলের, কেউ ও দলের। একবার বলেন হরতাল ভাল, অন্যবার তার বিরুদ্ধে সোচ্চার। স্বপক্ষের অন্যায় দেখেন না। দেখেন না সামান্য ত্রুটি-বিচ্যুতিও। নিজেদের কালে উন্নয়নের জোয়ার, অন্য আমলে অন্যায়ের প্লাবন দেখা একদর্শী। অন্ধ আনুগত্যবাদীদের দেখে তারুণ্য জাগবে কী উপায়ে, বলুন? এক-এগারো নামের পরিবর্তনও এসেছিল সে পথে। রাজনীতির প্রতি অশ্রদ্ধায় সাধারণ মানুষ তাকে জানিয়েছিল স্বাগত। সে পাঠ চুকে যাওয়ার পর বিদগ্ধজনরা যার যার মতো ব্যাখ্যা আর কল্পিত বিশ্লেষণে ব্যস্ত, উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপিয়ে জনপ্রিয় মাধ্যম ও সংবাদপত্রের কণ্ঠরোধে আগ্রহী। এদের দেখে রাজনীতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়ার কি আদৌ কোন কারণ আছে? তবুও তারুণ্য ভুল করেনি। তাদের পছন্দের শীর্ষে আছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও কবি নজরুল ইসলাম। অর্থাৎ, তাদের পছন্দ পরিষ্কার। তারা চায় স্বপ্নদ্রষ্টা, সাহসী ও সত্যবাদী বাঙালী। এঁদের একজন আজীবন সংগ্রাম ও সাধনায় রাজনৈতিক মুক্তি দিয়ে গেছেন, অন্যজন সাংস্কৃতিক মুক্তি। উভয়েই কবি। একজন লিখেছেন পতাকা, সঙ্গীত ও সার্বভৌমত্ব, অন্যজন বাঙালীর সাহস ও সংগ্রাম। তারুণ্যের এই পছন্দ মূলত সত্য আর ন্যায়ের পক্ষে এক যুগান্তকারী অবস্থান। যে কেউই চাইলে এ থেকে শিক্ষা নিতে পারেন। কয়েক কোটি তারুণ্যের চল্লিশ ভাগ প্রবাসে যেতে আগ্রহী। সিংহভাগ দুর্নীতির ভয়ে আতঙ্কগ্রস্ত এবং তা ক্রমবর্ধমান বলে রায় দিয়েছে। অন্যরা দেশে থাকলেও রাজনীতির সঙ্গে বসবাসে অনাগ্রহী। তাহলে এদেশ চালাবে কারা? কারা দেবেন আগামী দিনের নেতৃত্ব? জীবনের সব ক্ষেত্রে মেধা ও মননের বিকল্প নেই। আধুনিক রাষ্ট্রে শৈশব থেকেই রাজনীতির সঙ্গে পরিচয় করে দেয়ার রেওয়াজ রয়েছে। শীর্ষপদের কর্তা-কর্ত্রীরা নিয়মিত স্কুল পরিদর্শনে যান। তাঁদের সঙ্গে মিলিত হয় ভবিষ্যত প্রজন্ম নামে পরিচিত শিশু-কিশোর, তরুণ-তরুণীর দল। আমাদের দেশে যা অবস্থা তাতে সংবর্ধনার নামে তাদের ওপর অত্যাচার, রাস্তায় দাঁড় করিয়ে রেখে রোদ-বৃষ্টিতে কষ্ট দেয়া আর অপমান ছাড়া কিছুই চোখে পড়ে না। শৈশব থেকে রাজনীতির নামে নিগৃহীত, অপমানিত প্রজন্ম যৌবনে এসে রাজনীতিবিমুখ হবে, এটাই কি স্বাভাবিক নয়? এর প্রতিকার কোথায়? কে দেবে এর উত্তর? জরিপও এ বিষয়ে কিছু বলেনি। এভাবে চললে এদেশে প্রগতিশীল আন্দোলন কখনও আর মাথা তুলতে পারবে না। জয়ী হবে মৌলবাদ আর সুবিধাবাদ। ঠেকাতে হলে শুদ্ধ ধারার রাজনীতি চালু করতে হবে। যে দলে বঙ্গবন্ধু, তাজউদ্দীন, মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ আছে, তারা না করলে এ কাজ করবে কারা?
×