ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

মাননীয় তথ্যপ্রযুক্তি উপদেষ্টা, এই অন্যায়টুকু রোধ করুন!

প্রকাশিত: ০৩:২৮, ১৪ সেপ্টেম্বর ২০১৫

মাননীয় তথ্যপ্রযুক্তি উপদেষ্টা, এই অন্যায়টুকু রোধ করুন!

ভূমিকা পর্ব বিষয়টি খুব বিব্রতকর এবং একটি দেশের জন্য লজ্জাকর। কিন্তু বাংলাদেশে এটা হচ্ছে এবং এটা নিয়ে কেউ কোন কথা বলছেন না। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, খুব আটঘাট বেঁধেই একটি গোষ্ঠী এই অন্যায়টুকু বাংলাদেশের ওপর চাপিয়ে দিতে যাচ্ছে এবং এই অন্যায়টা যে ঠিক কে ঠেকাতে পারেন, আমার মাথায় ঢুকছে না। তাই মাননীয় তথ্যপ্রযুক্তি উপদেষ্টার দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য এই খোলা চিঠি। যথাযথ অফিস যদি বিষয়টি তার নজরে আনে তাহলে হয়ত কাজটি হলেও হতে পারে। আন্তর্জাতিক কল টার্মিনেশন এবং বিটিআরসি মাননীয় তথ্যপ্রযুক্তি উপদেষ্টা, আপনি নিশ্চয়ই অবগত আছেন যে, দেশে অবৈধ আন্তর্জাতিক কল টার্মিনেশন ঠেকানোর জন্য বিটিআরসি গত মার্চ মাসের শেষের দিকে একটি নতুন পদক্ষেপ নিয়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশে ২৮ প্রতিষ্ঠানকে (আইজিডব্লিউ) আন্তর্জাতিক কল বাংলাদেশে আনার জন্য লাইসেন্স দেয়া আছে। ২০০৭ সালে বিটিআরসি প্রথমবারের মতো বেসরকারী খাতে ৩টি আইজিডব্লিউ লাইসেন্স দেয়। পরে ২০১২ সালে আরও ২৫টি প্রতিষ্ঠানকে আইজিডব্লিউ লাইসেন্স দেয় বিটিআরসি। এতে এসব প্রতিষ্ঠান তীব্র প্রতিযোগিতার মুখে পড়ে এবং টেলিকম শিল্পে একটি অরাজকতা তৈরি হয়। এবং অবৈধ কল টার্মিনেশনও কমেনি। এতে সরকারের আয়ও কমতে শুরু করে। এই অবস্থা থেকে উন্নতির জন্য বিটিআরসি দুই স্তরের (লেয়ার-১, লেয়ার-২) একটি উদ্ভট ব্যবস্থা প্রণয়ন করে। তারা ২৮টি প্রতিষ্ঠান থেকে ক্ষমতাশালী ৭টি প্রতিষ্ঠানকে লেয়ার-২ এবং বাকি ২১টি প্রতিষ্ঠানকে লেয়ার-১ হিসেবে নির্ধারণ করে দেয় এবং বলে দেয়া হয় যে, দেশের যাবতীয় আন্তর্জাতিক কল আনবে লেয়ার-২ প্রতিষ্ঠানগুলো এবং তাদের কাছ থেকে কল নেবে বাকি ২১টি প্রতিষ্ঠান (লেয়ার-১)। তারপর সেই কল যাবে আইসিএক্স এবং যথাযথ নেটওয়ার্কে। এই সাতটি প্রতিষ্ঠানের (লেয়ার-২) সঙ্গে অন্য আইজিডব্লিউ অপারেটরের (লেয়ার-১) রাজস্ব ভাগাভাগি হবে ১:১.৯ হারে। বিষয়গুলো একটু টেকনিক্যাল। আমি বিস্তারিত যাচ্ছি না। তবে, যারা এগুলো নিয়ে কাজ করছেন তারা বিষয়গুলো আরও পরিষ্কারভাবে জানেন। বিটিআরসির নির্দেশনা মতে, কল বণ্টনে আইজিডব্লিউ এবং আইসিএক্সের মধ্যে সমতা থাকবে। তারা কোনভাবেই আইজিডব্লিউ অপারেটরদের মধ্যে বিরূপ প্রতিযোগিতামূলক পরিস্থিতি তৈরি করতে পারবে না। অবৈধ কল প্রতিরোধের জন্য কমন ইন্টারন্যাশনাল পয়েন্টে (সিআইপি) বিটিআরসি নির্দেশিত প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি বসাতে হবে এবং সরকারের নির্ধারিত কলরেট ১.৫ সেন্টে কল পরিচালনা করতে হবে। এবং এই ১.৫ সেন্টের ভেতর আইজিডব্লিউ পাবে শতকরা ২০ ভাগ, আইসিএক্স পাবে ১৭.৫ ভাগ, নেটওয়ার্ক অপারেটর পাবে ২২.৫ ভাগ এবং সরকার পাবে ৪০ ভাগ। বিপজ্জনক যে দুটি বিষয় পুরো প্রক্রিয়ায় দুটি বিষয় খুব বিপজ্জনক- (১) আন্তর্জাতিক কল রেট হুট করেই প্রতি মিনিট ৩ সেন্ট থেকে ১.৫ সেন্টে নামিয়ে আনা, (২) সরকারের আয়ের অংশ ৫১.৭৫ ভাগ থেকে কমিয়ে ৪০ ভাগে আনা। আন্তর্জাতিক কল রেট ৩ সেন্ট থেকে কমিয়ে ১.৫ সেন্টে আনার বিষয়ে যে যুক্তি দেখানো হয়েছে তাহলো, কল রেট বেশি থাকায় অবৈধ পথে কল আসে বেশি। সরকারী রেট যদি ১.৫ সেন্ট হয় তাহলে এই অবৈধ কল টার্মিনেশন বন্ধ হয়ে যাবে এবং সরকার বেশি আয় করতে পারবে। একটি কমনসেন্স হলো, এই কলের পরিমাণ যদি দ্বিগুণ কিংবা তার বেশি না হয় (যেহেতু মূল্য অর্ধেক করা হয়েছে), তাহলে মূল্য কমিয়ে সরকারের কোন লাভ হওয়ার কথা নয়। মূল্য কমতে পারে। ২০০৭ সালে যেহেতু ৩ সেন্ট ছিল, এখনও একই মূল্য থাকবে, সেটা নাও হতে পারে। কিন্তু একটি শর্ত খুব আত্মঘাতী। সেখানে বলা হয়েছে, আইজিডব্লিউ যদি ১.৫ সেন্টের ওপরেও বিক্রি করে থাকে সরকার কিন্তু বাড়তি দামের অংশ পাবে না; অর্থাৎ সরকারের আয় আসবে ১.৫ সেন্টের ওপর থেকেই এবং চালাকিটা এখানেই। সরকারকে ঠকানোর জন্য তারা দামটি ১.৫ সেন্টে নামিয়ে এনেছেন। এখন তারা ২ সেন্ট প্রতি মিনিটে বিক্রি করছেন। বাড়তি ৫০ সেন্ট সরাসরি তাদের বাড়তি মুনাফা, যা সরকার কিছুই পাচ্ছে না। এমনকি, এখন তারা যদি আবার ৩ সেন্টেও বিক্রি করতে শুরু করেন তাহলেও সরকার বাড়তি কিছু পাবে না। কিন্তু সরকার এই ব্যবসাটিকে ব্যক্তি খাতে দিয়েছিল সরকারের আয় বাড়ানোসহ সেবা খাতকে আরও গতিশীল করতে। এভাবে বাড়তি টাকা বের করে নেয়ার বুদ্ধিটা অন্যায়। দ্বিতীয় যে বিষয়টি তা আরও ভয়াবহ। ২০০৭ সালে যখন লাইসেন্স দেয়া হয় সেখানে উন্মুক্ত টেন্ডারের মাধ্যমে নির্ধারিত হয়েছিল কে কত অংশ শেয়ার পাবে। সেই হিসাবে সরকারের পাবার কথা শতকরা ৫১.৭৫ ভাগ। কিন্তু নতুন নিয়মে সেটাকে কমিয়ে করা হলো মাত্র ৪০ ভাগ। বাকি ১১.৭৫% যাচ্ছে কোথায়? বাকিরা সেটা ভাগ করে নিয়েছেন। আইজিডব্লিউ বাড়তি পাচ্ছে ৭.৭৫% (পূর্বে ১৩.২৫%, বর্তমানে ২০%), আইসিএক্সগুলো পাচ্ছে বাড়তি ২.৫% (পূর্বে ১৫%, বর্তমানে ১৭.৫%) এবং নেটওয়ার্ক অপারেটরা পাচ্ছে বাড়তি ২.৫% (পূর্বে ২০%, বর্তমানে ২২.৫%)। এটাই হলো সরকারী টাকার কঠিন ভাগাভাগি। সরকারকে ১১.৭৫% কম দিয়ে সেটা এমনভাবে নিজেরা ভাগ করে নিলেন, যেন কেউ এটা নিয়ে কথা বলতে না পারেন। সবার স্বার্থই সংরক্ষণ হলো, শুধু সরকারেরটা ছাড়া। কিন্তু এটা কি কেউ করতে পারেন? এটা কি দেশের আইনের পরিপন্থী নয়? সরকার যে ৫১.৭৫% পাবে সেটা তো ঠিক করা হয়েছিল উন্মুক্ত টেন্ডার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। সেটা কি আমরা একটি নির্দেশনা দিয়ে পরিবর্তন করে ফেলতে পারি? তার জন্য কি আরেকটি উন্মুক্ত টেন্ডার প্রক্রিয়ার প্রয়োজন ছিল না? সরকারের ভাগে পড়ল ৩৫% ভিএসপি নামে বিটিআরসি আরেক ধরনের লাইসেন্স দিয়েছিল। সেখানে সরকারকে তার আয়ের শতকরা ৫% ছেড়ে দিতে হয়। নতুন চালাকিপূর্ণ বিন্যাসে সকল আন্তর্জাতিক কলই এখন আনা হচ্ছে ভিএসপি লাইসেন্সের মাধ্যমে। ফলে সরকার আরও ৫% আয় হারাবে। অর্থাৎ সরকারের ঘরে যাবে মাত্র ৩৫%, যা আবার মাত্র ১.৫ সেন্ট রেটে ফিক্সড করা! সত্যিই সেলুকাস! আর্জি! মাননীয় তথ্যপ্রযুক্তি উপদেষ্টা, এই অন্যায় কি একটি দেশ সহ্য করবে? কিংবা করতে পারবে? ভবিষ্যতে কখনও কি এটা নিয়ে কেউ প্রশ্ন তুলবে না? আমি জানি না কিভাবে এই কাজটি করা হয়েছে। তবে এটুকু বুঝতে পারি কেউ কোন মহৎ উদ্দেশ্য নিয়ে এই কাজটি করেনি। আমার ধারণা, বিষয়টি আপনার নজরেও কেউ আনেনি। নইলে এত বড় একটি পুকুরচুরি সবার সামনে হচ্ছে কিভাবে! আমি মনে করি, এই বিষয়টি দেশের স্বার্থবিরোধী এবং সরকারের ভাবমূর্তিকে প্রশ্নবিদ্ধ করবে। একজন লেখক হিসেবে এর চেয়ে বেশি কিছু করার ক্ষমতা আমার নেই। বিষয়টি আপনার নজরে আনার জন্য পত্রিকার সাহায্য নিলাম। যদি তাতে বাংলাদেশের কোন উপকার হয় সেটুকুই বড় প্রাপ্তি। আশা করছি, আপনি বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে দেখবেন। ১৩ সেপ্টেম্বর ২০১৫ লেখক : তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ এবং সম্পাদক, প্রিয়.কম ুং@ঢ়ৎরুড়.পড়স
×