ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

প্রধান বিচারপতির ইমপিচ চেয়ে রাষ্ট্রপতির কাছে আবেদন

প্রকাশিত: ০৫:৪৪, ১৪ সেপ্টেম্বর ২০১৫

প্রধান বিচারপতির ইমপিচ চেয়ে রাষ্ট্রপতির কাছে আবেদন

স্টাফ রিপোর্টার ॥ সংবিধান লঙ্ঘন, শপথ ভঙ্গ ও অসদাচরণের অভিযোগে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার অভিশংসন চেয়ে রাষ্ট্রপতির কাছে আবেদন করেছেন সুপ্রীমকোর্টের আপীল বিভাগের বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক। রবিবার তার ব্যক্তিগত কর্মকর্তার মাধ্যমে রাষ্ট্রপতি বরাবরে এই আবেদন পাঠান বিচারপতি মানিক। ওই আবেদনে বিচারপতি মানিক তার পেনশন নিয়ে প্রধান বিচারপতির সিদ্ধান্তকে ‘বেআইনী’ দাবি করে, তা তুলে ধরেছেন। একই সঙ্গে প্রধান বিচারপতি ব্যক্তিগত বিরাগের বশবর্তী হয়ে তাকে বিচারিক কার্যক্রম থেকে সরিয়ে রেখেছেন বলেও দাবি করেন বিচারপতি মানিক। যার একটি অনুলিপি জনকণ্ঠের হাতেও আসে। ওই চিঠিটি সহকারী পুলিশ কমিশনারের কার্যালয় (বঙ্গভবন নিরাপত্তা) গ্রহণ করেছে। রিসিভ কপির অনুলিপিও জনকণ্ঠের হাতে রয়েছে। ওই আবেদনে বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী লিখেছেন, ‘আমি ও জনাব সুরেন্দ্র কুমার সিনহা আপনি (রাষ্ট্রপতি) কতৃক গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ৯৫(১) আর্টিকেল মোতাবেক বাংলাদেশ সুপ্রীমকোর্টের আপীল বিভাগের বিচারপতি হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত হয়ে সংবিধানের ১৪৮ অনুচ্ছেদের বিধান মোতাবেক এই মর্মে শপথ গ্রহণ করেছি, ‘বাংলাদেশের সংবিধান ও আইনের রক্ষণ, সমর্থন ও নিরাপত্তা বিধান করিব এবং ভীতি বা অনুগ্রহ, অনুরাগ বা বিরাগের বশবর্তী না হইয়া সকলের প্রতি আইন অনুযায়ী যথাবিহিত আচরণ করিব।’ পেনশনের বিষয়টি তুলে ধরে আবেদনে বিচারপতি মানিক আরও লিখেছেন, আমি বিনীতভাবে আপনাকে অবহিত করছি, বাংলাদেশের সুপ্রীমকোর্টের আপীল বিভাগের বিচারপতি হিসেবে আমার সর্বশেষ কর্মদিবস আগামী ১৭ সেপ্টেম্বর। এ কারণে আমি প্রধান বিচারপতিকে আমার পেনশনের কার্যক্রমের বিষয়ে সংশ্লিষ্ট অফিসকে নির্দেশনা প্রদানের জন্য অনুরোধ করি। পরে প্রধান বিচারপতি গত ২৫ আগস্ট সুপ্রীমকোর্টের রোজস্ট্রার জেনারেলের মাধ্যমে একটি চিঠি দেন। যেখানে সকল অপেক্ষমাণ রায় লেখা শেষ না হওয়া পর্যন্ত আমার পেনশন কার্যক্রম গ্রহণ করা যাবে না বলে জানানো হয়। এই চিঠির জবাবে আমি গত ১ সেপ্টেম্বর প্রধান বিচারপতি একটি চিঠি দেই। যেখানে প্রধান বিচারপতির ওই সিদ্ধান্তের (পেনশন স্থগিত করা) কোন আইনগত ভিত্তি নেই এবং অতীতে অবসরে যাওয়া সব বিচারপতিই অবসরের পরেও রায় লিখেছেন। আমার প্রতি প্রধান বিচারপতির এই আচরণ বৈষম্যমূলক ও বিদ্বেষপূর্ণ। বিচারপতি মানিক আবেদনে বলেন, এর পর প্রধান বিচারপতি গত ২ সেপ্টেম্বর সুপ্রীমকোর্টের ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রারের মাধ্যমে আমাকে আরেকটি চিঠি দেন, যেখানে আমার পেনশন বিষয়ক কার্যক্রম শুরুর বিষয়টি অবহিত করেন। একই সঙ্গে ওই চিঠিতে আমার অবসরে যাওয়ার পূর্বে যে সমস্ত মামলার রায় লেখা সম্ভব হবে না ওই সব মামলার নথি সংশ্লিষ্ট দফতরে ফেরত দেয়ার অনুরোধ করেন। এ ছাড়া ওই চিঠিতে আমাকে ব্রিটিশ পাসপোর্টধারী হিসেবে উল্লেখ করে মামলার রায় না লিখে বিদেশে চলে যেতে পারি মর্মে সংশয় প্রকাশ করেন, যা কল্পনাপ্রসূত ও অলীক। আবেদনে বিচারপতি মানিক আরও বলেন, প্রধান বিচারপতির ২ সেপ্টেম্বরের চিঠির জবাবে গত ৮ সেপ্টেম্বর আমি প্রধান বিচারপতিকে আরেকটি চিঠি দেই। যেখানে আমি তাকে জানাই, ইতোপূর্বে অবসরে যাওয়া কোন বিচারপতিকেই নথি ফেরত দেয়ার জন্য কখনই বলা হয়নি। প্রধান বিচারপতি হিসেবে আমার প্রতি তার এই আচরণ জিঘাংসামূলক। তার এরূপ আদেশ আমার স্বাধীন বিচারকার্যে হস্তক্ষেপের শামিল ও সংবিধানের ৯৪ (৪) অনুচ্ছেদের পরিপন্থী। এর মাধ্যমে তিনি সংবিধানের ৯৪(৪) অনুচ্ছেদের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন করেছেন। রাষ্ট্রপতির কাছে করা আবেদনে বিচারপতি মানিক আরও লিখেছেন, গত ৮ সেপ্টেম্বর প্রধান বিচারপতিকে চিঠি দেয়ার পর ৯ সেপ্টেম্বরের আপীল বিভাগের বেঞ্চের বিচারিক কার্যক্রম থেকে সরিয়ে দেয়া হয়। এর পর থেকে আজ (রবিবার) পর্যন্ত আমাকে কোন বিচারিক বেঞ্চে দেয়া হয়নি। গত ৮ সেপ্টেম্বরও আমি বিচারিক বেঞ্চে কর্মরত ছিলাম। আবেদনে তিনি বলেন, আমার প্রতি প্রধান বিচারপতির এরূপ আচরণ ভয়াবহভাবে বৈষম্যমূলক ও প্রতিহিংসামূলক। ব্যক্তিগত বিরাগের বশবর্তী হয়ে তিনি কর্মরত বিচারক হিসেবে আমাকে বিচারকার্য থেকে বঞ্চিত রেখে অসদাচরণ করেছেন, যা অভিশংসনযোগ্য। বাংলাদেশের সংবিধানের ১০৭ (৩) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী প্রধান বিচারপতি কর্মরত বিচারপতিদের নিয়ে বেঞ্চ গঠন করেন। তবে কর্মরত কোন বিচারপতিকে বিচারিক কার্যক্রম থেকে বঞ্চিত করে বেঞ্চ গঠন করার অধিকার সংবিধান প্রধান বিচারপতিকে দেয়নি। প্রধান বিচারপতি সংবিধান লঙ্ঘন করে আমাকে বিচারিক কার্যক্রম পরিচালনা করা থেকে বিরত রেখেছেন এবং এখনও পর্যন্ত আমাকে দায়িত্ব পালন করতে দিচ্ছেন না। রাষ্ট্রপতির কাছে করা আবেদনে বিচারপতি মানিক আরও বলেন, সুপ্রীমকোর্টের প্রথা অনুযায়ী অবসরে যাওয়া বিচারপতিগণকে বিদায় সংবর্ধনা দেয়া হয়। কিন্তু প্রধান বিচারপতি তার ব্যক্তিগত বিরাগের কারণে আমাকে বিদায় সংবর্ধনা থেকে বঞ্চিত করার উদ্দেশ্য সুপ্রীমকোর্টের দীর্ঘ দিনের রীতি ভেঙ্গে আমাকে বিচারিক বেঞ্চ থেকে বাদ দিয়েছেন। প্রধান বিচারপতি আমার প্রতি যে বৈষম্য ও জিঘাংসামূলক আচরণ করেছেন তা নিয়ম ভঙ্গ থেকেই প্রতীয়মান হয়। আবেদনে তিনি আরও লিখেছেন, আপীল বিভাগের একজন বিচারপতি হিসেবে আমার প্রতি প্রধান বিচারপতি যে বিরাগ ও বৈষম্যপূর্ণ আচরণ করেছেন, তার মাধ্যমে সুস্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয়, তিনি ন্যায়বিচার করতে অসমর্থ একজন ব্যক্তি এবং অনুরাগ বা বিরাগের বশবর্তী হয়ে বিচারকার্য সম্পন্ন করতে পারেন। প্রধান বিচারপতির এরূপ অন্যায় ও ব্যক্তিগত প্রতিহিংসামূলক সিদ্ধান্ত অন্য বিচারপতিদের বিচারিক স্বাধীনতা ক্ষুণœ করতে বাধ্য বলেও আবেদনে উল্লেখ করেন বিচারপতি মানিক। রাষ্ট্রপতির কাছে করা আবেদনে বিচারপতি মানিক আরও লিখেছেন, আমি প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার একজন সহকর্মী। প্রধান বিচারপতি তার সহকর্মী বিচারপতি হিসেবে আমার প্রতি বিরাগের বশবর্তী হয়ে যে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন তার মাধ্যমে প্রতীয়মান হয়, তিনি যে কোন অনুরাগ ও বিরাগের উর্ধে থেকে বিচারকাজ পরিচালনা করতে অক্ষম। প্রধান বিচারপতির এরূপ কার্যক্রম আইনের রক্ষক হিসেবে তার ভূমিকাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। তার ভূমিকা ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় অন্তরায়, অসাংবিধানিক ও সাংবিধানিক শপথ ভঙ্গ ও গুরুত্বর মিসকন্ডাক্ট, যা অভিশংসনযোগ্য বিধায় বিষয়টি সহানুভূতির সঙ্গে বিবেচনা করতে আপনার কাছে প্রেরণ করলাম। বিচারপতি মানিকের এই আবেদনের সঙ্গে গত ২৫ আগস্ট, ১ সেপ্টেম্বর, ২ সেপ্টেম্বর ও ৮ সেপ্টেম্বরের উভয় পক্ষের (প্রধান বিচারপতি ও বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী) চিঠি সংযুক্ত করা হয়েছে বলে আবেদনে উল্লেখ করা হয়। একই সঙ্গে রাষ্ট্রপতির কাছে করা এই আবেদনের অনুলিপি প্রধানমন্ত্রী, জাতীয় সংসদের স্পীকার, প্রধান বিচারপতি আইনমন্ত্রী এবং সুপ্রীমকোর্টের উভয় বিভাগের (আপীল বিভাগ ও হাইকোর্ট বিভাগ) বিচারপতিদের দেয়া হয়েছে বলে আবেদনে উল্লেখ রয়েছে।
×