ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

আবু সুফিয়ান কবির

নিজস্ব বসন খাদি

প্রকাশিত: ০৮:১৪, ১৪ সেপ্টেম্বর ২০১৫

নিজস্ব বসন খাদি

ঢাকার চলতি সময়ের জনপ্রিয় ফ্যাশন হাউসগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি ‘দেশাল’। প্রতিষ্ঠানটি খাদি নিয়ে সবচেয়ে বেশি কাজ করছে শুরু থেকেই। দেশালের সবুজ সিদ্দিকী জানালেন, ‘বর্তমানে দেশ-বিদেশে সবখানেই খাদি কাপড়ের চাহিদা রয়েছে। কেননা এই কাপড়টি সম্পূর্ণ পরিবেশবান্ধব। তবে চাহিদা থাকা সত্ত্বেও তা পূরণ করা সম্ভব হচ্ছে না। খাদি যে তুলায় হয় তা এখন পর্যাপ্ত উৎপন্ন হয় না। বর্তমানে যে তুলা উৎপন্ন হয় তা দিয়ে মোটা সুতা উৎপদন করা সম্ভব। আর মোটা সুতা মানেই মোটা কাপড়। তাই মোটা কাপড়ের পোশাক শুধু শীতেই চলে। তাই বস্ত্রের চাহিদা অনেক কমে গেছে। তাছাড়া এই পেশার সঙ্গে যে সব তাঁতি যুক্ত ছিল তারা অন্য পেশায় এসেছেন। তাই দক্ষ তাঁতি, কাঁচামাল বা তুলার স্বল্পতার কারণে খাদির উৎপাদন কম। সেই কারণে কাপড় উৎপাদন হয় খুব কম। তার পরেও দেশাল চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে খাদি কাপড় ব্যবহার করে যতদূর সম্ভব পোশাক তৈরি করার’। বাঙালী উৎসবপ্রিয় জাতি। উৎসবের জন্য চাই নানা আয়োজন, হরেক রকমের আনুষ্ঠানিকতার। উৎসবের দিনগুলোতে তাই চাই নানান পোশাক। বাঙালীর আদি উৎসব আর পরম্পরার বস্ত্র হলো খাদি। খাদির সঙ্গে জড়িয়ে আছে ঐতিহ্য আর আভিজাত্যের নানা দিক। ১৯১৭-১৮ সালের দিকে খাদি কাপড় জনপ্রিয় হয়ে ওঠে মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তের কাছে। মহাত্মা গান্ধীর স্বদেশী আন্দোলনের সময় খাদি চলে আসে সমালোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। কেননা মহাত্মা গান্ধী বিদেশী কাপড় বর্জনের ডাক দিলেন। নিজেও আন্দোলনের সামনে থেকে এই খাদি বস্ত্র পরেই পথশোভা করতেন। ফলে খাদি হয়ে পড়লো আমাদের নিজস্ব বসন। এক সময় ভারত স্বাধীন হলো। মানুষ রুচি ও আভিজাত্যে হয়ে উঠতে লাগল আধুনিক। আর এই আধুনিকতার ধারায় তাঁতে বোনা মোটা সুতার খাদি বস্ত্র হারিয়ে গেল। কেননা তখন পাওয়ার লুমের আরামদায়ক ও মিহি কাপড় সবার দৃষ্টি কাড়ল। ফলে নিজস্ব এই খাদি বস্ত্রের বাজারে বিপর্যয় নেমে আসে। এ অঞ্চলের আদিবাসী যোগী সম্প্রদায়ের লোকেরা খাদি বস্ত্র বুনন করত। এদের বসবাস ছিল চট্টগ্রাম, ফেনী ও কুমিল্লা অঞ্চলে। আস্তে আস্তে সেই খাদি বস্ত্রের ব্যবহার কমতে শুরু“করায় এই যোগী তাঁতি সম্প্রদায়ের লোকেরা অন্য পেশায় চলে গেলেন। খাদি নিয়ে শুরু হয় বিপর্যয়। বাংলাদেশ স্বাধীনতার পর খাদির উন্নয়নে যেসব প্রতিষ্ঠান ধীরগতিতে হলেও কাজ শুরু“করে এবং আস্তে আস্তে খাদিকে একটি সর্বজনীন রূপ দেয়ার চেষ্টা করছে, সেই ধরনের একটি প্রতিষ্ঠান ‘কুমুদিনী হ্যান্ডিক্রাফট’। এখানে খাদি দিয়ে সাধারণত যেসব পোশাক তৈরি হয় তার মধ্যে আছে শাড়ি, সালোয়ার-কামিজ, বাচ্চাদের সালোয়ার-কামিজ, ছেলেদের পাঞ্জাবি, ফতুয়া ও কটি। এদের থান তৈরি হয়ে আসে কুমিল্লা ও অন্যান্য এলাকা থেকে। খাদির সঙ্গে সিল্কের মিশ্রণ করা হয়েছে বৈচিত্র্য আনার জন্য। অনেক ক্ষেত্রে সুতা সরবরাহ করে কুমুদিনী কর্তৃপক্ষ এবং বুনন প্রক্রিয়া গ্রাফ ডিজাইন করে দিয়ে থাকে। এতে আমাদের ঐতিহ্যবাহী খাদি কাপড়ে নিজস্ব একটি ট্রেন্ড তৈরি হয়, যা একান্ত কুমুদিনীর নিজস্ব খাদি কাপড় হিসেবে পরিচিত। এভাবে কুমদিনী খাদি কাপড়কে জনপ্রিয় করছে এবং সর্বজনীন করতে সফল হচ্ছে অনেকাংশে। খাদি কাপড়ে বাহ্যিক চাকচিক্য নেই। উজ্জ্বলতা নেই বললেই চলে। তবে এই কাপড়ের সঙ্গে জড়িয়ে আছে স্বদেশিকতার ধারণা। কুমিল্লার খাদি কাপড় যেন আপন আঙ্গিকে প্রসার লাভ করতে সক্ষম হয়েছে। আর কুমিল্লার খাদির কথা উঠলেই প্রথমে চলে আসে শৈলেন গুহ ও তার ছেলে বিজন গুহ-এর কথা। ১৯৬৫ সালের দিকে ভাল সুতা পাওয়া যেত না। সেই সময় ‘দ্য খাদি কো অপারেটিভ’ এর হাল ধরেন শৈলেন গুহ। চান্দিনায় অবস্থিত এই প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন আকতার হামিদ। তারই প্রচেষ্টায় ১৯৬৮ সাল পর্যন্ত ভাল সুতা পাওয়া যেত। এর পর ভাল সুতার অভাবে মানসম্পন্ন খাদি কাপড় তৈরি করা সম্ভব হতো না। ১৯৮০ সালে বিপর্যস্ত এই শিল্পকে নিয়ে আবার কাজ শুরু“করেন শৈলেন গুহ। খদ্দর নিয়ে শুরু হয় নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা। তার প্রতিষ্ঠিত ‘গ্রামীণ খাদি’ খদ্দর কাপড় বিপণন ও সরবরাহের একটি সর্বজনীন প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। কুমিল্লার চান্দিনাতে এখন গহীন গ্রামে খাদি কাপড় তৈরি হচ্ছে। চান্দিনার বিভিন্ন গ্রাম থেকে নানা ধরনের খাদি কাপড় এনে পোশাক তৈরি করে বিপণন করছে ফ্যাশন হাউস অঞ্জনস। প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধার শাহিন আহমেদ। তিনি বলেন, ‘অঞ্জনস সাধারণত খাদি থান কাপড় সংগ্রহ করে চান্দিনার বিভিন্ন গ্রাম থেকে। কোন কোন ক্ষেত্রে নিজেরাই অর্ডার দিয়ে থান সংগ্রহ করে। এভাবে খাদির সঙ্গে অঞ্জনসের একটি নিজস্বতা সৃষ্টি হয়। এসব থান কাপড়ে নিজস্ব ঢঙ্গে ও মৌসুম বুঝে রঙ করা হয়। তারপর ডিজাইন শেকসন তৈরি করে নানা ধরনের খাদির পোশাক। সাধারণত বেশি তৈরি করা হয় সালোয়ার-কামিজ, ফতুয়া ও পাঞ্জাবি। ডিজাইনের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করা হয় হ্যান্ড এ্যাম্ব্রয়ডারি, স্ক্রিনপ্রিন্ট ও ব্লকপ্রিন্ট। আর গরমে খাদির বিকল্প পোশাক আর কিছুই হতে পারে না’। শাহিন আহমেদ আরও জানালেন, খাদি ঐতিহ্যগতভাবে আমাদের নিজম্ব কাপড়। কালের বিবর্তনে পোশাক শিল্পে এসেছে অনেক পরিবর্তন। তৈরি হচ্ছে উন্নত ধরনের কাপড়। যার ফিনিশিং অনেক ভাল। সব ঋতুতে ব্যবহার উপযোগী। কিন্তু খাদি কাপড় মোটা হওয়ার ব্যবহারে এর সীমাবদ্ধতা এসেছে। পরিবেশবান্ধব এই কাপড়ের ব্যবহার এখন শীতের পোশাক ছাড়া অন্য সময়ের পোশাকে করা সম্ভবপর হচ্ছে না। অঞ্জনস্ প্রতি শীত মৌসুমে শাল, কোটি ও পাঞ্জাবি তৈরি করে খাদি ব্যবহারের মাধ্যমে। খাদি কাপড়ের সবচেয়ে ভাল দিকটি হচ্ছেÑ এর সুতা তৈরি করে তাঁতিরা হস্তচালিত যন্ত্রে, আবার কাপড় বুনন করা হয় তাঁতে। তাই এটা পরিবেশবান্ধব। শুধু তাই নয় কাপড়ের প্রতিটি টানাপড়নে লেগে থাকে তাঁতির কোমল হাতের স্পর্শ। যদি এই কাপড়ে থিকনেস আনা সম্ভব হয়, তাহলে তা দিয়ে চলতি সময়ের সব পোশাক তৈরি করা সম্ভব। খাদিকে জনপ্রিয় করতে হলে অবশ্যই চাই সরকারী পৃষ্ঠপোষকতা। তবে শুধু গরমেই নয় সব সময়ের জন্য খাদি ব্যবহার উপযোগী করছে ডিজাইনাররা ও ব্র্যান্ড ইমেজের পোশাকের শোরুরুমগুলো। খাদিকে জনপ্রিয় ও সর্বজনীন করছে যেসব প্রতিষ্ঠান, তার মধ্যে আছে কুমুদিনী, আড়ং, প্রবর্তনা, কে ক্রার্ফট, নিত্য উপহার, অঞ্জনস, ওজি, বাংলার মেলা, নগরদোলা, অন্যমেলা, আবর্তন, এ্যাড্রয়েট, দেশ কারুপণ্য, নিপুণ, রঙ, শৈল্পিক, বিবিয়ানা, সাদাকালো, যাত্রা, শামুক, ফুলমনসহ আরও কিছু প্রতিষ্ঠান। খাদি সুতাকে শাড়ির থান হিসেবে ব্যবহার করে বেশ সফল হয়েছেন টাঙ্গাইল শাড়ি কুটির। খাদি দিয়ে এখন মানসম্পন্ন শাড়ি ও বিভিন্ন ধরনের পোশাক তৈরি হচ্ছে। পোশাকের আধুনিক ধারার সঙ্গে মিশে গেছে খাদি। তবে একে আরও উন্নত করতে হবে। ছবি : বাংলার মেলা
×