ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

শতাধিক হিমাগারে

প্রকাশিত: ০৫:৩০, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০১৫

শতাধিক হিমাগারে

শংকর কুমার দে ॥ সারাদেশের শতাধিক চাঞ্চল্যকর খুনের মামলার তদন্তের ভাগ্য চলে গেছে হিমাগারে। এসব মামলার মধ্যে এমন মামলাও আছে, রহস্য উদঘাটিত হয়নি বিগত অর্ধযুগেরও বেশি সময় ধরে। সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনী খুন থেকে শুরু করে ব্লগার, এ্যাডভোকেট, শিক্ষক-শিক্ষিকা, ব্যবসায়ী, রাজনীতিক খুনের ঘটনাগুলো দীর্ঘ সময়েও রহস্য উদঘাটিত না হওয়ায় তদন্ত কার্যক্রম ডিপফ্রিজে চলে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। কোন কোন খুনের মামলার তদন্ত কর্মকর্তা (আইও) পরিবর্তন করা হয়েছে এক ডজনেরও বেশি বার। এসব চাঞ্চল্যকর খুনের মামলা তদন্ত করছে পুলিশ, র‌্যাব, সিআইডি, ডিবি ও থানা পুলিশ। অথচ হত্যা রহস্য উদঘাটিত হচ্ছে না দীর্ঘদিনেও। চাঞ্চল্যকর খুনের মামলার তদন্তেরই যখন এই অবস্থা তখন অন্যান্য খুনের মামলার তদন্তের হাল কি হতে পারে তা সহজেই অনুমেয় বলে অভিমত ব্যক্ত করেছে অপরাধ বিশেষজ্ঞ মহল। পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থার সূত্রে জানা গেছে, ক্লুলেস খুনের ঘটনাগুলোর তদন্ত কর্মকর্তা বদল হয়েছে বার বার। অনেক খুনের ঘটনার রহস্য উন্মোচনে দীর্ঘসূত্রতায় পড়ে গেছে। আবার কিছু কিছু চাঞ্চল্যকর খুনের ঘটনা প্রকৃত আসামিদের বাঁচানোর জন্য তদন্তের গতি কমিয়ে রহস্যের জালে আটকে দেয়া হয়েছে। কোন কোন ঘটনায় খুনীরা এতই প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ও ধূর্ত যেÑ খুনের ঘটনা এমনভাবে ঘটানো হয়েছে যে, আসলেই ক্লুলেস(সূত্রবিহীন) করে রাখা হয়েছে। এসব ক্লুলেস খুনের ঘটনা তদন্তের এক পর্যায়ে এসে হাল ছেড়ে দিয়েছে তদন্ত কর্তৃপক্ষ। আবার এমনও হয়েছে যিনি একটি চাঞ্চল্যকর খুনের ঘটনা তদন্ত করছেন তার কাঁধে আরও একটি চাঞ্চল্যকর খুনের ঘটনা চাপিয়ে দেয়ায় তদন্ত কর্মকর্তা আর কূল-কিনারা করতে পারছেন না। ২০০৮ সালের ৩ ডিসেম্বর তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে ঢাকার লালমাটিয়ার নিজ বাসায় অগ্নিদ্বগ্ধ হয়ে মারা যান গণতন্ত্রী পার্টির সভাপতি নুরুল ইসলাম ও তার ছেলে তমোহর ইসলাম। কিন্তু এই খুনের ঘটনার রহস্য এখনও উদঘাটন করতে পারেনি পুলিশ। মীরহাজিরবাগে ২০০৮ সালের নবেম্বরে পরিবহন ব্যবসায়ী জুয়েল হোসেন ও তার বন্ধু পোশাক ব্যবসায়ী মারুফ হোসেন টুটুল খুন হন। রহস্যজনক এ জোড়া খুনের তদন্তে ১০ বার কর্মকর্তা বদল করা হয়। কিন্তু রহস্য উদ্ঘাটিত হয়নি। শুধু তাই নয়, গত কয়েক বছরের মধ্যে সাংবাদিক সাগর-রুনী, জাতীয় সংসদ ভবনের এমপি হোস্টেলে অজ্ঞাত মহিলা হত্যার রহস্য এখনও অনুদঘাটিত। এ চাঞ্চল্যকর অন্তত অর্ধশতাধিক হত্যা মামলার তদন্ত বছরের পর বছর চালিয়ে যাচ্ছে পুলিশ। কিন্তু খুন রহস্যের কোন কূল-কিনারা করতে তারা পারছে না তারা। এসব হত্যা মামলার তদন্তের বিষয়টি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে তদারকি করা হচ্ছে। র‌্যাব, সিআইডি, ডিবি ও থানা পুলিশ চাঞ্চল্যকর এসব হত্যা মামলার তদন্ত করছে। যেসব চাঞ্চল্যকর হত্যার রহস্য উদঘাটিত হয়নি তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছেÑ রাজধানীর টিকাটুলির সিক্স মার্ডার, মোহাম্মদপুরের শিক্ষিকা হত্যাকা-, পরিবাগের তুর্কি এ্যাসোসিয়েটস অফিসে রমজান আলী খুন, এ্যাডভোকেট খোরশেদ আলম বাচ্চু হত্যাকা-ের ঘটনা, মালিবাগে সানরাইজ হোটেলের ভেতর ডিবি ইন্সপেক্টর নুরুল আলম শিকদার ও এসআই আলমগীর হোসেন তালুকদার, পুরান ঢাকার ওয়ার্ড কমিশনার আহম্মদ হোসেন হত্যা, মিরপুরে ব্যবসায়ী আফতাব, প্রিন্স গ্রুপের মালিক কাজী শহিদুল হক, ওয়ার্ড কমিশনার মিস্টার, গুলশানে গৃহবধূ তাসমির হোসেন মুন্নী, পুরান ঢাকায় ব্যবসায়ী আজগর, খিলগাঁওয়ের ব্যবসায়ী ইসলাম শিকদার, বিজয়নগরে ব্যবসায়ী নজরুল, সবুজবাগে আজিজুল, মিরপুরে আওয়ামী লীগ নেতা সামাদ খান, মিরপুরে মিসুক সুপার মার্কেটের ব্যবসায়ী সান্টু, স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা মনু, ফকিরাপুলে ব্যবসায়ী সোহেল হোসেন টিটু, তেজগাঁও থানা ছাত্রলীগের সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক মিজানুর রহমান ও মিরপুরের কাপড় ব্যবসায়ী আলী আকবর, জাতীয় অন্ধ কল্যাণ সংস্থার মহাসচিব ইদ্রিস আলী বেপারি, বাড্ডায় থাই এ্যালুমিনিয়ামের ঠিকাদার আল আমিন, পুরান ঢাকার মহানগর পুস্তক বাঁধাই সমিতির সাধারণ সম্পাদক শহীদ, মতিঝিলে স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা কাউসার আলী, ধানম-ির জিগাতলায় বিএনপির ৪৮ নম্বর ওয়ার্ড সাধারণ সম্পাদক মোস্তফা জামান শিবলী, মোহাম্মদপুরে আবাসন কোম্পানি শেলটেকের কর্মকর্তা মাসুদ পারভেজ, রমনার ইঞ্জিনিয়ার এসএম শফিক-উল মওলা, রংপুর কারমাইকেল কলেজের ছাত্র হারিসুল ইসলাম বিপ্লব, ধানম-িতে সাবেক শিক্ষিকা কাজী সুহিন নাহার, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি প্রফেসর আফতাব আহমাদ। এ সময়ের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আলোচিত চাঞ্চল্যকর খুনের মামলার তদন্ত হিমাগারে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে তার মধ্যে রাজধানী ঢাকার রাজাবাজারে মাওলানা নুরুল ইসলাম ফারুকী, গোপীবাগে কথিত পীর লুৎফর রহমান ফারুক, খুলনায় তৈয়েবুর রহমান ও তার ছেলে মনির ও উত্তরায় জঙ্গী সংগঠন থেকে ফিরে আসা ফল ব্যবসায়ী মাসুম হত্যার ঘটনা এবং সাংবাদিক সাগর-রুনী দম্পতির। সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনীর ২০১২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি ভোরে পশ্চিম রাজাবাজারের ভাড়া ফ্ল্যাট থেকে ক্ষতবিক্ষত লাশ উদ্ধার করা হয়। ঘটনার পর মামলা তদন্ত করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। তদন্তের ৬২ দিনের মাথায় হাইকোর্টে ব্যর্থতা স্বীকার করে ডিবি। এর পর আদালতের নির্দেশে তদন্ত ভার নেয় র‌্যাব। তারা ভিসেরা পরীক্ষার জন্য সাগর-রুনীর লাশ কবর থেকে উত্তোলন করে। ঘটনার একমাত্র প্রত্যক্ষদর্শী নিহত দম্পতির শিশুপুত্র মাহী সরওয়ারের সঙ্গে দফায় দফায় কথা বলে র‌্যাব সদস্যরা। এ ছাড়া জিজ্ঞাসাবাদ করে শতাধিক ব্যক্তিকে। ঘটনাস্থল থেকে সংগ্রহ করা সাগর-রুনীর রক্তমাখা জামাকাপড়, বঁটি, মোজাসহ কিছু আলামত পরীক্ষার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের একটি গবেষণাগারে পাঠানো হয়। অভিজ্ঞ ফরেনসিক আলামত সংগ্রহকারীরা ওই ঘর থেকে আরও কিছু আলামত সংগ্রহ করেন ও ডিএনএ-সহ আলামত পরীক্ষার জন্য যুক্তরাষ্ট্রে পাঠানো হয়। ভিসেরা পরীক্ষার জন্য সাগর-রুনীর লাশ কবর থেকে ওঠানো হয়। এখন শুধু সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনী হত্যাকা-ের বিষয়ে সময়ক্ষেপণ ছাড়া আর কিছুই হচ্ছে না। গত সাড়ে তিন বছরে সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনী হত্যাকা-ের তদন্তের অবস্থা যেই তিমিরে ছিল সেই তিমিরেই রয়ে গেছে, রহস্য উদঘাটিত হয়নি। গোয়েন্দা সূত্র জানায, চাঞ্চল্যকর হত্যার মধ্যে কয়েকটি মামলা ঝুলে আছে প্রায় এক যুগেরও বেশি সময় ধরে। পাঁচ বছরেও হত্যাকা-ের মোটিভই উদ্ঘাটন করা সম্ভব হয়নি এমন মামলাও আছে। তদন্ত চলছে, শীঘ্রই অগ্রগতি সম্পর্কে তথ্য পাওয়া যাবে, এমন কিছু বক্তব্য দিয়েই পুলিশের তদন্ত সংস্থা দায় এড়িয়ে যাচ্ছে। প্রায় এক যুগেরও বেশি সময় ধরে যেসব হত্যাকা-ের রহস্য উদঘাটিত হয়নি তার মধ্যে ২০০৭ সালে রংপুর কারমাইকেল কলেজের ছাত্র হারিসুল ইসলাম বিপ্লব, ২০০৫ সালে তেজগাঁওয়ে এ্যাডভোকেট খোরশেদ আলম বাচ্চু, ধানম-িতে সাবেক শিক্ষিকা কাজী সুহিন নাহার ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি প্রফেসর আফতাব আহমাদ হত্যাকা- ঘটে ২০০৬ সালে ও রমনার ইঞ্জিনিয়ার এসএম শফিক-উল মওলা খুন হন ২০০২ সালে। এসব খুনের ঘটনা এখনও অনুদঘাটিত। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, মামলার বাদী ও সাক্ষীরা তদন্ত কর্মকর্তাদের কাছে প্রতিনিয়ত হয়রানির শিকার হচ্ছেন। তাদের কাছে দাবি করা হচ্ছে মোটা অঙ্কের টাকা। টাকা না দিলে মামলার চার্জশীট দিতে বিলম্ব করছেন তদন্ত কর্মকর্তারা। তা ছাড়া মামলা প্রত্যাহার করতে বাদীদের হুমকি দেয়া হচ্ছে। মামলার ভবিষ্যত নিয়ে সন্দীহান বাদীরা। কোন কোন ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, হত্যাকা-ের মূল আসামিদের বাদ দিয়ে নিরপরাধীদের আসামি করে চার্জশীট দেয়া হচ্ছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকাভুক্ত চাঞ্চল্যকর মামলাগুলোর ভাগ্য ঝুলে আছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ সিআইডির হাতে। অগ্রগতি নেই বেশিরভাগ মামলার তদন্তে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের চাঞ্চল্যকর মামলাসংক্রান্ত সর্বশেষ বৈঠক হয়েছিল গত বছর। তারপর আর বৈঠকও হয়নি। অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ, পুলিশের অদক্ষতা ও অজ্ঞাত কারণে চাঞ্চল্যকর হত্যা মামলার রহস্য অনুদঘাটিত রয়ে যাচ্ছে। আসামিরাও চিহ্নিত হচ্ছে না। বিচার পাচ্ছেন না নিহতদের পরিবারের সদস্যরা। তবে খুনীরা এমন কিছু আলামত রেখে যায় তাতে খুনীদের শনাক্ত করা খুব সহজ। প্রযুক্তির ব্যবহার করে হত্যার রহস্য উদ্ঘাটন করতে পারে এমন দক্ষতা পুলিশের মধ্যে গড়ে ওঠেনি। পুলিশের দক্ষতা বাড়াতে বিভিন্ন কর্মসূচী হাতে নেয়া দরকার। অন্যথায় পুলিশের প্র্রতি মানুষের আস্থা দিন দিন হারিয়ে যাবে। পুুলিশ সদর দফতরের এক শীর্ষ কর্মকর্তা বলেছেন, মনিটরিং সেলে যেসব মামলা রয়েছে সেখানে রাজনৈতিক বিবেচনার কারণে তদন্ত ব্যাহত হচ্ছে। ঢাকার বাইরে যেসব মামলা আছে সেখানেও একই অবস্থা। কয়েকটি হত্যা মামলার সঙ্গে সরকারদলীয় এমপি, সন্ত্রাসী, নেতা-কর্মী জড়িত থাকায় ও তদন্তে সরকারদলীয় প্রভাব এবং তদন্ত কর্মকর্তাদের বিতর্কিত কর্মকা-েরও বেশ কিছু মামলার তদন্ত চলে গেছে হিমাগারে।
×