ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

এমডিজি লক্ষ্য অর্জনে সফলতার পাল্লাই ভারি

প্রকাশিত: ০৫:৩৩, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০১৫

এমডিজি লক্ষ্য অর্জনে সফলতার পাল্লাই ভারি

অর্থনৈতিক রিপোর্টার ॥ সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার (এমডিজি) লক্ষ্য পূরণে বাংলাদেশের অগ্রগতি প্রশংসনীয়। এক্ষেত্রে সাফল্যের পাল্লাই ভারি হয়েছে। আটটি লক্ষ্যের মধ্যে অনেকগুলোতেই এসেছে সফলতা। এগুলো হলো- দারিদ্র্য ও চরম দারিদ্র্যের গভীরতা কমানো, সার্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষা অর্জন, জেন্ডার সমতা এবং নারীর ক্ষমতায়ন, মাতৃস্বাস্থ্যের উন্নয়ন, শিশুমৃত্যু কমানো, মাতৃস্বাস্থ্যের উন্নয়ন, এইচআইভি/এইডস ও অন্যান্য রোগব্যাধি দমন এবং পরিবেশগত স্থিতিশীলতা নিশ্চিতকরণ। তবে খারাপ অবস্থায় রয়েছে সার্বিক উন্নয়নে বিশ্বব্যাপী অংশীদারিত্ব গড়ে তোলার ক্ষেত্রে। বাকি চারটির মধ্যে একটি পূরণের কাছাকাছি ও অন্যগুলোও সঠিক পথেই রয়েছে। এমডিজির মূল্যায়ন প্রতিবেদনে এ চিত্র উঠে এসেছে। বুধবার রাজধানীর একটি হোটেলে প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়েছে। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। বিশেষ অতিথি ছিলেন- পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী, বাংলাদেশ ব্যাংকের গবর্নর ড. আতিউর রহমান, ইউএনডিপির আবাসিক সমন্বয়কারী পাওলিন থেমাসিস এবং অর্থ ও পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী এমএ মান্নান। পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে অগ্রগতির বিষয়টি উপস্থাপন করেন সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের (জিইডি) সদস্য (সিনিয়র সচিব) ড. শামসুল আলম। প্রধান অতিথির বক্তব্যে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেন, শিক্ষা, দারিদ্র্যহার, স্বাস্থ্য, সুপেয় পানি, সমতা অর্জনসহ এমডিজির বিভিন্ন ক্ষেত্রে লক্ষ্য অর্জিত হয়েছে। দারিদ্র্য কমানোর ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট সময়ের আগেই ২০১৩ সালে লক্ষ্য অর্জন হয়েছে। সাউথ সাউথ কো-অপারেশনের সঙ্গে বাংলাদেশ যুক্ত রয়েছে। এমডিজি আমাদের দেশের অনেক ক্ষেত্রে পরিবর্তন এনে দিয়েছে। এই উদ্যোগ টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনে কাজে লাগবে। তিনি আরও বলেন, গত ১৫ বছরে যেভাবে দারিদ্র্য কমাতে আমরা সক্ষম হয়েছি এতে করে আগামী ১৫ বছরে অর্থাৎ ২০৩০ সালের মধ্যেই দারিদ্র্য শূন্যের কোটায় নিয়ে আসতে সক্ষম হব। বিশেষ অতিথির বক্তব্যে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী বলেন, সরকারের বিভিন্ন কার্যকরী পদক্ষেপের ফল হচ্ছে এমডিজির অর্জন। আমরা সব সময় উন্নয়নের পথে হাঁটছি। জনগণকে সঙ্গে নিয়ে চলার কারণেই প্রবৃদ্ধি অর্জন, দারিদ্র্য নিরসন ও পাঁচ বছরের শিশু মৃত্যুহার কমানোসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে লক্ষ্য অর্জিত হয়েছে। এই সাফল্য ধরে রাখতে কাজ করছে সরকার। সভাপতির বক্তব্যে পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেন, এমডিজির লক্ষ্য অর্জনে জাতিসংঘের ভূমিকা রয়েছে। প্রতি বছর আমরা ১ দশমিক ৭৪ শতাংশ হারে দারিদ্র্য কমাতে সক্ষম হয়েছি। তাই আশা করছি, ২০১৮ সালের মধ্যেই দারিদ্র্য এ দেশে আর থাকবে না। প্রধানমন্ত্রী প্রায়ই বলেন, আমরা বীরের জাতি, আমরা কখনও পরাজিত হইনি আর হবও না। তাই আমরা আগামীর চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় মানুষকে শতভাগ শিক্ষিত করে গড়ে তোলার কাজ চালিয়ে যাচ্ছি। অর্থ প্রতিমন্ত্রী এমএ মান্নান বলেন, আমরা কোন তলাবিহীন ঝুড়ি নই। আমরা পেরেছি এবং আগামীতেও পারব। ড. আতিউর রহমান বলেন, বাংলাদেশ বিশ্বের মধ্যে রোল মডেল। গত কয়েক বছর ধরে ৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হচ্ছে। আশা করছি চলতি অর্থবছরে ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হবে। বাংলাদেশ ব্যাংক আর্থিক খাতের অগ্রগতি ধরে রেখে দেশের উন্নয়নে কাজ করছে। ইউএনডিপির পাওলিন থেমাসিস বলেন, বাংলাদেশের অর্জন প্রশংসনীয়। আশা করছি, এমডিজির মতো এসডিজিতেও সাফল্য আসবে। অগ্রগতি প্রতিবেদনে দেখা গেছে, আটটি লক্ষ্যের মধ্যে সাতটিতেই এসেছে সফলতা। বাংলাদেশ ক্ষুধা ও দারিদ্র্য নির্মূলে প্রশংসনীয় অগ্রগতি সাধন করেছে। গত কয়েক বছর যাবত দেশ নিয়মিতভাবেই ৬ শতাংশের উপরে প্রবৃদ্ধি অর্জন করছে, যা দারিদ্র্য হ্রাসের ক্ষেত্রে ইতিবাচক ভূমিকা রেখেছে। অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধির কারণে ১৯৯১-৯২ সালের ৫৬ দশমিক ৭ শতাংশ থেকে ২০১০ সালে দারিদ্র্যের হার ৩১ দশমিক ৫ শতাংশে নেমে এসেছে। গত দশকের চেয়ে বর্তমান দশকে দারিদ্র্য হ্রাসের হার ছিল দ্রুততর। সর্বশেষ খানা আয়-ব্যয় জরিপ ২০১০ অনুযায়ী বাংলাদেশে ২০০০-২০১০ মেয়াদে গড়ে প্রতি বছর দারিদ্র্য কমেছে ১ দশমিক ৭৪ শতাংশ হারে, যদিও সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে একই সময়ে প্রয়োজন ছিল গড়ে প্রতি বছর ১ দশমিক ২০ শতাংশ হারে দারিদ্র্য হ্রাস। ২০১৫ সালের মাথাগুনতি দারিদ্র্যের হার দাঁড়িয়েছে ২৪ দশমিক ৮ শতাংশে। বাংলাদেশ ২০১০ সালেই দারিদ্র্য ও চরম দারিদ্র্যের গভীরতা কমানো শীর্ষক অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জনে সক্ষম হয়েছে। দারিদ্র্য ও চরম দারিদ্র্যের গভীরতার (ক্ষিপ্রতা) ক্ষেত্রে ২০১৫ সালের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৮ শতাংশ, এই হার নেমে এসেছে ৬ দশমিক ৫ শতাংশে। যে হারে দারিদ্র্য কমছে এতে প্রাক্কলিত হিসাবে ২০১২ সালেই বাংলাদেশ ভিত্তিবছরের তুলনায় দারিদ্র্যের হার অর্ধেকে নামিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছে। ক্ষুধা নিরসনেও বাংলাদেশ ভাল অগ্রগতি সাধন করেছে। সার্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষা অর্জনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের রয়েছে অবাক করা সাফল্য। শিক্ষায় ন্যায়সঙ্গত প্রবেশাধিকার (প্রাথমিক শিক্ষায় নিট ভর্তি হার ৯৭.৭ শতাংশ (বালকদের ক্ষেত্রে এই হার ৯৬.৬ ও বালিকাদের ক্ষেত্রে ৯৮.৮ শতাংশ), ঝড়ে পড়ার হার কমানো, শিক্ষাচক্র সমাপ্তির ক্ষেত্রে উন্নতি সাধন এবং প্রাথমিক শিক্ষায় গুণগতমান বৃদ্ধির জন্য পর্যাপ্ত ব্যবস্থা গ্রহণ ইত্যাদি কারণে এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সাধিত হয়েছে। ১৫ বছরের বেশি বয়সী জনসংখ্যার শিক্ষার হার ১৯৯০ সালে ছিল ৩৭ দশমিক ২ শতাংশ, সেটি বৃদ্ধি পেয়ে বর্তমানে ৬১ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ ইতোমধ্যেই জেন্ডার সমতা অর্জন এবং নারীর ক্ষমতায়ন শীর্ষক লক্ষ্যটি অর্জন করেছে। অর্থাৎ প্রাথমিক এবং মাধ্যমিক শিক্ষা উভয় ক্ষেত্রেই বাংলাদেশ নারী-পুরুষের সমতা অর্জনে অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জনে সক্ষম হয়েছে। ডিপিই’র তথ্য ২০১৪ সালে প্রাথমিক শিক্ষায় ছেলে ও মেয়ের অনুপাত ১.০৩, যা ১৯৯০ সালে ছিল শূন্য দশমিক শূন্য ৮। মাধ্যমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে এ হার ১৯৯০ সালের শূন্য দশমিক ৫২ থেকে বেড়ে ২০১৪ সালে দাঁড়িয়েছে ১ দশমিক ১৪ শতাংশে। একই সূত্রমতে এ সময়ের মধ্যে উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে এ হার শূন্য দশমিক ৩৭ থেকে বেড়ে হয়েছে শূন্য দশমিক ৬৭ শতাংশ (অর্থাৎ ১০০ ছাত্রের বিপরীতে ৬৭ জন ছাত্রী)। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মাতৃস্বাস্থ্যের উন্নয়নেও বাংলাদেশ রোল মডেল হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। এমএমইআইজি ২০১৩ অনুযায়ী ১৯৯০ সালে মাতৃ মৃত্যুর হার ছিল বছরে ৫৭৪ জন, যা ২০১৩ সালে হয়েছে ১৭০ জন। জরিপের বিভিন্ন সালের উপাত্ত হতে প্রতীয়মান হয় যে, সামগ্রিকভাবে প্রজনন বয়সের নারীদের ক্ষেত্রে মৃত্যুহার বিগত বছরগুলোতে ধারাবাহিকভাবে হ্রাস পেয়েছে। সন্তান জন্মদানের ক্ষেত্রে প্রশিক্ষিত স্বাস্থ্যকর্মীর নিকট সেবা গ্রহণের হার গত দুই দশকে প্রায় আটগুণ বেড়েছে। বাংলাদেশে শিশু মৃত্যুহার কমানো বিষয়ক সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যের বিভিন্ন নির্দেশক যথা পাঁচ বছরের কম বয়সের শিশু মৃত্যুহার, এক বছরের কম বয়সের শিশু মৃত্যুর হার ও হামের টিকা প্রদান ইত্যাদি ক্ষেত্রে লক্ষ্য অর্জনের পথে রয়েছে। ১৯৯০ সালে পাঁচ বছরের কম বয়সের শিশু মৃত্যুর হার ছিল প্রতি এক হাজার জীবিত জনে ১৬৪ জন, যা ২০১৩ সালে নেমে এসেছে ৪৬ জনে। অর্থাৎ এই সূচকের ক্ষেত্রে নির্ধারিত সময়ের আগেই বাংলাদেশ লক্ষ্য অর্জনে সক্ষম হয়েছে। এক্ষেত্রে লক্ষ্য ছিল ২০১৫ সালে ৪৮ জন। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশে এইচআইভির প্রাদুর্ভাব এখনও অনেক কম (শতকরা শূন্য দশমিক ১ ভাগেরও কম), যা মহামারী সীমার নিচেই রয়েছে। পরিবেশগত স্থিতিশীলতা নিশ্চিতকরণের ক্ষেত্রেও বাংলাদেশ খারাপ অবস্থায় নেই। ১৯৯০ সালে দেশে বনাচ্ছাদিত ভূমির পরিমাণ ছিল ৯ শতাংশ, যা ২০১৪ সালে ১৩ দশমিক ৪ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। এ সময়ে ওজন ক্ষয়কারী পদার্থের পরিমাণ ২০২ টন থেকে হ্রাস পেয়ে ৬৪ দশমিক ৮৮ টন হয়েছে। সার্বিক উন্নয়নে বিশ্বব্যাপী অংশীদারিত্ব গড়ে তোলার ক্ষেত্রে বলা হয়েছে, গত দুই দশকের বেশি সময় ধরে বাংলাদেশে গড় বার্ষিক বৈদেশিক উন্নয়ন সহায়তার পরিমাণ ছিল ১ দশমিক ৭৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। মোট দেশজ উৎপাদনের তুলনায় বৈদেশিক উন্নয়ন সহায়তার পরিমাণ ১৯৯০-৯১-এর ৫ দশমিক ৫৯ শতাংশ থেকে ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ১ দশমিক ৭৮ শতাংশে নেমে এসেছে। এই সময়ে মাথাপিছু বৈদেশিক উন্নয়ন সহায়তা অবমুক্তির পরিমাণ ১৯ দশমিক ৭৯ মার্কিন ডলার থেকে ৭ দশমিক ৬০ মার্কিন ডলারে নেমে এসেছে। ১৯৯০-৯১ অর্থবছর থেকে ২০১৩-১৪ অর্থবছরে বৈদেশিক উন্নয়ন সহায়তার গড় বার্ষিক পরিমাণ ছিল ঋণ ও অনুদান মিলে যথাক্রমে ৬৩৫ মিলিয়ন ও এক হাজার ১০১ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। মোট ৩৪টি ওইসিডি দেশের মধ্যে মাত্র ৯টি দেশ ২০১৩-১৪ অর্থবছরে বাংলাদেশকে ৭৪৮ দশমিক শূন্য ২ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বৈদেশিক উন্নয়ন সহায়তা প্রদান করেছে। এটি ওই বছরের মোট বৈদেশিক সহায়তার মাত্র ২২ দশমিকক ২৩ ভাগ। সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবায়নে এসব সহায়তার পরিমাণ ছিল চরমভাবে অপ্রতুল এবং উন্নত দেশগুলোর অধিকাংশই সহায়তা প্রদানে প্রদত্ত প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেনি।
×