ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

চারজনের ছবিসহ সীমান্ত ও বিমান বন্দরে বিশেষ বার্তা ॥ ব্লগার বাবু হত্যাকারীদের বিষয়ে সতর্কতা

প্রকাশিত: ০৫:৪০, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০১৫

চারজনের ছবিসহ সীমান্ত ও বিমান বন্দরে বিশেষ বার্তা ॥ ব্লগার বাবু হত্যাকারীদের বিষয়ে সতর্কতা

গাফফার খান চৌধুরী ॥ ব্লগার ওয়াশিকুর রহমান বাবু হত্যার চার্জশীটভুক্ত পলাতক দু’জনসহ ৪ জনের ছবিসহ সীমান্তে ও বিমানবন্দরগুলোতে বিশেষ বার্তা পাঠানো হয়েছে। বিশেষ সতর্কতা জারি করা হয়েছে তাদের দেশত্যাগের বিষয়ে। বিমানবন্দর ও সীমান্ত রক্ষী বাহিনীকে বিশেষভাবে সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে। ত্রিশালের ছিনতাইকৃত তিন জঙ্গীর মধ্যে আজও দুই জঙ্গী গ্রেফতার হয়নি। সেদিক বিবেচনায় রেখে সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে এমন নির্দেশনা জারি হয়েছে। বাবু হত্যায় পলাতক ৪ জন দেশেই আত্মগোপনে রয়েছে বলে গোয়েন্দাদের ধারণা। ইতোমধ্যেই তাদের গ্রেফতারে ঢাকা ও কয়েকটি জেলায় কয়েক দফা অভিযানও চালানো হয়েছে। তবে এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত ৪ জনের কেউ গ্রেফতার হয়নি। চলতি বছরের ৩০ মার্চ সকাল সাড়ে আটটায় ঢাকার তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানাধীন বেগুনবাড়ির নিজ বাসা থেকে মতিঝিল কর্মস্থলে যাওয়ার পথে প্রকাশ্যে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করা হয় ব্লগার ওয়াশিকুর রহমান বাবুকে (২৭)। নিহত বাবু ফেসবুকসহ বিভিন্ন অনলাইনে পবিত্র ইসলাম ধর্মের নানা বিষয় নিয়ে লিখতেন। বাবু রাজধানীর ফার্মগেট তেজগাঁও কলেজ থেকে লেখাপড়া শেষ করেন। মতিঝিল ফারইস্ট এভিয়েশন নামে একটি ট্র্যাভেল এজেন্সিতে প্রশিক্ষক হিসেবে চাকরি করতেন। পিতার নাম টিপু সুলতান। বাড়ি লক্ষ্মীপুর জেলার রামগঞ্জ উপজেলার হাজীপুর গ্রামে। ‘বোকা মানব’ নামে নিজস্ব এ্যাকাউন্ট থাকলেও, একাধিক ফেসবুক এ্যঅকাউন্টে লেখালেখি করতেন বাবু। বাবুকে হত্যার পর পালানোর সময় জিকরুল্লাহ ও আরিফুল ইসলামকে ধরে পুলিশে সোপর্দ করে হিজড়ারা। গ্রেফতারকৃতরা পুলিশকে জানায়, ইমানি দায়িত্ব পালন করতেই বাবুকে হত্যা করা হয়েছে। ওইদিনই গ্রেফতারকৃত দু’জন ছাড়াও আবু তাহের এবং মাসুম নামের আরেকজনকে আসামি করে তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানায় মামলা করেন নিহতের ভগ্নিপতি মনির হোসেন মাসুদ। মামলাটির তদন্তের দায়িত্ব পায় ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের পশ্চিম বিভাগের পরিদর্শক মশিউর রহমান। আসামি জিকরুল্লাহ ও আরিফকে জিজ্ঞাসাবাদে বেরিয়ে আসতে থাকে বাবু হত্যার নেপথ্য কারণ। তাদের বক্তব্যে জড়িত সাইফুল ইসলামের নাম প্রকাশ পায়। এদিকে ব্লগার বাবুকে হত্যার আগেই গত ২৪ মার্চ যাত্রাবাড়ী বাসস্ট্যান্ডে পুলিশের তল্লাশিকালে পিস্তল ও চাপাতিসহ গ্রেফতার হয় সাইফুল ইসলাম। জিকরুল্লাহ ও আরিফের বক্তব্যে সাইফুলের নাম আসায় তাকে এ মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়। পরবর্তীতে সাইফুল ইসলাম বাবু হত্যার দায় স্বীকার করে আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দী দেয়। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, সাইফুল ইসলামের জবানবন্দী মোতাবেক ওয়াশিকুর রহমান বাবু হত্যার প্রথম পরিকল্পনা হয় রাজধানীর পল্লবী থানাধীন ইকবালের বাড়িতে। সেখানে ইকবাল ও আরিফ প্রথম ওয়াশিকুর রহমান বাবুকে হত্যার পরিকল্পনা করে। পরিকল্পনার বিষয়টি সে ছাড়াও ইকবাল, শরীফ, তাহের, আকতার, জিকরুল্লাহ ও আরিফ জানত। ডিবি সূত্রে জানা গেছে, চূড়ান্ত হত্যার পরিকল্পনা এবং বাস্তবায়নের দায়িত্ব নেয় হাসিব আব্দুল্লাহ ওরফে মাছুম ওরফে ইকবাল। তিনি উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত। হত্যায় অংশ নেয়ারা বাড়ি থেকে পড়াশোনার চাপ থাকায় দীর্ঘ সময় বাড়িতে যেতে পারবে না বলে পরিবারকে জানায়। এরপর তারা বাড়ি থেকে মাদ্রাসায় না গিয়ে যাত্রাবাড়ী এলাকার কাজলার নয়ানগরে সেলিনা বেগমের মালিকানাধীন পাঁচতলা বাড়ির পঞ্চম তলার ভাড়া ফ্ল্যাটে ওঠে। ফ্ল্যাটটি নিষিদ্ধ জঙ্গী সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের সদস্য হাসিব আব্দুল্লাহ গত ১ জানুয়ারি ভাড়া নেয়। সেই ফ্ল্যাটেই দফায় দফায় বৈঠক হয়। আড়াই মাস ধরে সেখানে প্রশিক্ষণ নেয় হত্যাকারীরা। গত ১৫ মার্চ বাবুকে হত্যার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয় যে তাহের হত্যা মিশনের প্রধান দায়িত্ব পালন করবে। যেখানে হত্যা করা হবে, সেই জায়গা রেকি করতে গত ২৪ মার্চ তাহের, জিকির, আরিফ ও সাইফুল হাতিরঝিলে মিলিত হওয়ার উদ্দেশ্যে যাত্রাবাড়ী থেকে রওনা দেয়। সবাই আলাদা আলাদাভাবে রওনা হয়। যাত্রার পরেই যাত্রাবাড়ীতে সাইফুল পুলিশের চেকপোস্টে একটি চাপাতি ও গুলি ভর্তি পিস্তলসহ ধরা পড়ে। সাইফুল ধরা পড়ার পরদিনই অন্যরা ওই বাসা ছেড়ে দেয়। এরপর গত ২৯ মার্চ বিকেলে হাতিরঝিলে হাসিব আব্দুল্লাহ ওরফে মাছুম ওরফে ইকবালের নেতৃত্বে সাইফুল ছাড়া অন্যরা মিলিত হয়। ওইদিনই হাসিব তাদেরকে রেকি করতে সহযোগীদের বাবুর বাড়ির সামনে নিয়ে যায়। ৩০ মার্চ সকাল থেকেই দক্ষিণ বেগুনবাড়িতে বাবুর বাড়ির সামনের রাস্তায় অপেক্ষা করছিল তারা। বাবু বাড়ি থেকে বের হওয়ার পর প্রথমেই তাহের চাপাতি দিয়ে কোপাতে থাকে। এরপর জিকরুল্লাহ চাপাতি দিয়ে মাথায় কোপ দেয়। আরিফের কাছে চাপাতি থাকলেও সে আঘাত করেনি। অন্যরা পালিয়ে যেতে পারলেও ধরা পড়ে জিকরুল্লাহ ও আরিফ। আরিফ ও জিকরুল্লাহ এবং সাইফুলের দেয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দীর সূত্র ধরে গত ১ সেপ্টেম্বর ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের পশ্চিম বিভাগের পরিদর্শক মোঃ মশিউর রহমান ঢাকার সিএমএম আদালতে মামলাটির চার্জশীট দাখিল করেন। চার্জশীটভুক্ত আসামিরা হচ্ছে আরিফুল ইসলাম, জিকরুল্লাহ ওরফে জিকির, সাইফুল ইসলাম, জুনায়েদ ওরফে তাহের ও হাসিব ওরফে আব্দুল্লাহ। আসামিদের মধ্যে আরিফুল ইসলাম ও জিকরুল্লাহ হত্যাকা-ের পর পরই জনতার হাতে ধরা পড়ে এবং ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দেয়া সাইফুল ইসলাম কারাগারে রয়েছে। পলাতক রয়েছে জুনায়েদ ওরফে তাহের এবং হাসিব আব্দুল্লাহ ওরফে মাছুম ওরফে ইকবাল। অভিযোগপত্রে ৪০ জনকে সাক্ষী করা হয়েছে। ডিবির যুগ্ম কমিশনার মনিরুল ইসলাম জানিয়েছেন, বাবু হত্যা মামলায় সন্দেহভাজন আরও দু’জনের বিষয়ে তদন্ত চলছে। হত্যাকা-ের সঙ্গে তাদের জড়িত থাকার বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া গেলে সম্পূরক চার্জশীটে তাদের নাম অন্তর্ভুক্ত করা হবে। তদন্ত সূত্রে জানা গেছে, সন্দেহভাজন দুই আসামি শরীফ ও আকতার। চার্জশীটভুক্ত ৫ জনের মধ্যে আব্দুল্লাহ ছাড়া বাকি ৪ জনই মাদ্রাসার ছাত্র। ঘটনার পর হিজড়াদের হাতে ধরা পড়া জিকরুল্লাহ ও আরিফ চট্টগ্রামের হাটহাজারী মাদ্রাসার ছাত্র। পুলিশের কাছে তারা পবিত্র ইসলাম ধর্ম নিয়ে আপত্তিকর লেখালেখি করায় ইমানি দায়িত্ব পালন করতেই বাবুকে হত্যা করা হয়েছে বলে দায় স্বীকার করে। তবে তারা আদালতে স্বীকার করেনি। এ ব্যাপারে ডিবির পশ্চিম বিভাগের অতিরিক্ত উপকমিশনার সাইফুল ইসলাম জানান, চার্জশীটভুক্ত পলাতক দু’জন এবং সন্দেহভাজন পলাতক দুই আসামিসহ ৪ জনের ছবিসহ বিশেষ বার্তা পাঠানো হয়েছে দেশের বিমানবন্দর ও সীমান্ত পয়েন্টগুলোতে। তারা যাতে কোনক্রমেই দেশত্যাগ করতে না পারে এজন্য গোয়েন্দা নজরদারি অব্যাহত আছে। পলাতকরা দেশেই আত্মগোপনে রয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ডিবির পশ্চিম বিভাগের উপকমিশনার সাজ্জাদুর রহমান জানান, পলাতকদের গ্রেফতারে ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলায় ইতোমধ্যেই কয়েকটি অভিযান চালানো হয়েছে। তাদের গ্রেফতারে সর্বোচ্চ চেষ্টা চলছে।
×