ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

পল্লীবিদ্যুতের মূল্য পুনর্নির্ধারণ চায় কর্তৃপক্ষ

প্রকাশিত: ০৫:৪১, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০১৫

পল্লীবিদ্যুতের মূল্য পুনর্নির্ধারণ চায় কর্তৃপক্ষ

রশিদ মামুন ॥ আবারও বিদ্যুতের মূল্য পুনর্নির্ধারণ চাইছে বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (আরইবি)। দ্রুত বিদ্যুতের মূল্যহার বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত জানাতে গিয়ে কারিগরি ত্রুটিতে এমন প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। আর এর মধ্য দিয়ে জ্বালানি খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) অদক্ষতার চিত্র ফুটে উঠেছে। কমিশনের ভুলের কারণে আবারও মূল্য সমন্বয়ের উদ্যোগ নিলে জনমনে অসন্তোষ ছড়িয়ে পড়বে। আর মূল্য সমন্বয় না হলে বিদ্যুতের সম্প্রসারণ বাধাগ্রস্ত হবে। বিইআরসিকে দেয়া চিঠিতে আরইবি বলছে বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির সময় কয়েকটি ধাপে দাম বৃদ্ধির বদলে কমানো হয়েছে। এতে বছরে তাদের ৯০২ কোটি টাকা লোকশান গুনতে হবে। বিশাল এই লোকশানের ঝক্কি সামাল দিতে গিয়ে সারাদেশে দ্রুত বিদ্যুতের সম্প্রসারণ বাধাগ্রস্ত হওয়ার পাশাপাশি সমিতিগুলো রুগ্ণ হয়ে পড়বে। বিইআরসি সূত্র জানায়, বিশ্বময় জ্বালানি তেলের অব্যাহত দর পতনের ফলে বিদ্যুতের দাম এবার বাড়বে না বিষয়টি ধরেই নেয়া হয়েছিল। সেজন্য বিইআরসি বিদ্যুতের মূল্যহার বৃদ্ধির প্রক্রিয়া নিয়ে গণশুনানির পর আর তেমন কোন কাজই করেনি। কিন্তু আকস্মিকভাবে গত ২৬ আগস্ট প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে বিদ্যুত গ্যাসের দাম বৃদ্ধি সংক্রান্ত একটি বৈঠক হয়। ওই বৈঠকে বিইআরসিকে বলা হয় পরদিন বিকেলের মধ্যে বিদ্যুতের দাম বাড়াতে হবে। আর গত ২৭ আগস্ট বিদ্যুতের নতুন মূল্যহার ঘোষণা করে বিইআরসি, যা গত ১ সেপ্টেম্বর থেকে কার্যকর হয়। সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, দাম বৃদ্ধি করা আর লাইসেন্স প্রদান ছাড়া বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের কোন কাজ নেই। সারা বছরই এখানের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা অলস সময় পার করেন। কেবলমাত্র মূল্যহার সমন্বয়ের সময়ই কমিশনকে কিছুটা কর্মক্ষম দেখা যায়। মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাব পাওয়ার পর দীর্ঘ সময় নিয়ে কমিশনের কারিগরি কমিটি বিভিন্ন পরামর্শক মিলে একটি সুপারিশ তৈরি করে। সঙ্গত কারণে মাত্র একদিনের মধ্যে নতুন মূল্য নির্ধারণ করতে গিয়ে কমিশনের অদক্ষ কর্মকর্তারা খুব বড় কারিগরি ভুল করে ফেলেছেন। যার মাশুল দিতে হবে আরইবিকে। আর সারাদেশের বিদ্যুতের সম্প্রসারণ প্রক্রিয়াও বাধাগ্রস্ত হবে। এমনিতে সারাদেশের মানুষ বিদ্যুতের মূল্যহার বৃদ্ধিতে ক্ষুব্ধ। নতুন করে আবার দাম নির্ধারণ করা হলে সাধারণের মধ্যে আবার নেতিবাচক ধারণা ছড়িয়ে পড়বে। বিদ্যুত বিভাগের একাধিক সূত্রের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে সারাদেশে বিদ্যুতের একই মূল্যহার ঘোষণার অনুরোধ করা হয় বিইআরসিকে। আইনে স্বাধীন বলা হলেও প্রতিষ্ঠানটি এতটাই তল্পিবাহক যে কয়েকটি ধাপে বিদ্যুতের মূল্যহার সমন্বয় করতে গিয়ে দাম বৃদ্ধির পরিবর্তে আরইবির বিদ্যুতের দাম কমিয়ে দিয়েছে। এছাড়া একই কারণে বিদ্যুতের পাইকারি এবং খুচরা দরের মধ্যে একটি পার্থক্য তৈরি হয়েছে। যাতে আরইবি দাবি করছে তাদের নিট ক্ষতি হবে বছরে ৯০২ কোটি টাকা। বিইআরসির সদস্য ড. সেলিম মাহমুদ বুধবার বিকেলে আরইবির চিঠি পাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করে জনকণ্ঠকে বলেন আমাদের কারিগরি মূল্যায়ন কমিটি বিষয়টি পর্যালোচনা করে দেখবে। আরইবির চিঠি সম্পর্কে বিস্তারিত কিছু না জানাতে পারলেও ড. সেলিম বলেন, সø্যাব সমন্বয় এবং বিদ্যুতের পাইকারি ও খুচরা মূল্যের মধ্যে পার্থক্য কিছুটা বেড়ে যাওয়ায় এ অবস্থা হচ্ছে। আরইবি চেয়ারম্যান ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মঈন উদ্দিনের লেখা চিঠি থেকে জানা যায়, নতুন দাম নির্ধারণের সময় শূন্য থেকে ৭৫ ইউনিট পর্যন্ত ব্যবহারকারী গ্রাহকের খুচরা মূল্য ৩ টাকা ৮৭ পয়সা থেকে কমে ৩ টাকা ৮০ পয়সা নির্ধারণ করায় ইউনিট প্রতি সাত পয়সা কমেছে। মূলত সারাদেশে একই বিদ্যুতের এক মূল্যহার করতে গিয়ে সরকারের অনুরোধে এই কাজটি করা হয়েছে। কিন্তু এর ফলে বিপুল পরিমাণ হেরফের হবে তা বিবেচনায় নেয়নি কমিশন। সর্বশেষ ঘোষিত ট্যারিফ অনুযায়ী শূন্য থেকে ৫০ ইউনিট পর্যন্ত লাইফ লাইন ব্যবহারকারী গ্রাহক এবং সেচের ক্ষেত্রে খুচরা মূল্যহার অপরিবর্তিত রয়েছে। কিন্তু এই তিন স্তরেই বিদ্যুতের পাইকারি মূল্যহার ঠিকই বেড়েছে। চিঠিতে চেয়ারম্যান মঈন উদ্দিন উল্লেখ করেন, আবাসিক গ্রাহকদের মধ্যে ৩০ লাখ লাইফ লাইন ট্যারিফের আওতাভুক্ত অর্থাৎ শূন্য থেকে ৫০ ইউনিট পর্যন্ত ব্যবহারকারী যা মোট গ্রাহকের ২৮ ভাগ। ৪৫ লাখ রয়েছে ৫০ থেকে ৭৫ ইউনিট পর্যন্ত ব্যবহারকারী। এছাড়া তিন লাখ ছয় হাজার সেচ গ্রাহক রয়েছে। বিআরইবি বলছে, ২৭ আগস্ট বিদ্যুতের মূল্য পুনর্নির্ধারণের ফলে পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের সমিতিগুলোকে পূর্বের ট্যারিফের তুলনায় ইউনিট প্রতি বিদ্যুত ক্রয়মূল্য বেড়েছে ০.২৪৭৫ টাকা। এর ফলে আগের তুলনায় নতুন অর্থবছরে বিদ্যুত ক্রয়ে সংস্থাটিকে অতিরিক্ত ৫৪১ কোটি টাকা ব্যয় করতে হবে। তথ্য মতে, আরইবিতে শূন্য থেকে ৫০ ইউনিট পর্যন্ত ব্যবহারকারী গ্রাহক মোট গ্রাহকের ১০ ভাগ। শূন্য থেকে ৭৫ পয়সা পর্যন্ত বিদ্যুত ব্যবহারকারী গ্রাহকের সংখ্যা মোট গ্রাহকের ২০ ভাগ এবং সেচের গ্রাহকের বিদ্যুত বিক্রয়ের পরিমাণ শতকরা আট ভাগ। এ তিনটি সø্যাবে মোট বিদ্যুতের ব্যবহার হয় ৩৮ ভাগ, যা মোট গ্রাহকের ৬১ শতাংশ। এ তিনটি শ্রেণীতে সমিতিগুলোর বিদ্যুত ক্রয় বিক্রয়ের পার্থক্যর কারণে নিট ক্ষতি হবে চলতি অর্থবছরে ৯০২ দশমিক ৮৬ কোটি টাকা। আরইবি বলছে সর্বশেষ ঘোষিত বিদ্যুতের ট্যারিফ মূল্য বাস্তবায়নে ফলে বিদ্যমান ৭৭টি সমিতির মধ্যে ইতোপূর্বে লাভে থাকা ২২টি সমিতির মধ্যে পাঁচটি সমিতি অলাভজনক সমিতিতে পরিণত হবে। এছাড়া ৫৫টি আর্থিকভাবে অসচ্ছল সমিতি আরও রুগ্ণ ও অসচ্ছল সমিতিতে পরিণত হবে। ফলে ২০২১ সালের মধ্যে ঘরে ঘরে বিদ্যুত পৌছে দেওয়ার যে পরিকল্পনা সরকার হাতে নিয়েছে তা বাধাগ্রস্ত হবে। প্রতিমাসে প্রায় তিন লাখ গ্রাহককে নতুন বিদ্যুত সংযোগ দেয়া হচ্ছে। দ্রুত গ্রাহক সংযোগ বৃদ্ধির ফলে প্রতিমাসে ১০০ মেগাওয়াট হারে বিদ্যুত চাহিদা বাড়ছে। যার কারণে সিস্টেম ওভারলোডেড হয়ে পড়ছে সিস্টেম লস বাড়ছে। ফলে সিস্টেম আপগ্রেডেশন, গ্রিডে সম্প্রসারণ, ব্রেকার স্থাপন, সুইচিং স্টেশন নির্মাণ, ৫০ হাজারের বেশি ওভারলোডেড ট্রান্সফরমার পরিবর্তন, ৩৩ কেভি/১১ বিতরণ লাইন বিভাজনসহ যাবতীয় কাজ সমিতিগুলোর নিজ খরচেই করতে হবে। কিন্তু বর্তমান প্রেক্ষাপটে আর্থিক লোকসানের কারণে এ অর্থ যোগন দেয়া অম্ভব। ফলে ওভারলোড সমস্যার কারণে সিস্টেমলস বৃদ্ধিসহ দ্রুত গ্রাহক সংযোগে ভাটা পড়বে।
×