ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

গৌতম রায়

বইয়ের বোঝা বনাম বিদ্যার বোঝা

প্রকাশিত: ০৫:৪৬, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০১৫

বইয়ের বোঝা বনাম বিদ্যার বোঝা

অতিরিক্ত কোনকিছুই ভাল নয়; তা সে যত ভাল জিনিস বা বিষয়ই হোক না কেন। সে হিসেবে বইয়ের বোঝা বাড়াবাড়ি রকমে বেড়ে যাওয়া যেমন খারাপ, একইভাবে বিদ্যার বোঝা বাড়াটাও খারাপের পর্যায়ে ফেলতে হয়। কিন্তু আমাদের শিক্ষার যে মানের সঙ্গে আমরা পরিচিত, সেখানে বিদ্যার বোঝা বাড়াটা নেতিবাচক অর্থে দেখার সুযোগ নেই। বিদ্যাশিক্ষায় আমাদের অনেক গুরুত্বপূর্ণ অর্জন আছে, কিন্তু গুণগত শিক্ষার প্রশ্নে ঘাটতিও রয়েছে সীমাহীন। সুতরাং এ লেখায় বিদ্যার বোঝাকে ইতিবাচক হিসেবে ধরা হবে। মূল আলোচনা বইয়ের বোঝা নিয়ে। বই মানুষকে আলোকিত করে, বই মানুষকে নতুন জীবনের সন্ধান দেয়, বই মনের খোরাক যোগাড়- ইত্যাদি নানা কথাবার্তার সঙ্গে আমরা পরিচিত। এসব বক্তব্যের সঙ্গে দ্বিমত প্রকাশের সুযোগও কম। কিন্তু বই যখন আনন্দের উপকরণ না হয়ে বাধ্যতামূলক উপকরণ হয়ে যায়, তখন তা আর মানুষকে টানতে পারে না। এটি শিশু থেকে শুরু করে বয়স্কÑ সবার জন্যই প্রযোজ্য। একজন ব্যক্তি নিজের আনন্দের জন্য প্রতিনিয়ত গল্প-উপন্যাস পড়তে পারেন; কিন্তু তাকে বাধ্যতামূলকভাবে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে নির্দিষ্ট বই পড়তে বাধ্য করা হয় এবং তারপর সেগুলোর ওপর প্রশ্নটশ্ন করে পরীক্ষা নেয়া হয়, সেই গল্প-উপন্যাসই তার কাছে বিস্বাদ ও আতঙ্কের কারণ হয়ে দাঁড়াবে। তার মানে, বই পড়াটাকে আনন্দমুখর করতে হলে একদিকে যেমন বই পড়ার বাড়াবাড়ি ও কঠোর নিয়মকানুন বাদ দিতে হবে, তেমনি ধরাবাঁধা নিয়মের বাইরে গিয়ে বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। উপরের উদাহরণটা দেয়া হয়েছে গল্প-উপন্যাস ও বড়দের বই পড়ার কথা মাথায় রেখে; কিন্তু একে শিশুদের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করলে কী দেখতে পাব? শিশুদের কি আমরা আনন্দদায়ক উপায়ে বই পড়াতে পারছি নাকি তাদের বই পড়তে বাধ্য করছি? তাদের বয়স অনুযায়ী যে ধরনের এবং যে কয়টি বই পড়ার কথা, তারা কি সেগুলো পড়ছে নাকি এর চেয়েও বাড়তি বোঝা তাদের বহন করতে হচ্ছে? শিশুদের পড়ালেখার ক্ষেত্রে মূলত তিনটি প্রবণতা দেখা যায় এদেশে। প্রথমত, একদল শিশু রয়েছে যাদের বাবা-মা বা অভিভাবক তাদের পড়ালেখার প্রতি উদাসীন। বিদ্যালয় ব্যবস্থা যেহেতু অনেকক্ষেত্রে কার্যকর নয়, তাই শিশুরাও বিদ্যালয়ে সীমাবদ্ধ কিছু বিষয় শিখছে কিন্তু বাড়িতে কিছু করছে না। দ্বিতীয় দলের শিশুরা বিদ্যালয়ের স্বাভাবিক পড়ালেখার পাশাপাশি বাড়িতে পড়ার বইয়ের বাড়তি কিছু পড়ালেখা করে। পিতামাতা তাদের জন্য এসব বাড়তি বই বা উপকরণের ব্যবস্থা করে দেন। এসব ক্ষেত্রে শিশুরা অনেকাংশে পিতামাতার চাপে বাড়তি পড়ার প্রতি অনীহা প্রকাশ করে। তৃতীয়ত, এ দলের শিশুরা বিদ্যালয় ও বাড়ি উভয়ক্ষেত্রেই মারাত্মক চাপে থাকে। বিদ্যালয়ে যেমন তাদের নির্দিষ্ট বইয়ের বাইরেও অনেক ধরনের বই পড়তে হয়, বাড়িতেও তাকে বই পড়ার চাপের মধ্যে থাকতে হয়। এই তিনটি দলের মধ্যে প্রথম দলটি তুলনামূলকভাবে পিছিয়ে থাকে। বিভিন্ন ধরনের মানসিক বিকাশের জন্য প্রয়োজনীয় রসদ তারা পায় না। অন্যদিকে বাকি দুটো দল যতটুকু দরকার তার চেয়ে বেশি তাদের গেলানো হয়। স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় বিকশিত হতে পারে এমন শিশু এদেশে কতজন তা নিয়ে গবেষণা হতে পারে। কোন শিশু যদি আগ্রহ সহকারেই স্বাভাবিকের তুলনায় বেশি বেশি বই পড়তে শুরু করে, তাহলেও সেটি একপর্যায়ে খারাপ দিকে যেতে পারে। কারণ, এতে শিশুটি বই পড়ার বাইরের অন্যান্য কর্মকা-ে পিছিয়ে পড়বে। অনেকের মধ্যে একটি ধারণা গেঁথে আছে যে, সবকিছু বইতে থাকতে হবে। যে কারণে আলোড়ন সৃষ্টিকারী নতুন কিছু ঘটলে কিংবা নতুন কোন তত্ত্ব বা প্রয়োগের বিষয়বস্তু আলোচনার টেবিলে আসলে আমরা সেগুলোকে বইতে দেয়ার জন্য উদগ্রীব হয়ে উঠি। কিন্তু বই তো সবকিছুর আধার নয়! বাংলাদেশের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষাক্রম পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, সেখানে অনেককিছু দেয়া আছে যা বইতে প্রতিফলিত করা সম্ভব নয়। উদাহরণস্বরূপ, শিশুকে আদবকায়দা শেখানোর জন্য বই কোন বাধ্যতামূলক উপকরণ হতে পারে না, বরং বইয়ের বাইরের নানাবিধ কর্মকা- থেকে শিশুকে এসব বিষয় শেখানো উচিত। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, বইতে না থাকলে আমরা কোনকিছুকে গুরুত্ব দিতে চাই না। এটা শিক্ষার নীতিনির্ধারকদের জন্য যেমন সত্য, তেমনি সত্য শিক্ষক কিংবা অভিভাবকদের ক্ষেত্রেও। ফলে একদিকে যেমন বইয়ের কনটেন্ট বা বিষয়বস্তু বাড়তে থাকে, তেমনি বইয়ের সংখ্যাও বাড়ে। বয়স ও মানসিক সামর্থ্য অনুসারে যে শিশুর হয়ত পাঁচটি বই পড়ার কথা, সেখানে সে পড়ছে দ্বিগুণ বা তার চেয়েও বেশি। উল্লেখ্য যে, যারা বই লেখেন, তাঁদের অনেকেরই বই লেখার মতো পর্যাপ্ত যোগ্যতা থাকে না। শুধু কনটেন্ট বা বিষয়বস্তু ও এর সঙ্গে কিছু ছবি যোগ করে দিলে তা বই হয় না। বইটি কোন্ পর্যায়ের শিশুদের জন্য লেখা হচ্ছে, প্রতিটি শব্দ ও বাক্য তার বয়স ও সামর্থ্যরে জন্য উপযোগী কিনা, শিক্ষাক্রমের সঙ্গে সংযোগ কতটুকু, কলেবর কতটুকু হবে ইত্যাদি নানা বিষয় এখানে গুরুত্বপূর্ণ এবং মোটামুটি গবেষণার বিষয়। বাংলাদেশের জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের বইগুলোতে এসব বিষয় মেনে চলে বই লেখার প্রবণতা বেড়েছে যদিও তাদের সব বই যে প্রশ্নের উর্ধে তা বলা যাবে না। কিন্তু বোর্ডের বইয়ের বাইরে বিশাল সংখ্যক বই আছে যেগুলো কোন পর্যালোচনা ও সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশ হয়ে থাকে। এসব বইতে কনটেন্ট তো বটেই, সাধারণ বানান ও ছবিতে প্রচুর ভুল দেখা যায়; কিন্তু শিশুদের এসবই পড়তে হয় বেশি। অনেক বিদ্যালয়ে পরীক্ষায় ভাল করার জন্য শিক্ষকবৃন্দ পাঠ্যবই বাদ দিয়ে গাইড বই বা অন্যান্য বই পড়াচ্ছেন। অতি সচেতন পিতামাতা ছেলেমেয়েদের বাড়তি স্মার্ট বানাতে গিয়ে প্রয়োজনের অতিরিক্ত গল্প-ছড়ার বই পড়াচ্ছেন। তারা ভাবছেন, এসব বই পড়ে তাদের সন্তান অন্যদের চেয়ে এগিয়ে যাবে, কিন্তু তারা যে সন্তানের ক্ষতি করছেন, তা ভাবছেন না বা ভাবতে পারছেন না। একটি গবেষণার উদাহরণ এখানে দেয়া যেতে পারে। গণসাক্ষরতা অভিযান পরিচালিত এডুকেশন ওয়াচের একটি গবেষণা থেকে দেখা যায়, অনেক প্রাক-প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক নির্দিষ্ট বইয়ের চেয়ে বাইরের প্রকাশকের বই পড়ানোর প্রতি বেশি আগ্রহী। শিশুদের বাড়তি বই পড়ানোর প্রবণতা সবচাইতে বেশি কিন্ডারগার্টেন বিদ্যালয়ে। এমন অনেক বই আছে যা হয়ত ওই শ্রেণীর শিশুদের জন্য অপ্রয়োজনীয়, কিন্তু প্রকাশক ও শিক্ষকদের মধ্যকার অলিখিত বোঝাপড়ার কারণে শিক্ষার্থী বা অভিভাবকদের এসব বই কিনতে ও পড়তে হয়। এসব বাড়তি বই একদিকে অভিভাবকদের খরচের তালিকা লম্বা করছে, তেমনি তা শিশুদের বইয়ের বোঝা বাড়াচ্ছে, বাড়াচ্ছে ব্যাগের বোঝাও। বইয়ের বোঝা, ব্যাগের বোঝা কিংবা পড়ালেখা নিয়ে এসব আলোচনা হচ্ছেÑ অধিকাংশই ক্ষুদ্র পরিসরে আবার যারা আলোচনা করছেন, তাঁদের অনেকেই নীতিনির্ধারণীতে যুক্ত নন। ফলে তাঁদের বক্তব্য উপেক্ষিত থাকছে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই। সাম্প্রতিককালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শিশু ও প্রথম শ্রেণীতে ভর্তি পরীক্ষার যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। যেসব বিষয় শিশুরা বিদ্যালয়ে এসে শিখবে, তারা সেগুলো বাড়ি থেকেই যদি শিখে আসে, তাহলে বিদ্যালয়ের কাজ কী? প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য সাড়া ফেলেছে এবং এ কারণে আশাবাদী যে, সারাদেশে শিশুদের ভর্তি পরীক্ষার এ প্রথা বাতিল হবে। কিন্তু আজ থেকে আরও কয়েক বছর আগেই এসব নিয়ে কথা উঠেছিল, কিন্তু সাধারণের আলোচনা দিনশেষে গুরুত্বহীনই থাকে। যুক্তিহীনভাবে বইয়ের বোঝা বাড়ানোর কুফল তাৎক্ষণিকভাবে বোঝা যায় না, কিন্তু এর কিছু স্বল্পমেয়াদী ও দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব রয়েছে। স্বল্পমেয়াদী কুফলগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে শিশুর মধ্যে পড়ালেখার প্রতি ভীতি সৃষ্টি হয়, বিদ্যালয়ে যাওয়ার অনাগ্রহ তৈরি হয়, পাঠ্যবইকে অপছন্দ করতে শেখে, তার ব্যাগের বোঝা দিন দিন ভারি হতে থাকে, খেলাধুলা ও অন্যান্য শিশুতোষ কাজ বাদ দিয়ে বইয়ের প্রতি সময় দিতে হয়, সামাজিকতা ও সাংস্কৃতিক যোগসূত্রগুলো ক্ষীণ হতে থাকে ইত্যাদি। অপরদিকে দীর্ঘমেয়াদী প্রভাবগুলোর মধ্যে রয়েছে নিজের সন্তানকে একইভাবে বা এর চেয়েও বেশি কঠোরভাবে বড় করে তোলার প্রবণতা থাকে, সৃজনশীল ও মননশীল বই পড়ার সংস্কৃতি থেকে দূরে থাকা, নিজের চিন্তাভাবনাকে কাঠামোর মধ্যে ফেলে রাখা ও এর বাইরে না যেতে পারা ইত্যাদি কিছু। শিশুর মানসিক, সামাজিক, আবেগিক, ভাষাগত, যোগাযোগ ও গাণিতিক দক্ষতার বিকাশে বই গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম; কিন্তু একমাত্র নয় অথচ বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় দিন দিন বইয়ের বোঝা বাড়ছে। সে অনুযায়ী কি বিদ্যার বোঝা (ইতিবাচক অর্থে) বাড়ছে? উত্তরটা সম্ভবত আমাদের সবার জানা। এ সমস্যার সমাধানও জানা; কিন্তু সমাধানের জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে হবে সরকারের সংশ্লিষ্ট শিক্ষা বিভাগ ও বিদ্যালয়গুলোকে। প্রতিযোগিতামূলক এই পৃথিবীতে অভিভাবকরা তাদের সন্তানকে অন্য সবার চাইতে আলাদাভাবে গড়ে তুলতে চাইবেন তা স্বাভাবিক; কিন্তু শিক্ষাক্রম, পাঠ্যপুস্তক রচনা, বইয়ের বোঝা ও শিশুদের মানসিক বিকাশ যে পরস্পর-সম্পর্কিত, সেসব ধারণা ও জ্ঞান সবার মধ্যে থাকবে তা আশা করা ঠিক নয়। কিন্তু কর্তৃপক্ষ যদি এ বিষয়ে অভিভাবকদের সচেতন করার পাশাপাশি পরিকল্পিতভাবে বইয়ের বোঝা কমিয়ে বিদ্যার বোঝা বাড়ানোর উদ্যোগ নেয়, তাহলে তা সবার জন্যই মঙ্গলকর হবে। লেখক : শিক্ষক, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রাক-প্রাথমিক ও প্রাথমিক শিক্ষাবিষয়ক গবেষক
×