ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

অপূর্ব কুমার কুণ্ডু

ফিরে এলো দেওয়ান গাজীর কিস্সা

প্রকাশিত: ০৬:৩২, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০১৫

ফিরে এলো দেওয়ান গাজীর কিস্সা

অবস্থার পরিবর্তনে ব্যবস্থার পরিবর্তন সর্বজন স্বীকৃত। যেমন, তৃষ্ণা নিবারনে বেদুইনের পক্ষে উট, তপ্ত মরুভূমি পাড়ি দেবার জন্যে আরাধ্য। আবার তৃষ্ণার্ত বেদুইনের কাছে তৃষ্ণা নিবৃত্তির উপায় হিসেবে উটের পেট চিরে থলিতে সংরক্ষিত জল পান পরম আদৃত। অনেকটা সেরকম অবস্থা গাজীপুরের জোতদার দেওয়ান গাজীর। সুরাপানে যখন তিনি টইটুম্বুর তখন তার মতো উদার ব্যক্তি দুই-দশ গ্রামে বিরল। কিন্তু ভরা বোতল শূন্য হবার মতো তিনি যখন দেহ-মনে সুরাশূন্য তখন তার মতো নির্দয়-নৃশংস ব্যক্তি দুই-দশটি জেলায় খুঁজে পাওয়া দুর্লভ। নো ম্যানস ল্যান্ডে দাঁড়িয়ে দুটি দেশকে দেখার মতো করে সুরাপানের মধ্যবর্তী সময়ে দাঁড়িয়ে একক ব্যক্তি দেওয়ান গাজীর ভিন্ন ভিন্ন চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য তুলে ধরার মধ্যে দিয়ে বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে এক সামন্ত প্রভুর টক-ঝাল-মিষ্টির নাটকীয় জীবন কাহিনীর নাটক ‘দেওয়ান গাজীর কিস্সা’। জার্মান নাট্যকার বের্টল্ট ব্রেশট রচিত হের পুন্টিলা এ্যান্ড হিজ ম্যান মাট্টি অবলম্বনে, আসাদুজ্জামান নূরের রূপান্তরে, নির্দেশক আসাদুজ্জামান নূরের নির্দেশনায়, নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ের ১২তম প্রযোজিত নাটক দেওয়ান গাজীর কিস্সা মঞ্চস্থ হলো গঙ্গা-যমুনা নাট্য ও সাংস্কৃতিক উৎসবের অষ্টম দিনে গত ১১ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় নাট্যশলায়। নাট্যশালায় দেওয়ান গাজীর কতই না কিস্সা-কাহিনীর ঘনঘটা,- এক-দুই বোতলে তার পা টলে কিন্তু মাথা ভার হয় না বলে এক বাক্স বোতল সর্বদা তার সফরসঙ্গী। সফরসঙ্গীর তালিকায় মোসাহেব মোক্তার যার কাছ থেকে মোসাহেবীই একমাত্র চাওয়া বিনিময়ে গাজীর উচ্ছিষ্টই তার ভরসা। সঙ্গী মাখনের মতো বুদ্ধিদীপ্ত সহকারী যাকে প্রাথমিক কাজগুলোর শেষে মূল সিদ্ধান্তের জন্যে দেওয়ান গাজীর কাছে সব তুলে ধরতে হয়। স্ত্রীবিহীন গাজীর কাছে একমাত্র কন্যা লাইলী বাদে বাদবাকি সব নারীই স্ত্রী পর্যায়ের। যে কারণে রাত বিরাতে বারবনিতা লাইলী-চামেলী কিংবা কুসুম তার কাছে ছুঁয়ে দেখার অপ্সরা। ছুঁয়ে দেখার তালিকায় প্রাক্তন দাসী হয়ে বর্তমান দাসী কন্যা সকিনা। দোকানে সুরা থাকলেও নেশা ওঠামাত্র বোতল হাতে না পাওয়াটা যেমন দেওয়ান গাজীর ব্যক্তিত্বের অসম্মান ঠিক তেমনই চাওয়ামাত্র ঘরে শয্যাসঙ্গী না পাওয়াটাও তার জন্যে শক্তির অপব্যায় এবং নেশা কেটে যাওয়ার শামিল। ঘরে রক্ষিতা পুষবার পথে অন্তরায় কন্যা লাইলী। লোভের পথে বাধা লাইলী তাই কন্যা হওয়া সত্ত্বেও পথের কাঁটা। কাঁটাকে দূর করতে জামাই নির্বাচনে তা প্রয়োজন টাকার লোভী নফর আলী দারোগা কিংবা এক্স রিক্সাচালক কিন্তু বর্তমানে খাস বেয়ারা মাখন। নেশাগ্রস্ত অবস্থায় সকলের চাওয়াকে পাইয়ে দিতে দেওয়ান গাজী আশ্বস্তের অভয়বার্তায় ভরিয়ে তোলে কিন্তু নেশা কেটে গেলে সকলের চাওয়ার বিপরীতে পাওনা হিসাবে গুনে গুনে পরিমাণ মতো কষে লাথির পর লাথি মারে। দেওয়ান গাজীর এই স্বপ্ন ও বাস্তবতার বেড়াজালে প্রত্যেকেই আটকা পড়ে ছটফট করলেও একমাত্র সকিনা চায় এই মাকড়শার পাতা ফাঁদকে ছিঁড়ে ফেলতে। লড়াইয়ে সকিনা সহযোগী হিসেবে পেতে চায় মাখনকে। কিন্তু মাখন বোঝে তার একার পক্ষে হয়ত বিদ্রোহ করা চলে কিন্তু সফল বিপ্লবের জন্যে দরকার সংগঠিত বিদ্রোহ। আর তাই প্রশ্নের উত্তর সুধী দর্শকদের কাছ থেকে আসবার আশায় দর্শকদের উদ্দেশে মাখনের প্রশ্ন ছোড়া আর দেওয়ান গাজীর সাম্রাজ্য অবিরত বেড়ে চলার মধ্যে দিয়ে শেষ হয় নাটক দেওয়ান গাজীর কিস্সা। কিস্সার কৌশলে রূপান্তকারী আসাদুজ্জামান নূর যেমন একটা সাম্রাজ্যবিস্তারী কাহিনীকে তুলে ধরেছেন বিন্দুর মধ্যে সিন্দু দেখানোর ভঙ্গিমায় ঠিক তেমনি ব্রেশটের কাছ থেকে প্লট ধার করলেও রূপান্তরিত নাটকটি লিখে ফেললেন সকল অর্থে প্রায় মৌলিক নাটক রচনার ভঙ্গিমায়। ১৯৭৭ এ মঞ্চায়নের যে প্রাসঙ্গিকতা সেই প্রাসঙ্গিকতা ২০১৫ সালেও সমান প্রযোজ্য ভিন্ন রূপের ভিন্ন ক্ষতকে চিনিয়ে দেয়ার মানসিকতায়। মানসিকতাতো বদলে বদলে যায় সময়ের পরিক্রমায়। নইলে সমকালের অধিকাংশ নাট্য প্রযোজনায় যেখানে অভিনয় আর নাটকটা বাদে আনুষঙ্গিক সেট-লাইট-পোশাক-কোরিওগ্রাফী আর একই চরিত্রের অধিক অভিনেতা-অভিনেত্রীর অভিনয়ের বাড় বাড়ন্তের তলে চাপা পড়ে দর্শকদের নাভিঃশ্বাস ওঠে সেখান সত্তর-নব্বই দশকের নাট্য প্রযোজনাগুলো শীতাতপ নিয়ন্ত্রণের সুযোগ না রেখেও দর্শকদের শীতল করত কিভাবে, তারও উত্তর মেলে দেওয়ান গাজীর কিস্সা’র নির্দেশনায়। সেটের আড়ম্বর নেই, লাইটের চোখ ঝলকানি নেই, কস্টিউমের প্রলোভন নেই, কোরিওগ্রাফীর আদলে মঞ্চে দাপাদাপি নেই, আবহের তা-ব নেই আছে স্বাভাবিকতা আর শক্তিশালী নাটকের সঙ্গে শক্তিমান অভিনেতা ও অভিনেত্রী। নাটকের মতোই বোধ এবং আঙ্গিক কাঠামোয় মজবুত নাটকের পাত্র-পাত্রী। যে কারণে নাটকটির নির্দেশক আসাদুজ্জামান নূর প্রথম মঞ্চায়নের প্রাক্কালে ঘোষণা দিতে পারেন, ‘এতে আমাদের কোন মৌলিক জ্যাঠামী নেই’। আর জ্যাঠামী বর্জিত নির্দেশনা তথা বিনয়ী হবার এবং নিজের কাজটা ঠিকঠাক মতো করবার সফল প্রাপ্তি, ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত দেওয়ান গাজীর কিস্সা বাংলাদেশে সর্বাধিক অভিনীত নাটক। নাটকের কেন্দ্রীয় চরিত্রে অভিনেতা আলী যাকের তার ব্যক্তি চরিত্রের মতই গ্রুপ অব কম্পানির প্রধান পুরুষ। সূত্রধর ব্যতিরেকে চৌদ্দটি মনোস্তাত্ত্বিকভাবে জটিলতায় আক্রান্ত চরিত্রকে একাই যেভাবে পাস-ওভার পাসে বল ঠেলে দিয়ে নিজে বীরত্বের সঙ্গে গোল দিয়ে দলকে জিতিয়ে নিলেন তা অভাবনীয় শুধু নয় বরং বিশ্বস্তভাবেই অবিশ্বাস্য। এক চোখে হাসি অপরচোখে কাঁদবার মতো দুর্লভ অভিনয় তিনি করলেন চা-পানের আগে নেশাচ্ছন্ন আর পরে নেশা কেটে যাওয়ার অবয়বে। তার পোষ্য আর ত্যাজ্য এর মাঝে নিজস্ব যোগ্যতায় দাঁড়িয়ে থাকা মাখনের মতোই বুদ্ধিদীপ্ত এবং ক্ষীপ্র অভিনয় অভিনেতা আবুল হায়াতের। দেওয়ান গাজীর কিস্সা নাটকের রূপান্তকারী এবং নির্দেশক আসাদুজ্জামান নূরের নির্দেশনা এবং বিলম্বে বিদেশযাত্রা প্রসঙ্গে বিবেচনায় একটি কথা বলবার। গোধূলী বেলায় মঞ্চায়িত দেওয়ান গাজীর কিস্সা অভিনেতা-অভিনেত্রী, কলাকুশলী, নানা বয়সী দর্শকদের হিসাবের খাতা খুলতে শেখায়।
×