ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

হারুন হাবীব

বেনাপোলে বঙ্গবন্ধু, রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল

প্রকাশিত: ০৫:২১, ১৮ সেপ্টেম্বর ২০১৫

বেনাপোলে বঙ্গবন্ধু, রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল

ঢাকা নগরীতেই বসবাস করি, তবু নির্মলেন্দু গুণের সঙ্গে দেখা হলো যশোরের বেনাপোলে, তাও বহু বছর পর। এক সময় ওর আজিমপুরের আস্তানা ও নানা জায়গায় খুব আড্ডা হয়েছে। বহুকাল ওসব হয় না। অযথা কাজের ভিড় বেড়েছে আমার। সে যাই হোক, দেখলাম, হাজারকয়েক ছেলেমেয়ে ও বয়স্ক লোকের সামনে কবি নির্মলেন্দু গুণ আবৃতি করলেন তাঁর কালজয়ী কবিতা ‘আমি আজ কারো রক্ত চাইতে আসিনি’। উচ্চারণ করলেন ‘সমবেত সকলের মতো আমিও গোলাপ ফুল খুব ভালবাসি,/ রেসকোর্স পার হয়ে যেতে সেই সব গোলাপের একটি গোলাপ আমাকে বলেছে,/আমি যেন কবিতায় শেখ মুজিবের কথা বলি। আমি তাঁর কথা বলতে এসেছি।’ মনে পড়ে, ১৯৭৭ সালে কবিতাটি প্রথম পাঠ করেছিলেন নির্মলেন্দু গুণ, বাংলা একাডেমিতে, একুশে ফেব্রুয়ারির কবিতা পাঠের আসরে। সে কারণে তাকে হেনস্থাও কম হতে হয়নি। ১৯৭৫-এর আগস্টে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্মম হত্যাকা-ের পর প্রবল বিরূপ পরিবেশেও কোন কবির এটিই প্রথম প্রতিবাদ। এবারে জাতীয় শোক দিবসের কিছু অনুষ্ঠানে গেছি, রাষ্ট্রপিতার ৪০তম হত্যাদিবসে নিজের মতো করে সেই মহামানবকে শ্রদ্ধা জানিয়েছি, যিনি বাঙালীর জন্য একটি স্বাধীন রাষ্ট্র পত্তন করেছিলেন। শ্রদ্ধা জানিয়েছি সেই কীর্তিমানকে, যাঁকে স্বাধীনতার সাড়ে তিন বছরের মাথায় নতুন রাষ্ট্রের শত্রুরা পরিকল্পিতভাবে হত্যা করেছিল। লক্ষ্য করেছি, সব না হলেও এসব অনুষ্ঠানের বেশিরভাগই ছিল গতানুগতিক। প্রথা বা রাজনীতিঘনিষ্ঠ কর্মসূচীর প্রয়োজন নেই, এমনটা বলার সুযোগ নেই। কিন্তু আমার বিশ্বাস, নতুন প্রজন্মের মাঝে স্বাধীনতার প্রকৃত ইতিহাস ও জাতির জনক সম্পর্কে বস্তুনিষ্ঠ তথ্যপঞ্জি ও আবেগ ছড়াতে হলে গতানুগতিকতার বাইরে বেরোতে হবে। বঙ্গবন্ধুর জীবন ও আদর্শের চর্চা করতে হবে। নতুন প্রজন্মের মনোজগতে বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে ভালবাসা তৈরি করতে হবে। ভালবাসা তৈরির এই কাজটি সুযোগ বা গতানুগতিকতা দিয়ে হবে না। সে কারণেই চাই বঙ্গবন্ধুর নিবিড় চর্চা। একটি কথা উপলব্ধি করার যে, ওই মহামানবকে যারা হত্যা করেছিল তারা কিংবা তাদের উত্তরসূরিরা আজও সক্রিয়। বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে এরা নতুন করে অন্ধকারের দিকে নিতে চায়। কাজেই এমন কর্মসূচী বা কর্মপরিকল্পনা প্রয়োজন, যা নতুন প্রজন্মের মধ্যে বঙ্গবন্ধুর আদর্শিক চর্চার ক্ষেত্র তৈরি করে, বাংলাদেশ রাষ্ট্রের নতুন মানুষরা প্রতিরোধের শক্তি সঞ্চয় করে এবং সব দ্বিধাদ্বন্দ্ব কাটিয়ে তারা সত্যিকার আদর্শিক মানুষে পরিণত হয়। আরও একটি কথা প্রণিধানযোগ্য যে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিজেই বাংলাদেশ। তাই এই মহাপ্রাণকে গ-িভুক্ত করার প্রয়োজন নেই। তাঁর হত্যাকা-ের ৪০তম বার্ষিকীতে এসব কথাই আমি বেশি বলেছি। এসব দিক থেকে যশোরের শার্শা উপজেলার বেনাপোল পৌরসভার অনুষ্ঠানটি ছিল যথেষ্ট ব্যতিক্রম। স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসার কয়েক হাজার ছাত্রছাত্রী প্রশস্ত মাঠটিতে বসা। পরিণত বয়সের মানুষও অনেক। বঙ্গবন্ধুর ছবি ও সেøাগানে ছেয়ে গেছে বেনাপোল। বলতেই হবে, পৌরসভার তরুণ মেয়র আশরাফুল আলম লিটন জাতির পিতার ৪০তম শাহাদাতবার্ষিকীতে সৃজনশীল একটি আয়োজন সম্পন্ন করেছিলেন। ‘বঙ্গবন্ধু বিষয়ক প্রদর্শনী’ শিরোনামে অনুষ্ঠানটিতে অন্তর্ভুক্ত ছিল বঙ্গবন্ধু সম্পর্কিত কবিতা ও রচনা প্রতিযোগিতা, সেই সঙ্গে অন্তর্ভুক্ত ছিল অঙ্কন প্রতিযোগিতা। স্কুল-মাদ্রাসার ছোট ছোট ছেলেমেয়ে নিজেদের আবেগ দিয়ে জীবনের প্রথম কবিতা লিখেছে জাতির পিতাকে নিয়ে, রচনা লিখেছে নিজের ভাষায়, এঁকেছে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি নিজের আবেগের জন্য পুরস্কৃতও হয়েছে তারা। মাঝেমধ্যে বৃষ্টি হচ্ছিল। ভাদ্রের স্যাঁতসেঁতে বিকেলেও লোকসমাগম প্রচুর। বহুবিধ প্রতিভার অধিকারী প্রবীণ কবি ও শিল্পী অমিতাভ দাশগুপ্ত দারুণ দক্ষতায় অনুষ্ঠানটি পরিচালনা করেছেন। আমি ছাড়াও ঢাকা থেকে অতিথি হয়ে গেছেন কবি নির্মলেন্দু গুণ, গেছেন মুক্তিযুদ্ধের গবেষক অবসরপ্রাপ্ত লে. কর্নেল সাজ্জাদ আলী জহির বীরপ্রতীক, গেছেন গুণী অভিনয় ও আবৃতি শিল্পী পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রবীণ শিক্ষাবিদ ও অর্থনীতিবিদ ড. রমণী মোহন দেবনাথ এবং মুক্তিযুদ্ধের গানের প্রথিতযশা শিল্পী আবদুল জব্বার। মেয়র লিটন সূচনা বক্তব্য দিলেন, বললেন কেন, কিভাবে তিনি এমন একটি আয়োজন সম্পন্ন করেছেন। স্থলপথে বেনাপোল বাংলাদেশের প্রধান প্রবেশদ্বার। প্রতিদিন কম করে হলেও হাজারপাঁচেক মানুষ এই ‘চেকপোস্ট’ দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ এবং প্রস্থান করে। বিশেষ অনুষ্ঠান বা উপলক্ষে যাতায়াত আরও বেড়ে যায়। দুই দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের কল্যাণে যাতায়াত করে প্রতিদিন শত শত মালবাহী ট্রাক, নানা যানবাহন। সরকারের রাজস্ব আয়ের একটি বড় অংশ আসে এই স্থলবন্দর থেকে। সে কারণে ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের পর বেনাপোলের গুরুত্ব অপরিসীম। আমি ১৬-১৭ বছর আগে বেনাপোল হয়ে কলকাতায় গেছি। আর যাওয়া হয়নি ও পথে। এবার গিয়ে সত্যি সত্যি অবাক হয়েছি। দেখলাম, কয়েক বছরে স্থলবন্দরটির চেহারা বদলে গেছে। সমন্বিত ‘চেক পোস্ট’ ও আধুনিক যন্ত্রপাতি বসাবার কারণে ভ্রমণকারীদের ভোগান্তি কমেছে যথেষ্ট। আগের চেয়ে প্রশস্ত ও সুবিন্যস্ত হয়েছে বেনাপোল ‘চেক পোস্ট’। কম্পিউটার বসেছে। ‘ডিউটি ফ্রি’ দোকান বসেছে, যা আধুনিক ‘চেক পোস্ট’গুলোতে থাকে। এরপরও বলতে হবে বেনাপোল এখনও আন্তর্জাতিকমানের হয়নি। ইউরোপের কিছু ‘চেক পোস্ট’ বা স্থলবন্দর দেখার সুযোগ হয়েছে আমার। সেগুলোর যাত্রীসেবা মনে রাখার মতো। বিশ্বাস করি, ভারত-বাংলাদেশের মধ্যকার এই বৃহৎ প্রবেশ পথটি আরও উপযুক্ত হয়ে উঠবে। বিশেষ করে দুই দেশের রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে কলকাতা থেকে ঢাকা হয়ে উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় ভারতীয় রাজ্যগুলোতে যখন নিয়মিত বাস যাতায়াত করার কথা, তখন বেনাপোলের গুরুত্বকে খাটো করে দেখার সুযোগ কোথায়? বেনাপোলের ঐতিহাসিক তাৎপর্যটিও স্মরণ করার মতো। ১৯৪৭-এর দেশভাগের সময় এই পথ দিয়ে চোখের জল ফেলে দেশান্তরী হয়েছে লাখো বাংলাভাষী মানুষ। অগণিত ছিন্নমূল নারী-পুরুষের দীর্ঘশ্বাস ও কান্নার সাক্ষী হয়ে আছে এই বেনাপোল। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসে এই পথ দিয়ে লাখো বিপন্ন মানুষ পাড়ি জমিয়েছে ভারতের নিরাপদ আশ্রয়গুলোতে। এই যশোর রোড়ের প্রতিটি ধূলিকণায় জমা আছে লাখো বাঙালী শরণার্থীর-নারী-শিশু-বৃদ্ধের হাহাকার ও আর্তনাদ। এরা পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর নির্মম হত্যাযজ্ঞ, ধ্বংসযজ্ঞ ও নির্বিচার ধর্ষণ থেকে বাঁচতে সীমান্ত পাড়ি দিয়েছে মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসে। এই যশোর রোড় দিয়ে দৃপ্ত পায়ে হেঁটে গেছে মুক্তিযোদ্ধারা, চলেছে মুক্তি বাহিনী ও মিত্র বাহিনীর সামরিক কনভয়। বেনাপোল দিয়ে আসা ঐতিহাসিক যশোর রোড নিয়ে আবেগমাখা দীর্ঘ কবিতা লিখেছেন প্রখ্যাত মার্কিন কবি এলেন গিন্সবার্গ। ‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড’ কবিতাটি সেই থেকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ভয়ঙ্কর সময়ের সাক্ষী হয়ে আছে। একই সঙ্গে একটি বেসামরিক জনগোষ্ঠীর ওপর পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর নির্লজ্জ বর্বরতার সাক্ষীও। আজও যখন কেউ কবিতাটি পড়বেন কিংবা বাংলায় তরজমা করা মৌসুমী ভৌমিকের গাওয়া গানটি শুনবেন, আমার বিশ্বাস, সকলের চোখ অশ্রুসজল হয়ে উঠবে। মানবতাবাদী এই মার্কিন কবি ১৯৯৭ সালে মারা যান। এসব কারণেই বেনাপোল-শার্শা হয়ে যশোর রোডের গুরুত্ব ইতিহাসে যেমন বর্তমান, ভবিষ্যতের কাছেও তেমন। আগেই লিখেছি, বেনাপোলের চেকপোস্টটি আগের তুলনায় মানসম্মত হয়েছে। যাত্রীসেবার মান অনেকটা বেড়েছে। কিন্তু আমি আনন্দিত হয়েছি সেখানকার একটি বড় মাপের সৃজনশীল সংযোজনে। ভারতীয় অংশ থেকে এখন বাংলাদেশে প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গে যে কোন মানুষের চোখে পড়বে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের একটি বড় প্রতিকৃতি। যে কেউই বাংলাদেশের মাটিতে পা রাখবেন তিনিই দেখতে পাবেন জাতীয় পতাকাসহ আমাদের ইতিহাসের মহানায়ককে। একই সঙ্গে বাংলাদেশ থেকে ভারতে প্রবেশ করতে সরাসরি চোখ পড়বে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের দুই প্রতিকৃতিতে। মোটকথা, বেনাপোলের প্রবেশপথে এই তিন শ্রেষ্ঠ বাঙালীর উপস্থিতি স্থানটির গুরুত্ব অনেকটা বাড়িয়ে দিয়েছে। পৌরসভার মেয়র লিটন জানালেন, এসব উদ্যোগ তিনি নিয়েছেন ইতিহাসের আলোকে, বর্তমান ও অনাগত ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে। উদ্যমী ও সৃজনশীল এই তরুণ রাজনীতিবিদের ভাষ্য : মানুষ স্বপ্ন দেখে, আমিও দেখি; স্বপ্ন দেখি আর জাল বুনি। সেই জালের একটি গিঁটে থাকে একেকটি নির্মাণ। লিটন মুক্তিযুদ্ধের পরের প্রজন্মের মানুষ, কিন্তু ওর চেতনা ও স্বপ্নদেখা আমাকে অভিভূত করেছে। তারিখটা মনে নেই, ১৯৭৩-৭৪ সালের কথা। মুক্তিযুদ্ধ শেষে আমি ‘বাংলাদেশ প্রেস ইন্টারন্যাশনাল’ বা বিপিআই নামের একটি ছোট সংবাদ সংস্থায় যোগ দিয়েছি। বঙ্গবন্ধুর প্রেসসচিব শ্রদ্ধেয় তোয়াব খানের ফোন এল হঠাৎ। জানালেন, যেন দ্রুত এয়ারপোর্টে হাজির হই। গিয়ে দেখলাম একটি হেলিকপ্টার উড়ার জন্য তৈরি। মিডিয়া টিমের সদস্যদের আগেই তোলা হলো। কেউই জানতে পারলাম না, কোথায় যাবেন বঙ্গবন্ধু। এক সময় প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু এলেন। হেলিকপ্টার উড়ে চলল। কোথায়, কোন্্দিকে যাচ্ছে বোঝা গেল না। শুধু এটুকুনই শোনা গেল বঙ্গবন্ধু কোথাও ‘সারপ্রাইজ ভিজিট’এ যাবেন। আধা ঘণ্টারও বেশি সময় উড়ে হেলিকপ্টারটি নামল। প্রথমে বুঝতে অসুবিধে হলেও পরে জানলাম জায়গাটি বেনাপোল। সম্ভবত ‘নো ম্যান্স ল্যান্ড’। হন হন করে হাঁটতে থাকলেন বঙ্গবন্ধু। সঙ্গে মন্ত্রিপরিষদের দুজন ও ব্যক্তিগত সহকারীবৃন্দ। তিনি গিয়ে থামলেন একটি বড় স্তূপের সামনে। ভারত থেকে আমদানি করা কাপড়-চোপড় স্তূপাকারে রাখা আছে জায়গাটায় দীর্ঘদিন। রোদবৃষ্টিতে এরই মধ্যে লতাগুল্ম গজিয়েছে। বেশিরভাগ ব্যবহারের অযোগ্য হয়েছে। যাতে প্রচারণা করা যায় ভারত ইচ্ছে করেই অযোগ্য কাপড়গুলো দিয়েছে। মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তীকালে সাধারণ মানুষের মধ্যে কতটা পরিকল্পিতভাবে ভারত বিরোধিতা ছড়ানো হয়েছিল এ ঘটনা তারই একটি প্রমাণ। বঙ্গবন্ধু সেদিন গোপন খবরের ভিত্তিতেই গিয়েছিলেন বেনাপোল। কাজেই ওখানে দাঁড়িয়েই তিনি সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দিলেন। সে নির্দেশ কার্যকর হয়েছিল কিনা জানার সুযোগ হয়নি। এবার বেনাপোলে এসে কয়েক যুগ আগের ঘটনাটি নতুন করে মনে পড়ল। লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক E-mail:[email protected]
×