ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

অধ্যাপক হাসান আবদুল কাইয়ূম

প্রসঙ্গ ইসলাম ॥ পবিত্র হজ্জ ও কুরবানি

প্রকাশিত: ০৫:২৫, ১৮ সেপ্টেম্বর ২০১৫

প্রসঙ্গ ইসলাম ॥ পবিত্র হজ্জ ও কুরবানি

আল্লাহ জাল্লা শানুহু হজ্জের বিধান দিয়ে ইরশাদ করেন : সেই সব মানুষের জন্য আল্লাহর উদ্দেশে বায়তুল্লাহর হজ্জ করা অবশ্য কর্তব্য যাদের সেখানে যাবার সামর্থ্য আছে। (সূরা আল ইমরান : আয়াত ৯৭) প্রত্যেক সামর্থ্যবান ব্যক্তির জন্য জীবনে একবার হজ্জ করা ফরয। এরপর হজ্জ করলে তা নফল হয়ে যাবে। উমরা এবং হজ্জের মধ্যে আকাশ সমান পার্থক্য রয়েছে। হজ্জের নিয়তে ইহরাম বাঁধা যায় শাওয়াল, জিলকদ ও জিলহজ্জ মাসের ৮ তারিখের আগ পর্যন্ত যে কোন দিনে। কিন্তু উমরা পালন করা যায় বছরের যে কোন দিনে। তবে রমাদান মাসে উমরা করলে হজ্জের সমান সওয়াব পাওয়া যায়। হজ্জ বিশ্ব মানবতার ঐক্য ও সংহতির প্রত্যক্ষ প্রশিক্ষণ প্রদান করে আর কুরবানি মানবতার শত্রু পাশবিকতাকে নিধন করার দৃঢ় প্রত্যয় সুসংহত করে। হজ্জ এবং কুরবানির বিধানের সঙ্গে মুসলিম জাতিসত্তার আদি পিতৃপুরুষ হযরত ইবরাহীম আলায়হিস সালামের উজ্জ্বল স্মৃতি জড়িয়ে রয়েছে। হযরত ইবরাহীম আলায়হিস সালাম নিঃসন্তান ছিলেন। ৮৬ বছর বয়সে তাঁর মিসরীয় স্ত্রী হযরত হাজিরা আলায়হাস সালামের গর্ভে জন্ম গ্রহণ করলেন এক পুত্র সন্তান। তিনি পুত্রের নাম রাখলেন ইসমাঈল। খুশি ও আনন্দে তার মন ভরে গেল। কিন্তু আল্লাহর নির্দেশে তাঁকে স্ত্রী হাজিরা ও শিশু পুত্র ইসমাঈলকে রেখে আসতে হলো বহু দূরে অবস্থিত আরবের এক পাহাড়ঘেরা বিরান উপত্যকা মক্কায় এক লাল রংয়ের স্তূপের পাশে। তাদের খাবার দাবারের জন্য এক মশক পানি এবং এক বস্তা খেজুর রেখে গেলেন। কিছুদিনের মধ্যে খেজুর ও পানি ফুরিয়ে গেল। হযরত হাজিরা পানির খোঁজে নিকটস্থ সাফা ও মারওয়া পাহাড়ে দৌড়াদৌড়ি করতে লাগলেন। হঠাৎ তিনি লক্ষ্য করলেন শিশু ইসমাঈলের পায়ের কাছে মাটি ফুড়ে পানি উঠছে। তিনি দৌড়ে এসে আজলা ভরে ছেলেকে পানি পান করালেন। এবং নিজেও পান করলেন। তিনি পাথর কুড়িয়ে এনে পানির উৎসের চারদিকে বেঁধে দিলে একটি কূপে পরিণত হলো। এটাই যমযম কূপ। এই যমযমের পানি তাদের খাবারের অভাবও মিটিয়ে দিল। এক রাতে হযরত ইবরাহীম আলায়হিস সালাম তার পুত্র ইসমাঈল (আ:)কে কুরবানি করার জন্য স্বপ্নে আদিষ্ট হলেন। কুরআন মজীদে ইরশাদ হয়েছে : ‘অতঃপর আমি (আল্লাহ) তাকে (ইব্রাহীমকে) একটি স্থিরবুদ্ধি পুত্রের সুসংবাদ দিলাম। অতঃপর সে যখন তার পিতার সঙ্গে কাজ করার মতো বয়সে উপনীত হলো তখন ইব্রাহীম বললেন, বেটা আমি স্বপ্নে দেখি যে তোমাকে আমি যবেহ্ করছি, এখন তোমার অভিমত কি বলো? তিনি বললেন, আব্বাজান আপনি যা আদিষ্ট হয়েছেন সেটাই করুন। ইন্শাআল্লাহ আপনি আমাকে ধৈর্যশীল পাবেন। যখন তারা উভয়েই আনুগত্য প্রকাশ করলেন এবং ইব্রাহীম তার পুত্রকে শোয়ালেন, তখন আমি (আল্লাহ্) তাকে (ইব্রাহীমকে) আহ্বান করে বললাম, হে ইবরাহীম, তুমি তো স্বপ্নাদেশ সত্যিই পালন করলে। এভাবেই আমি সৎকর্মপরায়ণদের পুরস্কৃত করে থাকি। নিশ্চয়ই এটা ছিল এক স্পষ্ট পরীক্ষা। আমি তাকে মুক্ত করলাম এক কুরবানির বিনিময়ে। এটা পরবর্তীদের স্মরণে রেখেছি।’ (সূরা সাফ্ফাত : আয়াত ১০১-১০৮) হযরত ইব্রাহীম আলায়হিস সালাম পুত্রের বিনিময়ে একটা দুম্বা কুরবানি দেন। তারপর থেকেই ঈদ-উল- আযহা বা কুরবানির ঈদ পালিত হয়ে আসছে ১০ জিলহজ্জে। এই কুরবানি হজ্জের বিধানের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। হজ্জ বিধান প্রবর্তিত হয় হযরত ইব্রাহীম আলায়হিস সালামের দ্বারা। আল্লাহ জাল্লা শানুহু হযরত ইবরাহীম (আ:)কে তার ঘর পুনর্নির্মাণের নির্দেশ দেন। এখানে উল্লেখ্য যে, এই ঘর হযরত নূহ আলায়হিস সালামের সময়কার মহাপ্লাবনে ধসে পড়ে একটা স্তূপে পরিণত হয়েছিল। আল্লাহর নির্দেশ পেয়ে ঐ ঘর আবার নির্মাণের জন্য হযরত ইব্রাহীম (আ:) মক্কা এলেন। এসে দেখলেন তাঁর পুত্র হযরত ইসমাঈল আলায়হিস সালাম একটি যয়তুন গাছের ছায়ায় বসে শিকার করার জন্য তীরে শান দিচ্ছেন। আব্বাকে দেখে তিনি খুবই খুশি হলেন। হযরত ইবরাহীম (আঃ) পুত্রকে জড়িয়ে ধরে বললেন : আমি একটা কাজ করার জন্য আদিষ্ট হয়েছি। অতঃপর পিতা-পুত্র মিলে লাল স্তূপ খুঁড়ে একটি ভিত্তির দেয়াল তুললেন। অর্থাৎ কা’বা ঘর পুনর্নির্মাণ করলেন। এতে হযরত হাজিরা (আ.)ও সহযোগিতা করেন। আল্লাহ জাল্লা শানুহু ইরশাদ করেন : ‘যখন আমি ইব্রাহীমের জন্য নির্ধারণ করে দিয়েছিলাম সেই গৃহের স্থান, তখন বলেছিলাম আমার সঙ্গে কোন শরিক স্থির করো না এবং আমার গৃহকে পবিত্র রেখো তাদের জন্য যারা তওয়াফ করে এবং সালাতে দাঁড়ায়, রুকু করে ও সিজদা করে। এবং মানুষের নিকট হজ্জের ঘোষণা করে দাও। ওরা তোমার নিকট আসবে পদব্রজে ও সব ধরনের ক্ষীণকায় উটের পিঠে, ওরা আসবে দূর দূরান্তর পথ অতিক্রম করে।’ (সূরা হজ্জ : আয়াত ২৬-২৮)। সেই তখন থেকে এই গৃহে হজ্জ করা শুরু হয় কিন্তু কালক্রমে হচ্ছে অনেক কুসংস্কার, শিরক অনুপ্রবেশ করে। ৬৩১ খ্রিস্টাব্দে আল্লাহ জাল্লা শানুহু প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের নিকট হজ্জ বিধান নাযিল করেন। শিরক ও কুসংস্কার দূরীভূত করে ৬৩২ খ্রিস্টাব্দে ১ লাখ চল্লিশ হাজার সাহাবায়ে কেরামকে নিয়ে প্রিয় নবী (সা.) হজ্জ পালন করলেন। তিনি যেভাবে হজ্জ পালন করেন আজও সেই নিয়মে হজ্জ পালিত হচ্ছে। সেদিন হজ্জের খুতবা শেষে আল্লাহ তা’আলা ইসলামের পূর্ণতা ঘোষণা করে ওহী নাযিল করেন। আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেন : ‘আজ তোমাদের জন্য তোমার দীনকে পরিপূর্ণ করলাম। আমার নিয়ামতকে তোমার জন্য সম্পূর্ণ করে দিলাম এবং তোমাদের দীন ইসলামকে সানন্দে অনুমোদন দান করলাম।’ (সূরা মায়িদা : আয়াত ৩)। লেখক : পীর সাহেব দ্বারিয়াপুর শরীফ, উপদেষ্টা ইনস্টিটিউট অব হযরত মুহাম্মদ (সা.), সাবেক পরিচালক ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ।
×