ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

মুনতাসীর মামুন

নিজের বিরুদ্ধে প্রচারের জন্য কোটি কোটি টাকা ব্যয়

প্রকাশিত: ০৫:৪০, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০১৫

নিজের বিরুদ্ধে প্রচারের জন্য কোটি কোটি টাকা ব্যয়

বাংলাদেশ সব সম্ভবের দেশে পরিণত হয়েছে, তা অবিশ্বাসের নয়। মাদ্রাসাগুলোর পাঠ্যপুস্তকে বাংলার ইতিহাসে নেই বঙ্গবন্ধু। সেখানে বহাল তবিয়তে বিরাজ করছে মওদুদী, গোলাম আযম গংরা। সরকারী অর্থে দেশ বিরোধী এসব পুস্তক মনোজগতে আধিপত্য বিস্তার করছে। গতকালের পর আজ পড়ুন দ্বিতীয় কিস্তি... জামায়াতে ইসলামী, অনেকে বলেন, কুরআন থেকে মওদুদীর বক্তব্যের ওপর বেশি গুরুত্ব দেয়। প্রধানমন্ত্রী বা ১৪ দলীয় নেতা মন্ত্রীরা মওদুদীবাদ পছন্দ করেন না? কি বলেন আপনারা? তাঁরা অপছন্দ করলে পাঠ্যবইয়ে মওদুদীর দর্শন এভাবে শিশুদের মনে গেঁথে দিতে পারেন? অসম্ভব। আওয়ামী লীগ নেতারা প্রধানমন্ত্রীর আপত্তি সত্ত্বেও কেন জামায়াত নেতা-কর্মীদের দলে ঢোকাচ্ছেন? সেটি বুঝতে হলে নিচের সংক্ষিপ্ত উদ্ধৃতিগুলো পর্যালোচনা করুনÑ ১. “সাইয়েদ আবুল আলা মওদুদী (র)-এর মতে মুসলমানদের হৃদয় ও মনের এক প্রান্ত দিয়ে যখন জাতীয়তাবাদের চেতনা অনুপ্রবেশ করে, তখন অন্য প্রান্ত দিয়ে ইসলাম নিষ্ক্রান্ত হয়। যে মুসলিম নিজেকে জাতীয়তাবাদের ধারক বলে জাহির করেন, তিনি ইসলামের আলোকবর্তিকা হতে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। ইসলামের বিশ্বজনীন আদর্শের বিপরীতে জাতীয়তাবাদ মানুষে মানুষে বিভক্তি আনে। জাতিতে জাতিতে হিংসা, বিদ্বেষ, লড়াই ও সংঘাত জাতীয়তাবাদেরই পরিণাম।” [ আলিম ইসলামী পৌরনীতি, ১ম ও ২য় পত্র, আল বারাকা লাইব্রেরী, ঢাকা, পৃ. ৭০] ২. আপনাদের হয়তো অনেকের ধারণা, বঙ্গবন্ধুর একটি রাজনৈতিক দর্শন ছিল। সেই দর্শনের ভিত্তিতে তিনি বাংলাদেশ আন্দোলনের সৃষ্টি করেন। পরিণামে আমরা বাংলাদেশ পেলাম। এটি যে কত বড় ভুল ধারণা তা বুঝতে পারলাম ইসলামী পৌরনীতি দেখে এবং পড়েÑ “ইসলামী সাহিত্য সৃষ্টির মাধ্যমে ইসলামী চেতনা ও সংস্কৃতি বিকাশে অনবদ্য অবদান রাখেন এ উপমহাদেশে সাইয়েদ আবু আল-মাওদুদী (র)। ইসলামী অর্থ ব্যবস্থা, ব্যাংকিং, জিহাদ ফী সাবিলিল্লাহ, রাজনৈতিক দর্শন প্রভৃতি ক্ষেত্রে তাঁর অবদান স্মরণীয় হয়ে থাকবে। ‘শুধু তাই নয়, লেখকের বক্তব্যের যথার্থতা তুলে ধরতে জামায়াতে ইসলামীর গঠনতন্ত্রও বিবৃত হয়েছে।’ [ঐ, পৃ. ৪৯১] আমি জানি দৈনিক জনকণ্ঠের ভক্তদের একটি বড় অংশ আওয়ামী লীগের ভক্ত, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির সদস্য। আওয়ামী লীগ সম্পর্কে তাদের ধারণা অনেক উচ্চ। তারা কেন এখন আমেরিকানদেরও অনেকে মনে করেন, আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এখন মাদ্রাসার পাঠ্যবই পড়লে আপনাদের মনে হবে চিরদিন একটি ভুল ধারণা পুষে আসছেন। ইসলামী পৌরনীতিতে ‘জামায়াতে ইসলামী’ শিরোনামে একটি অনুচ্ছেদ আছে। সেটি পড়ে জানলামÑ ‘বাংলাদেশে ইসলামী রাজনীতিতে সর্বাধিক বড় রাজনৈতিক দল জামায়াতে ইসলামী। এ দলের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন সাইয়্যেদ আবুল আলা মওদূদী। তিনি তাঁর লেখনীর মাধ্যমে ইসলামী রাজনীতিকে এ উপমহাদেশের মানুষের সামনে তুলে ধরতে প্রয়াস পেয়েছেন। জামায়াতে ইসলামী রাজনৈতিক কার্যাবলী ছাড়াও সমাজসেবায় উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছে। বাংলাদেশে প্রাকৃতিক দুর্যোগে দুর্গত মানবতার পাশে সব সময়ই জামায়াতে ইসলামী এগিয়ে আসে। এ দেশে ইসলামী অর্থনীতি চালুর প্রচেষ্টায় জামায়াতে ইসলামীর বলিষ্ঠ ভূমিকা মুখ্য। জামায়াতে ইসলামী শিক্ষাক্ষেত্রে অনবদ্য অবদান রেখেছে। পুস্তক প্রকাশনা, ফোরকানিয়া মাদ্রাসার পাঠ্যক্রম ও পাঠ্যসূচী প্রভৃতি প্রণয়নে জামায়াতে ইসলামী পরিচালিত ইসলামিক এডুকেশন সোসাইটি বিশেষ অবদান রেখেছে।’ [ইসলামী পৌরনীতি, ইসলামিয়া কুতুবখানা, বাংলাবাজার, ঢাকা পৃ . ৫৯১] জাতীয়তাবাদ যে কী ভয়ঙ্কর বিষয় সেটি মাদ্রাসার বই না পড়লে জানতে পারতাম না। এখন মনে হচ্ছে আলবদর বন্ধু জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধু প্রবর্তিত জাতীয়তাবাদকে উৎখাত করে খুব একটা খারাপ করেননি। শেখ হাসিনা এ পরিপ্রেক্ষিতে যে আবার জাতীয়তাবাদকে ফিরিয়ে আনলেন তার মাজেজা কী? কেননা এটি ইসলামী আদর্শের বিপরীত। আমি তাঁর অনেক বক্তৃতায় শুনেছি কোরান-সুন্নাহর পরিপন্থী কোন আইন বাংলাদেশে করা হবে না। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টও তাই মনে করত। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে এটি ঠিক নয়। জাতীয়তাবাদ ও ইসলাম এক সঙ্গে যেতে পারে না। ‘বিখ্যাত আলেম’ মওদূদী (র) জানিয়েছেনÑ ‘জাতীয়তাবাদ ও ইসলাম উভয়ে মতাদর্শ হিসেবে পরস্পরের বিপরীত। ... জাতীয়তাবাদ হচ্ছে বর্তমান বিশ্বে মানবতা যেসব বিপর্যয় ও বিপদাপদে নিপতিত তার মূল কারণ। ইসলামী চিন্তাবিদগণ বিদেশী আধিপত্য প্রতিহত করতেও জাতীয়তাবাদকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করার বিরোধী। জনগণের ভোটাধিকার, ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ ও সঙ্কীর্ণ চেতনাভিত্তিক জাতীয়তাবাদের সাথে শরিয়াহভিত্তিক ইসলামী বিশ্বজনীনতার কোন সামঞ্জস্য খুঁজে পাওয়া যাবে না। তাজদীদ ইসলাহ বা ইসলামী পুনর্গঠন আন্দোলন শক্তিশালী হওয়ার পর ১৯৭০ সাল হতে জাতীয়তাবাদী ধারণার শক্তি হ্রাস পেতে থাকে। [ইসলামী পৌরনীতি, আল-বারাকা লাইব্রেরি]। হায়, এতদিন জানতাম বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ১৯৭০ সালে বাঙালী জাতীয়তাবাদী চেতনা তীব্র হওয়াতেই মানুষ ঐক্যবদ্ধ হয়ে বিদেশী পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের শক্তি অর্জন করে। ইসলামের ইতিহাসে ইসলামী রাষ্ট্রের সংজ্ঞা দেয়া হয়েছে। এখানে মওদূদী ছাড়া মানবতাবিরোধী অপরাধী গোলাম আযমের উদ্ধৃতি ব্যবহার করা হয়েছে। সংগ্রাম সম্পাদক মুহাম্মদ আসাদও দেখছি রাষ্ট্রবিজ্ঞানীর মর্যাদা পেয়ে গেছেন। তাদের মতামত যা বইয়ে উদ্ধৃত হয়েছে তা হলোÑ সাইয়্যেদ আবুল আলা মওদূদী (র)-এর মতে, ‘ইসলামী রাষ্ট্র একটি আদর্শভিত্তিক রাষ্ট্র। ইসলামী আদর্শ বাস্তবায়নই এ রাষ্ট্রের লক্ষ্য। মানবজীবনের সব দিককে এ রাষ্ট্র ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করতে চায় বলে এটিকে সর্বাত্মক রাষ্ট্র বলা যায়।’ ‘অধ্যাপক গোলাম আযম-এর মতে, যে রাষ্ট্রের আইন রচনা, শাসন কার্য ও বিচারব্যবস্থা কুরআন ও সুন্নাহ দ্বারা চূড়ান্তভাবে নিয়ন্ত্রিত হয় তারই নাম ইসলামী রাষ্ট্র। তাঁর মতে, ইসলামী রাষ্ট্র রাসূল (সা) ও খোলাফায়ে রাশেদীনের দেখানো নমুনা অনুযায়ী পরিচালিত হয়।’ ‘মুহাম্মদ আসাদ-এর মতে, একটি রাষ্ট্রকে তখনই ইসলামী রাষ্ট্র বলা যায়, যখন ইসলামের সমাজ রাষ্ট্র সম্পর্কিত বিধানগুলো জাতির জীবনে সক্রিয়ভাবে প্রয়োগ করা হয় এবং দেশের মৌলিক শাসন সংবিধানে সেগুলো অন্তর্ভুক্ত করা হয়।’ ট্র্যাজেডিটা হচ্ছে, রাষ্ট্রবিজ্ঞান সম্পর্কে আমাদের ধারণা নিতে হবে একজন মানবতাবিরোধী অপরাধে দ-িত ও জঙ্গী মৌলবাদী পত্রিকার একজন সম্পাদক থেকে। [ইসলামী পৌরনীতি, আল-বারাকা লাইব্রেরি, পৃ. ৮৫৩] ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের জন্য বাঙালী দীর্ঘদিন সংগ্রাম করেছেন। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে সে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৯৭১ সালে। সংবিধানের চারটি মূলনীতির মধ্যে একটি ছিল ধর্মনিরপেক্ষতা যা তৎকালীন বিশ্বে অসম্ভব সাহসী কাজ বলে স্বীকৃত হয়েছিল। শুধু তাই, ধর্মভিত্তিক রাজনীতিও নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। যে কারণে, জামায়াতে ইসলামী রাজনীতি করার অধিকার হারিয়েছিল। আলবদর বন্ধু জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় এসে প্রথমেই সংবিধান থেকে এই মূলনীতি উৎখাত করেছিলেন। দীর্ঘ সংগ্রামের পর তাঁর কন্যা শেখ হাসিনা আবার এই মূলনীতি সংবিধানে সংযোজন করেছিলেন। কিন্তু, ইসলামী পৌরনীতিতে কী বলা হচ্ছেÑ ‘ধর্মনিরপেক্ষতা বলতে কোন কল্যাণমূলক মতবাদ পৃথিবীতে নেই। ধর্মনিরপেক্ষতা ধর্মহীনতার নামান্তর। ধর্মকে ধ্বংস করার কৌশল হিসেবে রচিত একটি অপতন্ত্র। কেননা, ধর্মনিরপেক্ষতার মূল কথা হলো, কোন ধর্মই স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়। সুতরাং রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে কোন ধর্মকেই মডেল হিসেবে গ্রহণ করা যাবে না। প্রত্যেক ধর্ম থেকে কিছু কিছু মূলনীতি গ্রহণ করে বাকি মূলনীতিগুলো মানব রচিত মতবাদ থেকে গ্রহণ করত: রাষ্ট্র পরিচালনা করতে হবে। এটি ইসলামী ধর্ম বিশ্বাসে সম্পূর্ণ পরিপন্থী।’ [ঐ, পৃ. ৩৮৭] রাবেতা ইসলাম নামে একটি এনজিওর কথা হয়ত অনেকে শুনে থাকবেন। জঙ্গীদের অর্থায়নে এর সম্পৃক্ততা আছে বলে অনেকে মনে করেন। কিন্তু ইসলামিয়া কুতুবখানা প্রকাশিত আলিম শ্রেণীর পৌরনীতির লেখক তা মনে করেন না। তার মতেÑ ‘মুসলিম বিশ্বে যে ইসলামী গণচেতনা সৃষ্টি হয়েছে, তা থেকে মুসলমানদের বিভ্রান্ত করতে ধর্মনিরপেক্ষ শক্তিগুলো সদা সচেষ্ট রয়েছে। খ্রীস্টান ও ধর্মনিরপেক্ষ শক্তিগুলোর হীন প্রচেষ্টা মোকাবেলা করার জন্য রাবেতা অনবদ্য ভূমিকা পালন করে আসছে।’ বঙ্গবন্ধু ধর্মনিরপেক্ষতা সম্পর্কে যে সংজ্ঞা দিয়েছিলেন তার কোন উল্লেখ নেই। কারণ, সেটি উল্লেখ করলে এই ধরনের বক্তব্য নাকচ হয়ে যায়। তিনি বলেছিলেন, যার যার ধর্ম সে সে নির্বিঘেœ পালন করবে। রাষ্ট্র সেখানে হস্তক্ষেপ করবে না। আওয়ামী লীগ ধর্ম বিষয়ে এত নমনীয়, না চাইতেই ধর্ম বিষয়ে সব রকমের তোষণে ব্যস্ত অথচ দুঃখের বিষয় এর কোন স্বীকৃতি নেই তাদের কাছে। এ বিষয়ে আমরা অনেকবার লিখেছি যা ক্রুদ্ধ করেছে আওয়ামী নেতাদের। তাদের দৃঢ় বিশ্বাস যারা ধর্ম নিয়ে রাজনীতি করে তাদের তোষণ এবং দলে সেই সব মনা লোকদের অন্তর্ভুক্তি আওয়ামী ভোট বৃদ্ধি করবে! ঐ বইয়ে একটি অনুচ্ছেদ আছে ‘ধর্ম বিষয় সরকারী উদ্যোগ’-এ বলা হয়েছেÑ ‘আওয়ামী লীগ সরকার ১৯৭৫ সালে ইসলামিক ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা করে, কিন্তু ইসলামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলোকে কাজ করতে না দেয়ায় ইসলামপন্থী দলগুলোর সঙ্গে তাদের সম্পর্ক বরাবরই তিক্ত ও বিদ্বেষপূূর্ণ ছিল। বিএনপি সরকার মরহুম জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে ১৯৭২ সালের সংবিধানের মূলনীতি সংশোধন করে বিসমিল্লাহ সংযোজিত হয় এবং অন্যতম মূলনীতি ধর্মনিরপেক্ষতার পরিবর্তে আল্লাহর উপর নির্ভরশীলতার কথা লিখিত হয়। বিএনপি সরকারের আমলে স্বায়ত্তশাসিত বাংলাদেশ মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড চালু হয় এবং ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় আইন জাতীয় সংসদে পাস হয়। ইসলামভিত্তিক রাজনৈতিক দলের রাজনীতি স্বীকৃত হয়। বর্তমানে বাংলাদেশ সরকার পরিচালনা করছে চারদলীয় ঐক্যজোট। এ চারদলীয় ঐক্যজোটের অন্যতম দুটি দল হলো জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ঐক্যজোট। তাই বলা যায়, এ দেশে ইসলামকে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে প্রতিষ্ঠাকরণের ক্ষেত্রে ইসলামী দলগুলো অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে সাফল্যের দ্বারপ্রান্তে এসে পৌঁছেছে। সময়ের বিবর্তনে এ দেশে হয়ত একদিন তাওহীদের পতাকা উত্তোলিত হবেÑ এমন ধারণা এ দেশের ইসলামপ্রিয় জনগণের।’ চলবে...
×