ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

প্রিয় ঋতু বন্দনা ছায়ানটের

শরতবাণীর বীণা বাজে ললিত রাগের সুরে ঝরে...

প্রকাশিত: ০৭:০১, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০১৫

শরতবাণীর বীণা বাজে ললিত রাগের সুরে ঝরে...

মোরসালিন মিজান শরতের ভাদ্র দিয়ে শুরু। এ শুরু বর্ষা দ্বারা আক্রান্ত। বিলম্বিত বর্ষার কবলে পড়ে প্রথম মাসটি ছেলে ছোঁকরার মতো কেঁদেকেটে পার করতে হয় শরতকে! যত প্রিয়ই হোক, এ সময় ঋতুটি বরণের আনুষ্ঠানিকতা মুশকিল হয়ে যায়। আর তাই আশ্বিন পর্যন্ত অপেক্ষা। এবারও তা-ই হলো। দ্বিতীয় মাসের তৃতীয় দিন শুক্রবার বরণ করে নেয়া হলো ষড়ঋতুর অন্যতম শরতকে। হ্যাঁ, নাগরিক আয়োজন। চারুকলার বকুলতলায়। আয়োজক- বাঙালী সংস্কৃতি লালন প্রচার ও প্রকাশে অগ্রণী সংগঠন ছায়ানট। আয়োজনটির মধ্য দিয়ে শরতকে ফুটিয়ে তোলা হলো। গানের ভাষায়, নাচের ছন্দে প্রকৃত চেহারায় ফিরল মাল্টিকালার সংস্কৃতির শহর ঢাকা। একান্তই যা নিজের, তা নিয়ে প্রকাশিত হলো। এভাবে প্রাণভরে গান শোনা হলো। নাচ উপভোগ করা হলো। হলো পরস্পরের সঙ্গে মিলিত হওয়ার উৎসব। সব মিলিয়ে অনন্য সুন্দর সাতসকাল। আর সব অনুষ্ঠানে দেরি করার রেওয়াজ মোটামুটি চালু আছে। ছায়ানটের বেলায় সেটি হয় না। আর তাই আগেভাগেই অনুষ্ঠানস্থলে আসতে শুরু করেন প্রকৃতিপ্রেমী মানুষ। মেয়েরা শাড়ি আর ছেলেরা পাঞ্জাবিতে সেজে এসেছিল। বুড়োরাও বাদ যাননি। শিশুদের উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো। নানা রঙের পোশাক। তবে একটু খেয়াল করলে বোঝা যায়, শরতের আকাশে যে রঙ তা বেছে নেয়ার চেষ্টা হয়েছে। পোশাকে হাত ধরাধরি করে ছিল সাদা আর নীল। খোঁপায় সুগন্ধী বেলী ফুল পেঁচিয়ে নিয়েছিলেন তরুণীরা। শরতের অন্যতম অনুষঙ্গ কাশফুল খুঁজে আনা হয়েছিল। সাজিয়ে রাখা হয়েছিল এখানে ওখানে। মঞ্চটাও খুব বেশি মেরামত করা হয়নি। সব মিলিয়ে তাই অকৃত্রিম পরিবেশ ছিল। এ পরিবেশেই মঞ্চে ওঠেন শিল্পীরা। একেবারে সামনের সারিতে ক্ষুদে গায়ক-গায়িকাদের বসানো হয়। পেছনের বেশ কিছুটা জায়গা ফাঁকা। এরপর দুই সারি। হাঁটু ভাঁজ করে বসেন বাকিরা। সকাল ৭টা বাজতেই বেজে ওঠে সুর। একেবারে সামনের সারি থেকে ভেসে আসেন রবীন্দ্রনাথ। সুরে সুরে ছায়ানটের শিক্ষার্থীরা শরতকে স্বাগত জানায়- দেখো দেখো, দেখো, শুকতারা আঁখি মেলি চায়/ প্রভাতের কিনারায়।/ডাক দিয়েছে রে শিউলি ফুলেরে-/ আ য় আ য় আ য়...। দ্বিতীয় পরিবেশনায় দ্বৈতকণ্ঠ। সুবর্ণা দে ও অভিজিত দাসের রবীন্দ্রসঙ্গীতে শরতের রূপের বর্ণনা- কনক কিরণঘন শোভন স্যন্দন- নামিছে শারদ সুন্দরী।/ দশদিক-অঙ্গনে দিগঙ্গনাদল ধ্বনিল শূন্য ভরি শঙ্খ সুমঙ্গল-/ চলো রে চলো চলো তরুণ যাত্রীদল তুলি নব মালতী মঞ্জরী...। সুদীপ সরকারের কণ্ঠে ছিল প্রথম এককÑ শুভ্র আসনে বিরাজ অরুণছটা মাঝে,/ নীলাম্বরে ধরণী পরে কিবা মহিমা তব বিকাশিল...। বড়দের প্রথম সম্মেলক গানটিÑ শরতবাণীর বীণা বাজে কমলদলে।/ ললিত রাগের সুর ঝরে তাই শিউলিতলে।/ তাই তো বাতাস বেড়ায় মেতে কচি ধানের সবুজ ক্ষেতে,/ বনের প্রাণে র্মমরানির ঢেউ উঠালে...। পরিবেশনাটি শেষ হতেই রবীন্দ্রনাথের খুব প্রিয় গানের তালিকা থেকে ভেসে আসেÑ এবার অবগুণ্ঠন খোলো।/ গহন মেঘমায়ায় বিজন বনছায়ায়/ তোমার আলসে অবলুণ্ঠন সারা হল/ শিউলি সুরভি রাতে বিকশিত জ্যোৎস্নাতে/ মৃদু মর্মর গানে তব মর্মের বাণী বোলো...। এটিএম জাহাঙ্গীরের ভরাট গলা সত্যি অসাধারণ শোনায়। সুতপা সাহার কণ্ঠে ছিলÑ কার বাঁশি নিশিভোরে বাজিল মোর প্রাণে/ ফুটে দিগন্তে অরুণকিরণ কলিকা/ শরতের আলোতে সুন্দর আসে...। ততক্ষণে বকুলের ঘন সবুজ পাতায় আলোর নাচন। সেদিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই মঞ্চে আসে ছোটদের একটি নৃত্যদল। এবার বোঝা হয়, ভরপুর নৃত্যায়োজনের চিন্তা মাথায় রেখেই ব্যবস্থাটি করে রাখা হয়েছিল। ফাঁকা জায়গার পুরোটাজুড়ে নাচে তারা। সঙ্গে গানটি ছিল খুবই মানানসইÑ আমরা বেঁধেছি কাশের গুচ্ছ, আমরা গেঁথেছি শেফালিমালাÑ/ নবীন ধানের মঞ্জরী দিয়ে সাজিয়ে এনেছি ডালা/ এসো গো শারদলক্ষ্মী, তোমার শুভ্র মেঘের রথে,/ এসো নির্মল নীলপথে...। সুন্দর কোরিওগ্রাফি। কাশফুলের সাদা আর আকাশের নীলে সেজে আসা মেয়েরা উৎসবের আমেজ ছড়িয়ে দেয় গোটা এলাকায়। এরপর তিনটি একক সঙ্গীত। একে এক পরিবেশন করেন দীপাঞ্জন মুখার্জী, সেমন্তি মঞ্জরী ও মোস্তাফিজুর রহামন তূর্য। পরিবেশনা শেষে ফের নৃত্যায়োজন। এবার বড়দের পরিবেশনা। ‘তোমার মোহন রূপে কে রয় ভুলে’ গানটির সঙ্গে নাচেন একদল তরুণী। এবার পোশাকে সাদার সঙ্গে যোগ হয় কচি পাতার সবুজ ও হালকা বেগুনী রং। নৃত্যটি দেখেও মুগ্ধ হতে হয়। উপস্থিত দর্শকের করতালির মধ্য দিয়ে শেষ হয় পরিবেশনা। গান ধরেন কাঞ্চন মোস্তফা, বিক্রম দাস ও মারুফা মঞ্জরী সৌমী। ‘শিউলি ফুল শিউলি ফুল’, ‘হে ক্ষণিকের অতিথি’ ও ‘অমল ধবল পালে লেগেছে’র মতো জনপ্রিয় গানগুলো গেয়ে শোনান তাঁরা। বার বার শোনা গানে মনের অজান্তেই গুন গুন করে ওঠেন শ্রোতা। একই রকম পরিচিত গান ‘শরতে আজ কোন্ অতিথি’। গানটির সঙ্গে নাচে বড়দের আরেকটি দল। কোরিওগ্রাফিটি এককথায় চমৎকার। পোশাক, অঙ্গসঞ্চালন, চোখের অভিব্যক্তি সবই এ পর্যায়ে পরিপক্ব মনে হয়। কার কোরিওগ্রাফি সেটি জানানো না হলেও অনুমান করা যায়, শর্মিলী বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন নেপথ্যে। শেষ দুটি একক গানের একটি পার্থ প্রতীম রায়ের ‘আমি চিনি গো চিনি তোমারে’। বেশ গেয়েছেন শিল্পী। তবে পরের গানটি খুব ব্যতিক্রম শোনায়। শিল্পী নাঈমা ইসলাম নাজ। তাঁর কণ্ঠে ছিলÑ তবু মনে রেখো যদি দূরে যাই চলে/ যদি পুরাতন প্রেম ঢাকা পড়ে যায় নবপ্রেমজালে...। কানে যতটা, তারও বেশি বুকে বাজে এই সুর। এত সুন্দর গায়কী, এত আবেদন, এত কাছে টানা, আহা! একক শেষ হলে সম্মেলক গানে ছিল ‘মেঘের কোলে রোদ হেসেছে’। না, মেঘ তখন একদমই ছিল না। তবে রোদের হাসিটা বড় হয়েছে। বড় হচ্ছিল ক্রমশ। এটি ছিল শেষ পরিবেশনা। আর শেষেরও পরে যে শেষটি, ‘আমার সোনার বাংলা’। হ্যাঁ, জাতীয় সঙ্গীত। শিল্পীরা দাঁড়িয়ে গান। আগতদের কেউ বাদ থাকেন না। দৃশ্যটি ভোরবেলায় স্কুলের আঙ্গিনায় গাওয়া জাতীয় সঙ্গীতের কথা মনে করিয়ে দেয়! জাতীয় সঙ্গীত শেষে মুড়ি-মুড়কিতে আপ্যায়ন। হাত বাড়িয়ে একটি তুলে নিয়ে তবেই পরস্পরকে বিদায় বলা। অবশ্য ততক্ষণে এ-ও মনে হয়েছে, আয়োজনটি কেবল রবীন্দ্রনাথের গীতবিতানে আটকেছিল। অথচ এর বাইরেও শরত আছে। সেখান থেকেও নেয়া যেত। না নেয়ার ফলে কখনও সখনও মনে হয়েছে, এটি কোন একটি রবীন্দ্রসঙ্গীতের আসর শুধু!
×