ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

বন্যপ্রাণী রক্ষার্থে আইনের প্রয়োগ অপরিহার্য

প্রকাশিত: ০৪:১২, ২০ সেপ্টেম্বর ২০১৫

বন্যপ্রাণী রক্ষার্থে আইনের প্রয়োগ অপরিহার্য

প্রাকৃৃতিক নিয়মের হেরফের না ঘটলে আর মাসতিনেকের মধ্যেই শীতের আগমন ঘটবে দেশে। আগমন ঘটবে শীতের পরিযায়ী পাখিদেরও। শুধু ভরা শীতেই নয়, অক্টোবরের মধ্যেও কিছু কিছু প্রজাতির আগমন ঘটে দেশে। মূলত এ পরিযায়ী পাখিরা আমাদের দেশে আসে উষ্ণতার খোঁজে এবং খাবারের সন্ধানে। দেশের অধিকাংশ মানুষের কাছে ওরা অতিথি পাখি নামে পরিচিত। আসলে ওরা অতিথি নয়, পরিযায়ী পাখি। শব্দ দুটির মধ্যে বিস্তর ফারাক থাকলেও পাখি শিকারীরা দুটি শব্দের অর্থকে এক করে ফেলেন। এতে করে ওদের লাভ বৈ লোকসান হয় না। কারণ রসনাবিলাসীরা অতিথি পাখির মাংসের প্রতি দুর্বল থাকেন। তাদের চাহিদার কারণে নির্মমতার শিকার হয় পরিযায়ী পাখিরা। প্রতিবছর এ ধরনের সংবাদ খবরের কাগজ মারফত জানতে পারি আমরা। বন্যপ্রাণী নিয়ে লেখার বদৌলতে সংবাদটি কোন কোন সময় আগাম পেয়ে যাই। সে সুবাদে পেয়ে গেলাম ‘চলনবিল এলাকায় চলছে পাখি নিধনের উৎসব’। সংবাদটি জানতে পেরে খানিকটা বিচলিত হয়ে পড়েছি। রীতিমতো শরীরটা ঘেমে উঠেছে। এ কেমন কথা! দিনেদুপুরে পাখি নিধন করছে দুষ্কৃতকারীরা। তা আবার প্রকাশ্যে বিক্রিও করছে। দেশের পত্র-পত্রিকায় এ ধরনের দুষ্কৃতকারীদের নাম দেয়া হয় শিকারী। কিন্তু আমাদের চোখে এরা দুষ্কৃতকারীই, শিকারী নয়। শিকারীরা অমন ছিঁচকে স্বভাবের হতে পারে না। বিশেষ করে ফাঁদ পেতে বা বিষটোপ প্রয়োগ করে যারা পাখি নিধন করে, তারা কোনদিনও শিকারীর কাতারে পড়তে পারে না। অপ্রাসঙ্গিক কথা না বাড়িয়ে শুধু এ টুকুই বলব, যেখানে আমাদের দেশে ‘বালিহাঁস’ মহাবিপন্নের তালিকায় স্থান করে নিয়েছে, সেখানে চলনবিল এলাকায় নাকি একজোড়া বালিহাঁস বিক্রি হয় মাত্র ৪০০-৫০০ টাকা! এর চেয়ে দুঃখজনক সংবাদ আর কি হতে পারে, তা আমাদের জানা নেই। তাই এ ব্যাপারে কোন ধরনের মন্তব্য করতে নারাজ। শুধু এটুকুই বলব, আমাদের পরিবেশকে বাঁচিয়ে রেখেছে যারা, ওদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে বনের পাখিরা। ওরা শুধু পরিবেশের ভারসাম্যই রক্ষা করছে না, ওরা আমাদের প্রকৃতির কঠিন পরিবেশে খাপ খাইয়ে বাঁচিয়ে রাখতে সহায়তা করছে। অভিযোগ রয়েছে, পাখিরা আমাদের ফল-শস্যাদি খেয়ে ফেলছে। বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, ওই ফলটা খেয়ে দূরে কোথাও গিয়ে মল ত্যাগের মাধ্যমে বনায়ন সৃষ্টির ফলে অক্সিজেন ফ্যাক্টরি তৈরি করছে। আরও অবাক করা তথ্য হচ্ছে, হাওড়াঞ্চলের মানুষের ধারণা, পরিযায়ী পাখিরা শুধু তাদের ফসল খেয়েই বিনষ্ট করছে। অথচ দেখুন সেই পরিযায়ী পাখিরা হাওড়েই প্রতিদিন একটনের বেশি বিষ্ঠাত্যাগ করছে। যার ফলে ফসলের গাছ-গাছালি ও মাছেরা পাচ্ছে উপযুক্ত খাবার। উপকারী বন্ধু পরিযায়ী পাখিসহ অন্যান্য পাখি নিধন করা দুষ্কৃতকারীদের এখন অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। ওদের খাবারে বিষ মাখিয়ে, বিভিন্ন ধরনের ফাঁদ পেতে পাখি শিকার করা হচ্ছে। কি জঘন্য কাজই না করছে ওরা। এ ধরনের ন্যক্কারজনক ঘটনার ফলে আজ দেশ থেকে অনেক প্রজাতির পাখি হারিয়ে গেছে। যেমন হারিয়েছে ফ্লোরিকান ময়ূর, পিংক মাথা হাঁস ও রাজশকুন। আর হারিয়ে যেতে বসেছে ভাদিহাঁস, বালিহাঁস, দিগহাঁস, কালো তিতির, চন্দনা, বাংলা শকুন ইত্যাদি প্রজাতির পাখি। এ ছাড়াও আরও ১৯ প্রজাতির পাখি মহাবিপন্নের তালিকায় স্থান করে নিয়েছে। বিষয়টা ভাবতে কেমন লাগছে? কেমন লাগছে পরিবেশটা ভারসাম্য হারিয়ে পঙ্গু হতে দেখে? এ নিধন দ্রুত বন্ধ না হলে অদূর ভবিষ্যতে অন্ধকারের দিকে ঠেলে নিয়ে যাবে আমাদের আগামী প্রজন্মকে। তাই আমাদের উচিত প্রকাশ্যে, অপ্রকাশ্যে বন্যপ্রাণীদের ওপর যেন অত্যাচার নিপীড়ন না ঘটে তার প্রতি সজাগ দৃষ্টি দেয়া। কাজটি কিন্তু ইচ্ছে করলেই করতে পারি আমরা। প্রমাণস্বরূপ বলতে হয়, গ্রামের যে ছেলেটি এক সময় ফাঁদ পেতে বা ঢিলছুঁড়ে পাখি শিকার করত, সে যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করতে আসে, তখন ছেলেটির চরিত্র পাল্টে যায়। পাখি নিধন না করে বরং পাখি সংরক্ষণ কমিটিতে যোগ দেয়। এটি হচ্ছে কেন? এটি হচ্ছে প্রচার-প্রচারণার বদৌলতে। তাই বন্যপ্রাণী রক্ষার ক্ষেত্রে আমাদের প্রচার-প্রচারণাসহ ব্যাপকভাবে আইনের প্রয়োগ ঘটাতে হবে। যাতে প্রকাশ্য দিবালোকে কেউ বন্যপ্রাণী নিধন করতে না পারে। সরকার ইতোমধ্যে বন্যপ্রাণী রক্ষার্থে কিছু ভাল পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। এর মধ্যে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা আইন ২০১২ পাস করেছে। ওই আইনের ১নং ও ২নং তফসিলে ৬৫০ প্রজাতির পাখিকে ‘প্রোটেক্টেড বার্ড’ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। পরিযায়ী পাখি শিকারের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ১ বছরের কারাদ- অথবা সর্বোচ্চ এক লাখ টাকা জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে। সুন্দরবন ও টাংঙ্গুয়ার হাওড়কে ‘রামসার সাইট’ ঘোষণা করেছে। অপরদিকে টাঙ্গুয়ার হাওর, হাইল হাওড়, হাকালুকি হাওড়, নিঝুম দ্বীপ ও সোনাদিয়া দ্বীপকে ‘ফ্লাইওয়ে সাইট’ ঘোষণা করেছে। এ সকল এলাকায় বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে পরিচালিত ‘স্ট্রেংদেনিং রিজিওনাল কো-অপারেশন ফর ওয়ার্ল্ড লাইফ প্রটেকশন’ প্রকল্পের আওতায় বনবিভাগ-এনজিও-বিশ্ববিদ্যালয় যৌথভাবে কার্যক্রম গ্রহণ করেছে। শকুনের মরণঘাতী ওষুধ ডাইক্লোফেনাক উৎপাদন নিষিদ্ধ করেছে সরকার। বন্যপ্রাণীপ্রেমীদের উৎসাহিত করতে ‘বঙ্গবন্ধু এওয়ার্ড ফর ওয়াইল্ড লাইফ কনজারভেশন’ প্রদান করছে। উদ্ধারকৃত ও আহত পাখির সেবাদানে সারাদেশে ৪টি অঞ্চলে ‘বন্যপ্রাণী উদ্ধার কেন্দ্র’ স্থাপন করেছে। পাখি সমৃদ্ধ এলাকাকে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় ‘ইকোলজিক্যাল ক্রিটিক্যাল এরিয়া’ ঘোষণা করেছে। এ ছাড়াও বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইন ২০১২-তে উল্লেখ আছে, বাঘ বা হাতি হত্যা করলে সর্বোচ্চ ১০ লাখ টাকা জরিমানা; ৭ বছরের কারাদ-ের বিধান রয়েছে। অন্যসব বন্যপ্রাণী শিকার করলে অথবা আইন লঙ্ঘনকারীকে সর্বোচ্চ ১ লাখ টাকা জরিমানা এবং ১ বছর কারাদ-ের কথা বলা আছে। আইনটি বাস্তবায়ন হলে অনেক বিপন্ন বন্যপ্রাণী রক্ষা পাবে। তবে এ ক্ষেত্রে শুধু আইন পাস হলেই চলবে না, তার প্রয়োগও হতে হবে যথাযথ। বাস্তবে আইন তেমন একটা প্রয়োগ হচ্ছে না আমাদের দেশে। তাই কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলছি, দ্রুত বন্যপ্রাণী নিধন আইন বাস্তবায়নের পদক্ষেপ নিয়ে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার্থে এগিয়ে আসুন। কারণ বঙ্গবন্ধু কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ‘চ্যাম্পিয়ন্স অব দি আর্থ’ পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন ইতোমধ্যে। নিজে একজন পরিবেশকর্মী হয়ে তাঁর এ গৌরবান্বিত অর্জনের অংশীদারিত্ববোধ করছি এবং প্রত্যাশা করছি, তিনি আইনটি বাস্তবায়নে কঠোর দিকনির্দেশনা দেবেন। লেখক : কথাসাহিত্যিক বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ
×