ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

‘রিজার্ভের টাকা পদ্মা সেতু ও অন্যান্য অবকাঠামো উন্নয়নে ব্যয় হবে’

প্রকাশিত: ০৫:৩২, ২০ সেপ্টেম্বর ২০১৫

‘রিজার্ভের টাকা পদ্মা সেতু ও অন্যান্য অবকাঠামো উন্নয়নে ব্যয় হবে’

অর্থনৈতিক রিপোর্টার ॥ দেশের অবকাঠামোগত উন্নয়নে রিজার্ভের টাকা বিনিয়োগ করবে বাংলাদেশ ব্যাংক। পদ্মা সেতুসহ যে কোন বড় প্রকল্পের ক্ষেত্রে হতে পারে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গবর্নর ড. আতিউর রহমান। তিনি বলেন, সরকার যখন নিজ তহবিলে পদ্মা সেতু তৈরির ঘোষণা দিয়েছে তখন থেকেই কেন্দ্রীয় ব্যাংক এ ধরনের প্রস্তুতি নিয়েছে। বর্তমানে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভের পরিমাণ ২৬ বিলিয়ন ডলার। যা দক্ষিণ এশিয়ায় দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। শনিবার বাংলাদেশ ব্যাংকের ‘দ্বিতীয় কৌশলগত পরিকল্পনা ২০১৫-২০১৯’ এর মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি তথ্য জানান। মিরপুর বাংলাদেশ ব্যাংক ট্রেনিং একাডেমিতে এটি অনুষ্ঠিত হয়। কেউ যদি টেকশই অবকাঠামোগত উন্নয়নের জন্য ৭ বা ৮ বিলিয়ন মূল্যমানের বড় প্রকল্প নিয়ে আসলে সেখানে রিজার্ভ অর্থ বিনিয়োগ করা হবে বলেও জানিয়েছেন তিনি। ডেপুটি গবর্নর নাজনীন সুলতানার সভাপতিত্বে আলোচনায় অংশ নেন এস কে সুর চৌধুরী, আবু হেনা মোঃ রাজী হাসান, নির্বাহী পরিচালক মোঃ আহসান উল্লাহ। অনুষ্ঠানে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উর্ধতন কর্মকর্তা ও বিভিন্ন ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীরা। পরামর্শ জাহাঙ্গীর কবিরের সঞ্চলনায় এতে স্বাগত বক্তব্য দেন বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক মোঃ আহসান উল্লাহ। আগামী পাঁচ বছরের জন্য তৈরি করা কর্মপরিকল্পনা কেমন হবে তার বর্ণনা করতে গিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের গবর্নর বলেন, অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধি ও মূল্য স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে বিচক্ষণ মুদ্রানীতি গ্রহণ, রেগুলেটরি ও নজরদারি কাঠামো আরও জোরদারকরণ, টেকসই উন্নয়নের জন্য সামাজিক দায়বোধ প্রণোদিত, অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং পরিবেশবান্ধব অর্থায়নের ওপর গুরুত্ব দিয়ে দ্বিতীয় কৌশলগত পরিকল্পনা ২০১৫-১৯ প্রণয়ন করা হয়েছে। এই পরিকল্পনায় মোটাদাগে ১৪টি কৌশল, এসব কৌশল বাস্তবায়নে ১০৫টি উদ্দেশ্য এবং মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদে ৩১০টি কর্মপরিকল্পনা নির্ধারণ করেছি। কর্মপরিকল্পনা মূল্যায়নে ৩৯৫টি সূচকও নির্ধারণ করা হয়েছে। এই কৌশলগত পরিকল্পনা অনুযায়ী বাংলাদেশ ব্যাংকের সকল বিভাগকে নিজ নিজ কর্মপরিকল্পনা তৈরি করতে হবে। যার ফলাফল হিসেবে ৫ বছর পর পুরোপুরি আমলাতান্ত্রিক জটিলতামুক্ত একটি কেন্দ্রীয় ব্যাংক পাওয়া যাবে বলে আশাপ্রকাশ করেন গবর্নর। কেমন বাংলাদেশ ব্যাংক দেখতে চাই এমন প্রশ্নের জবাবে গবর্নর বলেন, বিশ্বমানের একটি কেন্দ্রীয় ব্যাংক গড়তে চাই। যেখানে কোন আমলাতান্ত্রিক জটিলতা থাকবে না, নিয়ম-নীতি হবে সহজ, কিন্তু প্রয়োগ হবে খুবই কঠিন, যেখানে নিচের দিকের কর্মীরা ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব নেবেন, ওপরের দিকের কর্মীরা নেতৃত্ব দেবেন, যেখানে নেতৃত্বের বিকাশ ঘটবে। যার তথ্য সব সময় হালনাগাদ ও সহজলভ্য থাকবে, যার সেবা পেতে সেবা গ্রহণকারীদের কোন বেগ পেতে হবে না। একটি দূরদর্শী বাংলাদেশ ব্যাংক গড়তে চাই, যেখানে কেউ পুরনোকে আকড়ে ধরে থাকবে না, যেখানে নতুন নতুন ব্যাংকিং ধারণার উদ্ভব হবে, যে বাংলাদেশ ব্যাংক দেশকে দ্রুত উচ্চ মধ্যম আয়ের কাতারে নিয়ে যেতে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে। ২০১০-২০১৪ সালে কর্মপরিকল্পনা সফলভাবে বাস্তবায়ন হয়েছে বলে উল্লেখ করেন গবর্নর। পাঁচ বছর মেয়াদী প্রথম ‘কৌশলগত পরিকল্পনা ২০১০-১৪’-এর প্রায়োগিক সাফল্যের হার শতকরা ৯৪ শতাংশ। এ কর্মপরিকল্পনার কারণেই চলতি বছর ১৬ হাজার ৪০০ কোটি টাকার কৃষি ঋণ বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা, বর্গাচাষীদের জন্য ৫০০ কোটি টাকার বিশেষ ঋণ সুবিধা, যার আওতায় দশ লাখ বর্গাচাষীকে প্রায় ১৮০০ কোটি টাকা অর্থায়ন, বছরে এক লাখ কোটি টাকার এসএমই ঋণ বিতরণ, যেখানে ৫ শতাংশ নারী উদ্যোক্তা ঋণসহ মোট আড়াই লাখ উদ্যোক্তাকে ঋণ প্রদান, ৪৩ হাজার ৬০০ কোটি টাকার পরিবেশবান্ধব ঋণসহ সুবিধাবঞ্চিত মানুষের ১০ টাকায় হিসাব খোলার মতো কাজ করা সম্ভব হয়েছে বলে জানান তিনি। ব্যাংকিং সেবায় যুক্ত হয়েছে স্কুল ব্যাংকিং, পথশিশুদের জন্য ব্যাংকিং সুবিধা, নারী উদ্যোক্তা উন্নয়ন, গ্রিন ব্যাংকিং, সিএসআর, দ্রুত টাকা পাঠানোর জন্য মোবাইল ব্যাংকিং ও প্রত্যন্ত অঞ্চলে ব্যাংকিং সেবা পৌঁছাতে এজেন্ট ব্যাংকিং প্রবর্তন-সবই এই অভিযানেরই অংশ। এরই মধ্যে এর সুফলও পেতে শুরু করেছে অর্থনীতি। শুধু তাই নয়, বাংলাদেশ ব্যাংক সারাবিশ্বে অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থায়নের এক ‘রোল মডেল’ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। দেশের সার্বিক অর্থনীতির সূচকের বর্তমান অবস্থান তুলে ধরে গবর্নর বলেন, আজ বলতে দ্বিধা নেই, এ অঞ্চলের সবচেয়ে স্থিতিশীল ও সফল অর্থনীতি এখন বাংলাদেশেরই। আর্থিক অন্তর্ভুক্তির সেই মধুর অভিজ্ঞতা থেকে আবারও ৫ বছরের কৌশলপত্র। প্রত্যেক মানুষের জন্য মানবিক ব্যাংকিং এই ধারণার বিস্তার চায় বাংলাদেশ ব্যাংক। সারা বিশ্বের মুদ্রাবাজারে টাল-মাতাল অবস্থার মধ্যেও বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি ও মুদ্রার মান স্থিতিশীল রয়েছে বলে উল্লেখ করেন আতিউর রহমান। তবে ২০১৫-২০১৯ সালের জন্য নেয়া কর্মপরিকল্পনার মধ্য দিয়ে দেশের প্রতিটি মানুষকে ব্যাংকিং চ্যানেলের সঙ্গে সম্পৃক্ত করার আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি। বিনিয়োগ প্রক্রিয়ার ব্যাখ্যা দেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ডেপুটি গবর্নর এস কে সুর চৌধুরী। তিনি বলেন, নিয়ম আছে, একটি দেশের আমদানি ব্যয় মেটানোর জন্য কমপক্ষে তিন মাসের টাকা রিজার্ভে রাখার। আমাদের যে ২৬ বিলিয়ন আছে তা দিয়ে প্রায় ৭ মাসের ব্যয় মেটানো সম্ভব। এতে আমাদের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হচ্ছে। কারণ আমরা এখন সার্কের মধ্যে রিজার্ভে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ অবস্থানে রয়েছি। আমাদের এ টাকা পদ্মা সেতু তৈরিতে ব্যয়ের একটা প্রস্তুতি রয়েছে। যে পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা প্রয়োজন হবে তা এখান থেকে দেয়া হবে। পলিসি অনুযায়ী অবকাঠামোগত উন্নয়নে এখান থেকে টাকা ব্যবহার করা হবে। তাই দেশের মধ্যে যারা অবকাঠামোর উন্নয়ন নিয়ে কাজ করে তাদের দেড় থেকে ২ শতাংশ সুদে এ টাকা দেয়া হবে। এ সময় ডেপুটি গবর্নর আরও বলেন, পদ্মা সেতুর তৈরির মোট সময়কে ভাগ করে নিয়ে ধাপে ধাপে এ টাকা ছাড় করা হবে। আলোচনায় বক্তারা জানান, বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ আর্থ-সামাজিক বিষয়কে প্রাধান্য দিয়ে এ পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে অস্থিতিশীলতা ও ভারসাম্যহীনতার ঝুঁকি মোকাবেলা ও আর্থিক ব্যবস্থায় অন্তর্ভুক্তিমূলক সামাজিক দায়বোধ, পরিবেশবান্ধব টেকসই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, আর্থিক খাতের অভিঘাত সহনক্ষমতা বৃদ্ধি এবং আর্থিক মধ্যস্থতা প্রক্রিয়াকে সচল ও গতিশীল করা।
×