ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

জাহিদুল আলম জয়

কুষ্টিয়ার রাজা তিলের খাজা

প্রকাশিত: ০৭:১৮, ২০ সেপ্টেম্বর ২০১৫

কুষ্টিয়ার রাজা তিলের খাজা

কুষ্টিয়ার তিলের খাজার জুড়ি মেলা ভার। সারাদেশেই অত্যন্ত জনপ্রিয় কুষ্টিয়ার তিলের খাজা। উপাদেয় এবং দামে কম বলে এটি গ্রামে-গঞ্জে, শহর-বন্দরে সবখানে অত্যন্ত জনপ্রিয়। রেলওয়ে স্টেশন, বাসস্ট্যান্ড, ফেরি বা লঞ্চঘাটসহ অলিতে গলিতে রাস্তায় প্রায় সর্বত্রই পাওয়া যায় কুষ্টিয়ার তিলের খাজা। ফেরিওয়ালারা তিলের খাজা ফেরি করে বেড়ায় আনাচে-কানাচে সর্বত্রই। এদের কাছে প্রায়শ শোনা যায়- ‘তিলের খাজা খেতে মজা’, ‘এ-ই কুষ্টিয়ার তিলের খাজা, স্বাদে মজা’, ‘তিলের খাজা খান, কুষ্টিয়া যান’ ইত্যাদি জনপ্রিয় স্লোগান। আসছে ঈদে ঘরমুখো মানুষের কাছে কুষ্টিয়ার সুস্বাদু খাজা পৌঁছে দিতে অক্লান্ত পরিশ্রম করছেন এই অঞ্চলের খাজা শিল্পীরা। তিলের খাজা তৈরির প্রধান উপকরণ তিল ও চিনি। চুলায় চাপানো বড় লোহার কড়াইয়ের মধ্যে চিনি জালানোর পর তৈরি হয় সিরা। নির্দিষ্ট তাকে আসার পর নামানো হয় চুলা থেকে। হালকা ঠা-া হলে, চিনির সিরা জমাট বেঁধে যায়, তখন শিংয়ের মতো দো-ডালা গাছের সঙ্গে হাতে টানা হয় জমাট বাঁধা চিনির সিরা। একপর্যায়ে বাদামি থেকে সাদা রঙে পরিণত হলে কারিগর বিশেষ কায়দায় হাতের ভাঁজে ভাঁজে টানতে থাকে। তখন এর ভেতরে ফাঁপা আকৃতির হয়। সিরা টানা শেষ হলে রাখা হয় পরিষ্কার স্থানে। নির্দিষ্ট মাপে কেটে তাতে মেশানো হয় খোসা ছাড়ানো তিল। এভাবেই তৈরি হয় তিলের খাজা। পরে এগুলো প্যাকেটজাত করে চালান দেয়া হয় দেশের বিভিন্ন স্থানে। কুষ্টিয়ার পাল সম্প্র্রদায়ের লোকজন সর্বপ্রথম খাজা তৈরি শুরু করেন। সারা বছরই তৈরি করা হয় তিলের খাজা। তবে শীত মৌসুমে এর আলাদা কদর থাকে। কুষ্টিয়ার হাজারো ঐতিহ্যের মধ্যে তিলের খাজা একটি। কুষ্টিয়ার তিলের খাজার নাম শুনলে জিভে জল আসে না এমন লোকের সংখ্যা কমই আছে। এক সময় শুধু স্থানীয় চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে তিলের খাজা তৈরি করা হতো। কালের আবর্তে এর কদর বেড়েছে দেশজুড়ে। এটি এখন পরিণত হয়েছে ক্ষুদ্রশিল্পে। তবে স্বাধীনতার পর দেশের অনেক কিছু বদলালেও, ভাগ্য বদলায়নি এই শিল্পের সঙ্গে জড়িতদের। কুষ্টিয়ার তিলের খাজার ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়,অখন্ড ভারতীয় উপমহাদেশের সময়কালে এর আবির্ভাব ঘটে কুষ্টিয়ায়। ভারত-পাকিস্তান বিভক্ত হওয়ার আগে কুষ্টিয়া শহরের দেশওয়ালিপাড়া এলাকার বেশ কয়েকটি পরিবার তিলের খাজা তৈরি করত। এরপর থেকেই কুষ্টিয়ায় আস্তে আস্তে তিলের খাজার প্রসার ঘটতে থাকে। ১৯৭১ সালের পর কুষ্টিয়া শহরের চরমিলপাড়ায় গড়ে ওঠে তিলের খাজা তৈরির কারখানা। তখন থেকেই মূলত কুষ্টিয়ার তিলের খাজার সুনাম ছড়িয়ে পড়ে দেশজুড়ে। বর্তমানে কুষ্টিয়ার বিখ্যাত তিলের খাজা নামে দেশের বিভিন্ন জেলায় এর কারখানা আছে। অন্য জেলার কারখানাতেও কুষ্টিয়ার কারিগররাই কাজ করে থাকেন। কুষ্টিয়া থেকে কাজ শিখে তারা অন্য জেলার কারখানায় কাজ করছে। কুষ্টিয়ার বিখ্যাত ১নং নিউ স্পেশাল ভাই ভাই তিলের খাজা নামে ঢাকা, খুলনা, রাজবাড়ী, সৈয়দপুর ও কুষ্টিয়ায় তৈরি হচ্ছে তিলের খাজা। তিলের খাজার চাহিদা থাকায় কুষ্টিয়ায় বেড়েছে তিলের আবাদ। তিলের খাজা উৎপাদন ক্ষুদ্র শিল্প হিসেবে বিবেচিত। এ ক্ষুদ্রশিল্প প্রতিষ্ঠান প্রচুর লোকের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করেছে। ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের জন্য ব্যাংক প্রতিষ্ঠান থেকে আর্থিক সুবিধা সৃষ্টি করা হলে আরও এগিয়ে যাবে এ শিল্পের সঙ্গে জড়িতরা। বর্তমানে আর্থিক অস্বচ্ছলতার কারণে অনেকটাই দিশাহারা তিলের খাজার প্রস্তুতকারীরা। আর্থিক অনটনের কারণে তারা ঠিকমতো তৈরি করতে পারছেন না তিলের খাজা। কুষ্টিয়ার মিলপাড়ার এক কারখানার মালিক বিমল চন্দ্র বলেন, ‘যে অবস্থা হয়েছে তাতে এই পেশা ছাড়তে হবে। আমাদের আর্থিক সঙ্কট আছে। বর্তমানে সবকিছুর দাম বেড়েছে। কিন্তু খাজার দাম বাড়ালে ক্রেতা পাওয়া কঠিন হয়।’ তাছাড়া আপসোসের সুরে তিনি আরও বলেন, ‘এখন অনেক জায়গাতেই তিলের খাজা বানানো হয়। কিন্তু বেশিরভাগেরই সঠিক মান থাকে না। এজন্য আমাদের সুনাম নষ্ট হচ্ছে’। কুষ্টিয়ার তিলের খাজা শিল্প আমাদের ঐতিহ্য। এই ঐতিহ্য রক্ষা এবং সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে প্রয়োজন উপযুক্ত পৃষ্ঠপোষকতা।
×