ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

রেজা ফারুক

ফিরে এলো জামদানি

প্রকাশিত: ০৬:৩৬, ২১ সেপ্টেম্বর ২০১৫

ফিরে এলো জামদানি

বাঙালী নারীর ভূষণ হিসেবে একসময় বিশাল জায়গা জুড়ে ছিল জামদানি শাড়ির অবস্থান। হস্তচালিত তাঁতে বুননকৃত বিখ্যাত ঢাকাই জামদানির কদর ছিল সমগ্র ভারত উপমহাদেশ জুড়েই। প্রাচীন পরিধেয় বস্ত্র হিসেবে জামদানি শাড়ির বিপণন ব্যবস্থায় ছেদ পড়ে যখন ব্রিটিশরা ভারতবর্ষে ক্ষমতা কুক্ষীগত করেÑ কলের যন্ত্রে বোনা বস্ত্রাদি বিপণন চালু করে। হাতে বোনা তাঁতের শাড়ি তৈরিতে যে খরচ হতো, কলের শাড়ি তৈরির খরচ অনেক কম হওয়ায় ধীরে ধীরে বেশি দামে তাঁতে বোনা শাড়ির চাহিদা হ্রাস পেতে শুরু করে এবং এর একটা নেতিবাচক প্রভাব পড়ে তৎকালীন জামদানি শিল্পের ওপর। যদিও জামদানি শাড়ির বুননশৈলী, পাকা রং, টেকসই, মান ও ডিজাইনে সমৃদ্ধ ও সুন্দর ছিল, তারপরেও সস্তায় কলের শাড়ির প্রতিই তৎকালীন নারী সমাজ ঝুঁকে পড়ে। এর পরের জামদানি শিল্পের ইতিহাস ভাঙাগড়ার মধ্য দিয়ে এগিয়ে চলে। ১৯৭১-এ বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধুর সরকার অন্যান্য শিল্প মাধ্যমের পাশাপাশি জামদানি শিল্পের ঐতিহ্যকে পুনরুজ্জীবিত করার তাগিদে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ করলেও ক্রমশ টেক্সটাইল প্রিন্টের সুতি শাড়ির চাহিদা দিন দিন বাড়তে থাকার কারণে এক সময় জামদানি শিল্প মুখ থুবড়ে পড়ে। বঙ্গবন্ধু সরকারের পরে বিভিন্ন সরকার জামদানি শিল্পকে টিকিয়ে রাখার নানা পদক্ষেপ নিলেও দিনে দিনে জামদানি শিল্প হয়ে পড়ে ক্ষয়িষ্ণু। এ শিল্পের সঙ্গে পারিবারিকভাবে যুক্ত সদস্যরা জীবিকার প্রয়োজনে একসময় বাধ্য হয়ে ভিন্ন পেশায় সম্পৃক্ত হয়ে পড়ে। ফলে জামদানি শাড়ির সূতিকাগার হিসেবে পরিচতি সিদ্ধিরগঞ্জের শত শত তাঁত শিল্পী অন্য পেশায় জড়িয়ে পড়ে। পাশাপাশি রূপগঞ্জ, সোনারগাঁয়ের তাঁত শিল্পেও নামে গভীর অমানিশা। এই অবস্থার প্রেক্ষিতে ফ্যাশন ট্রেডে একটা ইতিবাচক সুবাতাস বইতে থাকে গত তিন দশক ধরে। বিশেষ করে নগর জীবনে দেশীয় পোশাকের এক বিশাল বাজার সৃষ্টি হয়। এই বাজারের হাত ধরেই জামদানি শিল্পেও এর ইতিবাচক ছাপ বিশেষ ভাবে লক্ষ্য করা যায়। যারা এক সময় জামদানি শিল্প থেকে নিজেদের গুটিয়ে নিয়েছিলেন, তাদের অনেকেই পারিবারিক ঐতিহ্য বহনকারী জামদানি শিল্পে পুনরায় নিজেদের সংযুক্ত করেন। মো. আলী আকবর এক স্বপ্নবাদী জামদানি শিল্পী এদেরই একজন হলেন সিদ্ধিরগঞ্জ গ্রামের মুন্সীপাড়া নারায়ণগঞ্জ সাইলো গেটের আরিফ জামদানি শাড়ি প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার মো. আলী আকবর। মো. আলী আকবর উত্তরাধিকার সূত্রেই জামদানি শিল্পের সঙ্গে ছোটবেলাতেই যুক্ত হয়েছিলেন। কিন্তু এই শিল্পে ভাটার টান লাগার তার ফ্যাক্টরির তাঁতকল এবং কারিগররা হয়ে পড়ে নির্জীব আর বেকার। তারপরেও এই শিল্পকে ভালবেসে আলী আকবর মাটি কামড়ে পড়ে থাকেন জামদানি শিল্পের সুদিনের অপেক্ষায়। এবং সাম্প্রতিক কালে জামদানির বাজার অনেকটা জমজমাট হওয়ায় মো. আলী আকবরের প্রতীক্ষার সুদিন ফিরে আসায় তিনি যেমন খুশি, তেমনি তার ব্যবসায়িক পরিধি বেড়ে যাওয়ায় এবং ব্যবসার উন্নতি ও জামদানি শিল্প সগৌরবে ঘুরে দাঁড়ানোর গল্পটা মো. আলী আকবরকে পৌঁছে দিয়েছেন। এক সাফল্যের সিঁড়িতে। যে সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে তিনি তার প্রতিষ্ঠানে হাতে বুননকৃত তাঁতের জামদানি শাড়ি বাংলাদেশের বিভিন্ন আউটলেটে বিপণনের পাশাপাশি এলিট শ্রেণীর অনেকেই তার কাছ থেকে নান্দনিক ডিজাইনকৃত শাড়ি অর্ডারের মাধ্যমে তৈরি করিয়ে নেয়। পশ্চিম বাংলার জামদানি শাড়ি প্রিয় রমণীর কাছেও আলী আকবরের জামদানি শাড়ি বিশেষ পছন্দের। জামদানি শিল্প ঘুরে দাঁড়ানোর গল্পটা আলী আকবর কিভাবে উপলদ্ধি করেন, সে কথাই তিনি বলেছেন প্রসন্ন মনে। হস্তচালিত তাঁতের বোনা জামদানি শাড়ির ব্যবসাটা আমাদের পারিবারিক ব্যবসা। পেশাদার হিসেইে এই শিল্পে জড়িত ছিলেন আমার পূর্বপুরুষরা। সেই থেকে আমার দাদার বাবা, আমার দাদা, আমার বাবা, বড় ভাইয়েরা। সেই ধারাতে আমিও এই শিল্পকেই বছরের পর বছর ধরে আকড়ে ছিলাম। সে এক দুঃসহ স্মৃতি। একটা শাড়ির বুনন খরচও কোন কোন সময় ফিরে পেতাম না। চাহিদা ছিল কম। দাম বেশি হওয়ায় জামদানি শাড়ি পরাটাই যেন বাঙালী মহিলারা ভুলতে বসেছিলেন। কিন্তু তারপরেও আমি আশায় বুক বেঁধে অপেক্ষা করেছি আজকের দিনটির জন্য। হ্যাঁ, বর্তমানে আগের মতো ব্যাপক ভিত্তিতে না হলেও হস্তচালিত তাঁতে বোনা জামদানি শাড়ির কদর তৈরি হয়েছে। নতুন প্রজন্মের বাঙালী নারীরা আবার তাদের দেশীয় ঐতিহ্যকে বরণ করে নিয়েছেন। এতে করেই নতুন উদ্যমে জামদানি শিল্পে ফিরে এসেছে হারানো ঐতিহ্য। এবং আমরাও মন-প্রাণ উজাড় করে জামদানি শাড়ির গুণগত মান, আধুনিক ডিজাইন, ফ্যাশনেবল মোটিফে নতুন আঙ্গিকে রুচিসম্মত জামদানি শাড়ি বুনন করছি। ফলে ধীরে ধীরে আমাদের এলাকায় জামদানি শিল্প-পেশায় অনেকেই ফিরে আসতে শুরু করেছেন। পাশাপাশি সরকারের নানা পদক্ষেপও আমাদের শিল্পকে টিকে থাকার ক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা পালন করছে। সবশেষে মো. আলী আকবর বলেন, আমাদের সব থেকে বড় গৌরবের ছবিটা হলেন আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা, যাঁর পছন্দের শীর্ষে রয়েছে জামদানি শাড়ি। এই গৌরবের ছবিটাই আমাদের এই শিল্পকে কত যে অনুপ্রাণিত করে, তা বলে শেষ করা যাবে না।
×