ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

শোকাবহ ক্রিকেট অঙ্গন, অভিভাবকহীন ভারত

প্রকাশিত: ০৫:৫৩, ২২ সেপ্টেম্বর ২০১৫

শোকাবহ ক্রিকেট অঙ্গন, অভিভাবকহীন ভারত

স্পোর্টস রিপোর্টার ॥ জগমোহন ডালমিয়া (জন্ম ৩০ মে ১৯৪০ কলকাতা, মৃত্যু ২০ সেপ্টেম্বর ২০১৫)- কলকাতার কেওড়াতলার মহাশ্মশানের নামফলকে এটাই লেখা থাকবে, হয়ত বা যোগ হবে আরও দুটি ‘শব্দ’ সাবেক আইসিসি ও বিসিসিআই প্রধান। তাতে কি ডালমিয়ার পরিচয় ফুটে উঠবে? আন্তর্জাতিক ক্রিকেটার না হয়েও তিনি যে বিশ্ব ক্রিকেটের জ্বলজ্বলে এক অধ্যায়। যে অধ্যায়ে ছিল না যৌক্তিক বিতর্কের এতটুকু কালিমা, কেবলই সাফল্য-বন্ধুত্ব আর ভ্রাতৃত্বের নিদর্শন। ভারত তো বটেই, বিশ্ব ক্রীড়াঙ্গনও যুগে যুগে এমন ক্রীড়াব্যক্তিত্ব খুব কমই পেয়েছে। ডালমিয়ার মৃত্যু তাই ছুঁয়ে গেছে বিশ্বকে। আন্তর্জাতিক পরিম-লে তুলে আনার বিচারে তিনি ছিলেন বাংলাদেশের ক্রিকেটের একজন অগ্রপথিক, ভক্ত বললেও বাড়িয়ে বলা হবে না। যার আন্তরিক প্রচেষ্টায় দুর্বল অবকাঠামো নিয়েও টেস্ট স্ট্যাটাস পেয়েছিল বাংলাদেশ। শোক জানাতে গিয়ে তাই আবেগে আপ্লুত হয়েছেন বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের সাবেক বস সাবের হোসেন চৌধুরী, বর্তমান সভাপতি নাজমুল হাসান পাপন, যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী শ্রী বীরেন শিকদার, আইসিসির সাবেক সভাপতি ও বর্তমান পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। ‘বাংলাদেশের ক্রিকেটে ডালমিয়ার অবদান বলে বোঝানো যাবে না। টেস্ট স্ট্যাটাস প্রাপ্তিতে সে সময় আইসিসির প্রেসিডেন্ট হিসেবে প্রত্যক্ষ অবদান তার। তিনি সব সময় বিশ্বাস করতেন, বাংলাদেশের ক্রিকেট একদিন ঠিকই বিশ্ব কাঁপিয়ে দেবে। এক অর্থে, তিনি ছিলেন আমাদের অকৃত্রিম বন্ধু। তার স্মরণে বোর্ডের পক্ষ থেকে অনুষ্ঠানের আয়োজন করা উচিত।’ বলেন সাবের হোসেন চৌধুরী। শোক প্রকাশ করেছেন এক সময়ের কিংবদন্তি ফুটবলার ও বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের বর্তমান সভাপতি কাজী সালাউদ্দিন, শোকসন্তপ্ত বিওএর মহাসচিব সৈয়দ শাহেদ রেজাসহ অনেকে। বলতে গেলে বাংলাদেশই আজ শোকাতুর। স্মৃতিতে-শোকে বিহ্বল ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনোমোহন সিং থেকে শুরু করে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জী, গ্রেট শচীন টেন্ডুলকর থেকে কলকাতার রাস্তার সাধারণ চা বিক্রেতাও। শেষ হয়ে গেল একটি অধ্যায়। রবিবার বাংলাদেশ সময় রাত ১০টায় কলকাতার একটি বেসরকারী হাসপাতালে প্রয়াত হন ৭৫ বছর ১১৩ দিন বয়সী ডালমিয়া। বৃহস্পতিবার রাতেই হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন তিনি। মাঝে শারীরিক অবস্থার কিছুটা উন্নতি হলেও শেষ পর্যন্ত জীবনের লড়াইয়ে হার মানতে হয় ভারতীয় ক্রিকেটের এই অজেয় সংগঠককে। হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ অনিল মিশ্রর নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের মেডিক্যাল বোর্ড গঠন করা হয়েছিল। তাদের সুপারিশে প্রথমে এনজিওগ্রাম, পরে এনজিওগ্রাফি করা হয়। বাঁচিয়ে রাখার শেষ চেষ্টা হিসেবে যকৃতে দুটি অস্ত্রোপচার। ডাক্তার জানিয়েছিলেন গত কয়েকদিন ধরেই বেশ দুর্বল হয়ে পড়েছিলেন ডালমিয়া। ভুগছিলেন হাইপার টেনশনে। মাঝে-মাঝে শ্বাসকষ্টও হচ্ছিল। ডাক্তার-স্টাফদের সব প্রচেষ্ট ব্যর্থ করে না ফেরার দেশে চলে যান ‘মাস্টার অব রিয়ের পলিটিক’ ও ‘মাস্টার অব কামব্যাকস খ্যাত’ ভারতীয় ক্রিকেটের তুখোড় এই সংগঠক। খবর পেয়ে রাতেই হাসপাতালে ছুটে যান মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানর্জী। ক্রিকেট কলকাতার কোষাধ্যক্ষ বিশ্বরুপ দে, যুগ্মসচিব সুবীর গঙ্গোপধ্যায়সহ অনেকে। ‘আমরা সবাই মর্মাহত। ডালমিয়া ক্রিকেটকে নিজের জীবনের চেয়েও বেশি ভালবাসতেন। শুনেছিলাম একটু ভাল আছেন। কিন্তু রাজার মতো রাজমুকুট মাথায় নিয়ে চলে গেলেন। আমরা সবাই মিলে ওনার বাকি কাজগুলো শেষ করার চেষ্টা করব।’ বলেন মমতা। মুখ্যমন্ত্রী নিজে ডালমিয়ার পরিবারের সঙ্গে কথা বলে সিদ্ধান্ত নেন, (সোমবার) দুপুর ১২টা থেকে ৩টা পর্যন্ত মৃতদেহ সিএবি-তে রাখা হবে। এরপর কেওড়াতলা মহাশ্মশানে হবে শেষকৃত্য। ভারতীয় গ্রেট শচীন টেন্ডুলকর ডালমিয়াকে স্মরণ করে বলেন, ‘জুনেই দেখা হয়েছিল। ভাবতেই পারছি না ওটাই শেষ দেখা হবে। প্রশাসক হিসেবে ছিলেন অসাধারণ, ক্রিকেটের উন্নয়নের জন্য শেষ বিন্দু দিয়ে চেষ্টা করে গেছেন।’ আরেক সাবেক বিষেন সিং বেদী বলেন, ‘ভারতীয় ইতিহাসের সেরা প্রশাসক ছিলেন, ক্রিকেটের প্রতি তার ভালবাসার তুলানা হয় না।’ ভিভিএস লক্ষণের মতে, ভারতীয় ক্রিকেট, এমন কি বিশ্ব ক্রিকেটকেই নতুন পথ দেখিয়েছেন ডালমিয়া। বলিউড বাদশাহ শাহুরুখ খান বলেন, ‘খবরটা শোনার পর খুবই খারাপ লাগছে। তাকে খুব মিস করব। এটা বিশ্ব ক্রিকেটের জন্য বড় ধাক্কা।’ অসাধারণ ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন ডালমিয়ার জন্ম কলকাতার এক মারোয়ারি পরিবারে। উইকেটরক্ষক-ব্যাটসম্যান হিসেবে ক্লাব ক্রিকেটে খেলেছেন স্থানীয় স্কটিশ চার্চ কলেজের হয়ে। রয়েছে ডাবল সেঞ্চুরি। ষাটের দশকে খেলা ছেড়ে পারিবারিক ব্যবসায় যোগ দেন। অতঃপর এক দশকের মধ্যে ক্রিকেটে প্রশাসক হিসেবে হাতেখড়ি। ১৯৭৯ সালে ভারতীয় বোর্ডে যোগ দেন। ১৯৮৩ সালে হন কোষাধ্যক্ষ। ডালমিয়ার চেষ্টাতেই ১৯৮৭ ও ১৯৯৬ সালে উপমহেমেশে অনুষ্ঠিত হয় বিশ্বকাপ ক্রিকেট। ১৯৯৬-এ ব্যর্থ হলেও ১৯৯৭ সালে সর্বসম্মতিক্রমে বিশ্বক্রিকেটের নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইসিসির প্রেসিডেন্ট হন ডালমিয়া। ২০০৪-০৭ পর্যন্ত একাধিক রাজনীতির মারপ্যাঁচে পড়লেও ২০০৮-এ ফের সিএবির প্রেসিডেন্ট দুর্দান্ত প্রত্যাবর্তন। ২০১৩ সালে আইপিএলে স্পটফিক্সিংয়ের দায়ে এন শ্রীনিবাসন সরে দাঁড়ালে পুনরায় বোর্ডের (বিসিসিআই) অন্তর্বর্তী প্রধানের দায়িত্ব পান। এ বছরই (২০১৫) প্রেসিডেন্ট পদে পুনর্নির্বাচিত হন। যে সূত্রে বিসিসিআইয়ে উপদেষ্টা হিসেবে জায়াগা হয় কলকাতার আরেক কৃতীসন্তান সৌরভ গাঙ্গুলীর। ডালমিয়ার মৃত্যুতে বিসিসিআইয়ের সব সভা আপাতত স্থগিত করা হয়েছে। বিসিসিআইয়ের নিয়ম অনুযায়ী বোর্ডসচিব অনুরাগ ঠাকুরই অন্তর্বর্তী প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন এবং আগামী পনেরো দিনের মধ্যে সভা ডেকে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেবেন।
×