ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

আজ পবিত্র হজ

লাব্বায়েক ধ্বনিতে মুখরিত হবে আরাফাত

প্রকাশিত: ০৫:৪৪, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০১৫

লাব্বায়েক ধ্বনিতে মুখরিত হবে আরাফাত

বাবুল হোসেন, মিনা থেকে ॥ আজ বুধবার পবিত্র হজ। আরবী মাস ৯ জিলহজকে বলা হয় আরাফা দিবস। আজ বাদ ফজর লাখ লাখ হজযাত্রী মিনা থেকে আরাফাতের ময়দানে হাজির হবেন। মিনায় ফজরের নামাজ আদায় করেই “লাব্বায়েক আল্লাহুম্মা লাব্বায়েক-লাব্বায়েক লা শারীকা লাকা লাব্বায়েক, ইন্নাল হামদা, ওয়ান্নিমাতা লাকা ওয়াল মুলক লা শারিকা লাক” ধ্বনিতে হজযাত্রীরা আরাফাতের ময়দানে গিয়ে নিজ নিজ খিমায় আশ্রয় নেবেন। এখানেই দিনভর এবাদত বন্দেগীতে মশগুল থাকবেন তাঁরা। আল্লাহর অশেষ রহমতের ময়দান আরাফাতে সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত অবস্থান করার নামই হজ। এখানেই মসজিদে নামিরাহর ইমামের পেছনে এক আজানে একই সঙ্গে জোহর ও আছরের নামাজ আদায় করতে হয়। সূর্যাস্তরের পর মাগরিবের নামাজ না পড়েই মুজদালিফার উদ্দেশে রওনা দিতে হয়। মূলত ৯ জিলহজ অন্য আনুষঙ্গিক কাজ করার মাধ্যমে হজের পরিপূর্ণতা দেয়া হয়। মঙ্গলবারও মিনার মাঠে দিনভর এবাদত বন্দেগীতে মশগুল ছিলেন সব হজযাত্রী। এ সম্পর্কে মিনার মাঠ থেকে হজ পরিদফতরের পরিচালক ডক্টর আবু সালেহ মোস্তফা কামাল জনকণ্ঠকে বলেন, এবার কঠোর নিরাপত্তা বেষ্টনীর মধ্যে হজ পালনের সুব্যবস্থা নিশ্চিত করা হয়েছে। বাদ ফজর হজযাত্রীরা আরাফাতের ময়দানে গিয়ে সমবেত হবেন। তাদের বহন করার জন্য রয়েছে বিশেষ ট্রেন সার্ভিস। রয়েছে বাসেরও ব্যবস্থা। মিনা থেকে আরাফাতের দূরত্ব বেশি না হওয়ায় অনেকে হেঁটেও রওনা হবেন। তবে বাংলাদেশী হজযাত্রীদের বিভিন্ন ভাগে বিভক্ত করে দেয়া হয়েছে। কিছু হজযাত্রী ভিড় এড়াতে মসজিদে নামিরাহর কাছে অবস্থান করার জন্য ফজরের নামাজের আগেই রাত তিনটার দিকে মিনার মাঠ থেকে আরাফাতের উদ্দেশে রওনা হতে পারেন। জানা যায়, আরাফাতের সার্বিক প্রস্তুতি ইতোমধ্যে সম্পন্ন করেছে সৌদি কর্তৃপক্ষ। হজে আসা মুসল্লিদের নিরাপত্তায় সৌদি আরবে নিয়মিত বাহিনীর পাশাপাশি প্রায় এক লাখ সেনা মোতায়েন করা হয়েছে। দেশটির স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বরাত দিয়ে আরব নিউজের এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়েছে। মেজর জেনারেল মনসুর আল-তুর্কি আরব নিউজকে বলেন, হজের জন্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বিপুলসংখ্যক মানুষ সৌদি আরবে অবস্থান করেন। চলতি বছর হজ করতে সারাবিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ২৫ লাখের বেশি ধর্মপ্রাণ মুসলমান সৌদি আরবে এসেছেন। তাদের নিরাপত্তায় সন্ত্রাসবিরোধী বিশেষ ইউনিট, ট্রাফিক পুলিশ এবং জরুরী সিভিল ডিফেন্স কর্মকর্তারা দায়িত্ব পালন করছেন। নিরাপত্তাবাহিনীর এসব সদস্যের পাশাপাশি সেনাবাহিনী এবং ন্যাশনাল গার্ডের অতিরিক্ত এক লাখ সদস্য হাজিদের নিরাপত্তায় দায়িত্ব পালন করছেন। আরব নিউজের প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, সৌদি আরবে সম্প্রতি দায়েশ গ্রুপের (একটি জঙ্গী সংগঠন) হামলার মাত্রা অনেক বেড়েছে। তাদের আক্রমণে চলতি বছর কয়েকজন হজযাত্রীর মৃত্যুও হয়েছে। এবারের হজের আগে মক্কায় মসজিদুল হারামে নির্মাণ কাজে ব্যবহৃত ক্রেন ভেঙে শতাধিক লোক নিহত হয়েছেন। এরপর থেকে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করেছে সৌদি কর্তৃপক্ষ। মসজিদে হারামসহ হাজিদের গমনাগমন স্থানসমূহে বিশেষ নিরাপত্তা দেয়া হচ্ছে এবং কেন্দ্রীয়ভাবে তা মনিটরিং করছে সৌদি রাজ পরিবার। আরাফাতের অবস্থান সম্পর্কে হাদিস শরীফে বলা আছেÑ হজের মোট ফরজ কাজ হচ্ছে ৩টি। ইহরাম বাঁধা, ৯ জিলহজ নির্দিষ্ট সময়ে উকুফে আরাফায় অবস্থান করা ও কাবাঘরে তাওয়াফ করা। মঙ্গলবার মিনায় ছিল ২৫ লক্ষাধিক হজযাত্রীর মিলনমেলা। এ বছর সারাবিশ্ব থেকে ২৫ লাখ হজযাত্রী এবং সৌদি আরবের নিজস্ব আরও প্রায় ৩ লাখ হজযাত্রী হজ আদায় করবেন। তারা সবাই মিনার মাঠে মঙ্গলবার এবাদত বন্দেগীতে ব্যস্ত ছিলেন। লাখ লাখ হজযাত্রী সাদা তাঁবুতে সবাই পাশাপাশি অবস্থান করেন। অগ্নি দুর্ঘটনা এড়াতে এ বছরও মিনার মাঠে রান্না করে খাবার তৈরির কোন ব্যবস্থা নেই। এ সব হজযাত্রীর সব খাবারই আসছে বাইরে থেকে। ইসলামী শরীয়াহ মোতাবেক হজের প্রধান রুকন উকুফে আরাফায় অবস্থান করাটা ফরজ। তাই আজ মিনার মাঠে ফজরের নামাজের পর পরই হজযাত্রীরা আল্লাহর নৈকট্য লাভ ও তামাম জিন্দেগীর গুনাহ মাফ করার একান্ত বাসনা নিয়ে রওনা দেবেন আরাফাত অভিমুখে। এখানে জোহরের ওয়াক্ত থেকে শুরু হবে উকুফের সময়। এদিন জোহরের ওয়াক্ত থেকে সূর্যাস্তের পূর্ব পর্যন্ত সময়ের মধ্যে যে ব্যক্তি আরাফায় উপস্থিত হবেন তার জন্য সূর্যাস্ত পর্যন্ত উকুফ করা ওয়াজিব। কেউ সূর্যাস্তের পূর্বে পৌঁছতে না পারলে আগত রাতের সুবেহ সাদিক পর্যন্ত সময়ের মধ্যে জ্ঞাত ও অজ্ঞাতসারে কিছুক্ষণ অবস্থান করলেও উকুফের ফরজ আদায় হয়ে যাবে। হাদিস মোতাবেক আরাফায় পৌঁছে উকুফের আগে গোসল করা সুন্নত। অনেকে গোসল না করে শুধু অজু করেই সামান্য খাবার খেয়ে নামাজের প্রস্তুতি নিয়ে থাকেন। আরাফাতের মাঠে আজকের করণীয় হচ্ছেÑ আরাফার কেন্দ্রবিন্দু মসজিদে নামিরার জামায়াতে অংশগ্রহণ করা। ইমামের পেছনে এক সঙ্গে একই আজানে জোহর ও আছর আদায় করতে হয়। কিন্তু মসজিদে নামিরায় জায়গা সঙ্কুলান না হওয়ায় নিজ নিজ খিমায় বা তাঁবুতে জোহর ও আছর আলাদা পড়ার নিয়ম। তবে এ নিয়ে মতবিরোধও রয়েছে। নিজের তাঁবুতে যদি কেউ মসজিদে নামিরার জামায়াতের সঙ্গে তাল মিলিয়ে জোহর ও আছর একত্রে পড়তে চান, সেটাও সহীহ্ হয়ে যায়। এ নিয়ে বিবাদে না জড়ানোই শ্রেয় বলে মনে করেন মসজিদে নামিরার খতিব। কোরআন ও সুন্নাহ অনুযায়ী উকুফে আরাফায় অন্যতম করণীয় হচ্ছে দোয়া-মোনাজাত করা। এখানে দোয়া কবুল হওয়ার ওয়াদা রয়েছে। তাই পূর্ণ একীনের সঙ্গে দোয়া করতে হয়। উত্তম হচ্ছে কিবলামুখী হয়ে দাঁড়িয়ে একেবারে সূর্যাস্ত পর্যন্ত দোয়া করা। এত দীর্ঘ সময় দাঁড়ানো কঠিন হওয়ায় প্রয়োজনে বসে বিশ্রাম নিয়ে আবার দাঁড়িয়ে দোয়া শুরু করা যেতে পারে। হাদিস শরীফে রয়েছে আরাফাতের ময়দানে সূর্যাস্ত পর্যন্ত থাকার পর একজন হজযাত্রীর আসল হজ হয়ে যায়। সূর্যাস্তের পর সবাই হাজী হিসেবে গণ্য হবেন। আরাফাত ময়দান থেকে সূর্যাস্তের পর মাগরিবের নামাজ না পড়েই মুজদালিফার দিকে সব হাজী রওনা হবেন। মুজদালিফার আমল ॥ আরাফাত থেকে এসে ৯ জিলহজ দিবাগত রাতে মুজদালিফায় অবস্থান করা সুন্নতে মুআককাদা। এদিন মাগরিব ও এশার নামাজ এক আজান ও এক ইকামতে মুজদালিফায় একত্রে পড়তে হবে। তবে অতিশয় বৃদ্ধ, নিতান্ত দুর্বল কিংবা অধিক পীড়িত রোগীর জন্য মুজদালিফায় অবস্থান না করে আরাফাত থেকে সোজা মিনায় চলে যাওয়ার অনুমতি আছে। এ রাতে ঘুমানো ও আরাম করাই প্রধান আমল। কেননা মুসলিম শরীফের এক হাদিসে আছে, রাসূল (স) এ রাতে এশা পড়ে শুয়ে গেছেন। যেন সুবেহ সাদিকের পর উকুফের সময় দোয়া ও জিকিরে মশগুল থাকা যায়। তবে বর্তমানে দেখা যায়, মুজদালিফায় হাজীরা সারা রাতই বিছানায় সজাগ অবস্থায় শুয়ে থাকেন। এ ছাড়া এখান থেকেই সংগ্রহ করতে হয় কঙ্কর। এসব কঙ্কর মারতে হবে মিনার মাঠের জামারায়। মুজদালিফায় ফজর নামাজ শেষে আগামীকাল শনিবার দশই জিলহজ সব হাজী একত্রে রওনা দেবেন ফের মিনার মাঠে। এ দিন শুধু বড় শয়তানের ওপর কঙ্কর মারতে হয়। হজের ইহরাম বাঁধার পর থেকেই এ পর্যন্ত সবচেয়ে উত্তম জিকির তালবিয়া পড়া এখানেই শেষ করতে হয়। কঙ্কর বা পাথর মারার নিয়ম হচ্ছে ১০ জিলহজ সূর্যোদয়ের পর থেকে সূর্য ঢলে পড়া পর্যন্ত অর্থাৎ জোহরের সময়ের পূর্ব পর্যন্ত সময়ের মধ্যে পাথর মারা উত্তম। তবে অসুস্থ ব্যক্তিরা সূর্যাস্ত পর্যন্ত পাথর মারতে পারেন। তাও সম্ভব না হলে অন্য কেউ বদলি পাথর মারাও জায়েজ আছে। পাথর মারার পর তামাত্তু ও কিরান হাজীদের জন্য কোরবানি দেয়া ওয়াজিব। মিনার মাঠেই কোরবানির সুবন্দোবস্ত রয়েছে। অবশ্য বাংলাদেশের হাজীরা সরকারী ও ব্যক্তিগতভাবে কোরবানি দিতে পারেন। কোরবানির পরই হাজীরা মাথা মু-ন করে হালাল হয়ে যান। এরপর আবার তারা যাবেন মক্কা শরীফে। পবিত্র কাবাঘর তাওয়াফ করা ফরজ। তার পরের কাজটি সাফা মারওয়া সাতবার সায়ী করা ওয়াজিব। রাতে আবার হাজীরা ফিরে এসে মীনার মাঠে পর পর আরও ৩ দিন অবস্থান করে শয়তানকে পাথর মারার মধ্য দিয়ে শেষ করবেন ইসলামের পঞ্চম স্তম্ভ হজ। মিনার মাঠ থেকে হজ টিমের একজন কর্মকর্তা জনকণ্ঠকে জানান, বাংলাদেশের সব হজযাত্রীই ভাল আছেন। এ পর্যন্ত ৪৩ জন হজযাত্রীর স্বাভাবিক মৃত্যু ঘটেছে। এ ছাড়া কোন সঙ্কট বা সমস্যা নেই। এবার ২৫ লাখের বেশি হজযাত্রী আরাফাতে জমায়েত হচ্ছেন। তাদের মধ্যে সাড়ে ৩ লাখ সৌদি আরবের বাসিন্দা। বাকিরা বহির্বিশ্বের। এবারও মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ সংখ্যক হজযাত্রী এসেছেন ইন্দোনেশিয়া থেকে। তার পরের সংখ্যাটি বাংলাদেশের প্রায় ১ লাখ ৬ হাজার ২৭০ জন। এবার হজ পালনরত দৈনিক জনকণ্ঠ সাংবাদিক মশিউর রহমান খান জানান, নজিরবিহীন নিরাপত্তার মাঝে এবার হজ ব্যবস্থাপনা সাজানো হয়েছে। সুষ্ঠুভাবে হজ পালনের সুবিধার্থে সৌদি সরকার এক লাখ নিরাপত্তা কর্মী নিয়োগ দিয়েছে। এ ছাড়া আরও অতিরিক্ত স্পেশাল ফোর্স নিয়োগ দেয়া হয়েছে। এরা হাজীদের নামাজ আদায় ও পথঘাট দেখা-শোনার দায়িত্ব পালন করবেন। এবার হজ মনিটরিংয়ে অত্যন্ত উচ্চ প্রযুক্তির ক্যামেরা ব্যবহার করা হচ্ছে। হাজীদের নিরাপত্তায় বসানো হয়েছে প্রায় পাঁচ হাজার ক্যামেরা। হেলিকপ্টার ও উড়োজাহাজে চড়েও নিরাপত্তা রক্ষীরা সার্বিক নিরাপত্তা মনিটর করছে। এবার হজের খুতবা কে পড়াবেন তা এখনও জানা যায়নি। গতবার খুতবা পাঠ করেছিলেন সৌদি আরবের গ্র্যান্ড মুফতি দৃষ্টি শক্তিহীন আব্দুল আজিজ আল শাইখ। এ বিষয়ে বাংলাদেশ হজ মিশনে ফোন করেও খুতবা পাঠকারী মুফতির নাম জানা যায়নি। এ বিষয়ে মক্কার বাংলাদেশ হজ মিশনের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা জানান, আরাফার ময়দানে কে খুতবা পাঠ করবেন তা আগে থেকে প্রকাশ করা হয় না। হজের দিন ফজরের নামাজের পর আনষ্ঠানিকভাবে নাম প্রকাশ করা হয়।
×