ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

চলছে কোরবানির প্রস্তুতি

সাধুর হাতেও ছুরি চাকু, জরুরী কেনাকাটা

প্রকাশিত: ০৫:৪৬, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০১৫

সাধুর হাতেও ছুরি চাকু, জরুরী কেনাকাটা

জনকণ্ঠ ফিচার ভয়ঙ্কর সব ছুরি চাকু! দেখে সত্যি পিলে চমকে যায়। এমন দেশীয় অস্ত্রের আশপাশ দিয়ে কোন ভদ্রলোকের যাওয়ার কথা নয়। সারা বছর কেউ সেদিকে যানও না। কিন্তু এখন ব্যাপার আলাদা। ধারালো ছুরির ধারে দিব্যি আঙ্গুল ঘষে নিচ্ছেন নিরীহ দেখতে লোকটি। একরকম পরখ করেই কিনছেন ছোট ছুরি, বড় ছুরি। এমনকি চায়নিজ কুড়াল! হ্যাঁ, কোরবানির ঈদ যে! একেবারে দোরগোড়ায়। বরাবরের মতোই মুখ্য বিবেচনা হয়ে ওঠেছে গরু ছাগল। সামর্থ্য অনুযায়ী কেনাকাটা। তার পর কোরবানি। প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন করতে এসব উপকরণ খুবই জরুরী। পশু জবাই ও মাংস কাটার কাজটি সহজ করতে এসবের কোন বিকল্প নেই। কোরবানির পশু কেনার পাশাপাশি তাই চলছে ছুরি চাকু কেনার কাজ। চাহিদার কথা মাথায় রেখে প্রস্তুত দোকানিরাও। এ ধরনের উপকরণের বড়সরো সংগ্রহ রাজধানীর কাওরান বাজারে। এখানে গত ত্রিশ বছর ধরে দা বটি ছুরি চাকু তৈরি ও বিক্রি হচ্ছে। ৩০টির মতো দোকান। বড় ও ভারি ভারি ছুরি বিশেষ কায়দায় ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। মঙ্গলবার সেখানে গিয়ে দেখা যায়, সবক’টি দোকান পাশাপাশি। সামনের অংশটুকু প্রায় একই রকম দেখতে। সেখানে ছুরি আর ছুরি! হঠাৎ দেখলে হাত পা কেমন ঠান্ডা হয়ে আসে। কোরবানির এসব উপকরণের কিছু শূন্যে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। কিছু নিচে সাজিয়ে রাখা হয়েছে। সবচেয়ে বড় ছুরিটির নাম ‘জবাই ছুরি’। পশু জবাই করার জন্য বিশেষ উপযোগী করে বানানো। তাই জবাই ছুরি নাম। ১৮ থেকে ২২ ইঞ্চির মতো লম্বা। সামনের অংশ হাতীর শূরের মতো বাঁকানো। কিছুটা উপরের দিকে ওঠে গেছে। শক্ত হাতে ধরতে হয়। তাই কাঠের হাতল। দোকানিরা জানান, এই ছুরির দাম ৪০০ থেকে ১২০০ টাকার মধ্যে। মান অনুযায়ী এ দাম ওঠানামা করে। পশু জবাইয়ের পরের কাজটি চামড়া ছাড়ানো। একটু সতর্কতার সঙ্গে করা চাই। এ জন্য ছোট এক ধরনের ছুরি পাওয়া যাচ্ছে। রোস্তম আলী নামের এক দোকানী জানালেন, এই ছুরির নাম ‘ছিলা ছুরি’। পরিমাণে বেশি বলেই মনে হলো। কেন? জানতে চাইলে তিনি জানান, চামড়া ছাড়ানোর কাজটি একসঙ্গে চারজন বা ততোধিক ব্যক্তি করতে পারেন। এ জন্য ‘ছিলা ছুরি’ কয়েকটা কিনতে হয়। দাম প্রতিটি ৫০ থেকে ৮০ টাকা। কোনটির কাঠের হাতল। সে ক্ষেত্রে দাম ২২০ টাকা। মাঝারি সাইজের ছুরিটির নাম আবার ‘সাইজ ছুরি।’ দোকানীদের ভাষায়Ñ এ ছুরি দিয়ে মাংস ‘সাইজ’ করা হয়। কুপিয়ে ‘সাইজ’ করার ব্যাপার আছে। একে তাই কোপ ছুরিও বলা হয়। কোন কোন দোকানী আবার বললেন, কামেলা ছুরি। এই ছুরির দাম ১০০ থেকে ৪০০ টাকা। এর পর চাপাতি। হ্যাঁ, সাম্প্রতিক সময়ের বাংলাদেশে এটি বিশেষ আলোচিত। উগ্র মৌলবাদীরা মানুষ হত্যার কাজে এই অস্ত্র ব্যবহার করছে। এমনকি কাওরান বাজারে কোরবানির ছুরি চাকু কিনতে আসা তিনজন মাদ্রাসা ছাত্রকে চাপাতি হাতে নিয়ে মস্করা করতে দেখা গেলো। তারা এ দিয়ে মানুষ মারবে বলে মজা করছিল। সে যাই হোক, আদতে এই অস্ত্রটি গরুর হাঁড় কেটে ছোট করার কাজে লাগে। তাই বিভিন্ন আকারের চাপাতি তৈরি করে সাজিয়ে রেখেছেন দোকানিরা। এক দোকানী একরকম জোর করে তাঁর দোকানে ঢোকালেন। দেখালেন তাঁর চাপাতির বিশেষ সংগ্রহ। একটি দেখিয়ে তিনি বললেন, এটি রেললাইনের রেল কেটে তৈরি করা হয়েছে। দেড় কেজির মতো ওজন। ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা দাম। প্রচুর ধার ওঠে। আছে গাড়ির স্প্রিংয়ে তৈরি চাপাতি। প্রায় একই কাজে ব্যবহৃত হয় চায়নিজ কুড়াল। চকচকে খুব। হাতলও কাঠের ফার্নিচারের মতো সুন্দর রং করা। দাম ৮০০ থেকে ১০০০ টাকা। কোরবানির মাংস ঘরে আনার পর দরকার হয় দা বঁটির। কাওরান বাজারের প্রতিটি দোকানের সামনের অংশে তাই দা বঁটি খুব দেখা গেলো। দায়ে ব্যবহৃত লোহার ওজন যত বেশি, দামও। ইউসুফ নামের এক দোকানী জানালেন, বিক্রি একটু কম। তবে আজ বুধবার ও কাল বৃহস্পতিবার বিক্রি কয়েকগুণ বেড়ে যাবে। প্রতিবছর তাই হয়। সেভাবেই প্রস্তুতি নিয়েছেন তারা। ক্রেতাদের পরামর্শ দিয়ে এই দোকানী বলেন, বছরে একবার ছুরি চাকু কিনতে আসা ক্রেতারা এসবের মান সামান্যই ধরতে পারেন। তাঁদের উচিত দোকানীদের কাছে ভালটা চেয়ে নেয়া। সে ক্ষেত্রে জেতার সম্ভাবনা অনেক থাকে বলে জানান তিনি। অবশ্য ছুরি চাপাতি-ই শেষ কথা নয়। কোরবানির মাংস মেঝেতে রেখে কাটার জন্য আরেকটি জরুরী উপকরণ চাই। সেটিÑ হুগলা পাতার চাটাই। কাওরান বাজারে সেটিও দেখা গেলো। সোহাগ নামের এক বিক্রেতা জানান, তাঁর চাটাই বিক্রি হচ্ছে ১৫০ টাকা করে। পাশেই ‘খাটিয়া’ বা ‘চাকতি’। তেতুল গাছের গুঁড়ি কেটে তৈরি করা হয়েছে চাকতি। শক্ত মোড়ার মতো দেখতে। এর উপর পশুর হাঁড় রেখে কুপিয়ে টুকরো টুকরো করা হয়। দেলওয়ার নামের এক দোকানী জানালেন, এগুলোর আকার অনুযায়ী দাম। তাঁর কাছে ৪০ টাকা থেকে ১২০০ টাকা পর্যন্ত দামের চাকতি আছে। গরু কেনার পর এর খাওয়ার জন্য ঘাস চাই। ছাগলের জন্য কাঁঠাল পাতা। কাওরান বাজার থেকে বেরিয়ে আসার পথে এ রকম গো-খাদ্য দেখা গেল। সাজিয়ে রাখা হয়েছে। এক মুঠো ঘাসের দাস ১০ টাকা। এক আঁটি খড় বিক্রি হচ্ছে ১৫ থেকে ২০ টাকায়। তবে ঝামেলা কম ভুসির বেলায়। দোকানীরা জানালেন, গরুর এটি প্রিয় খাবার। পানিতে গুলিয়ে সহজেই খাওয়ানো যায়। ভুসি বিক্রি হচ্ছে ৩৫ থেকে ৬০ টাকা কেজি। আছে চাল ও গমের কুড়া। সব মিলিয়ে গরুর হাটের বাইরে আরেক বিচিত্র হাট! এই হাটেও জমে উঠেছে কোনাকাটা। তবে, এতসব ব্যস্ততা হুলস্থুলের মাঝেও একবার মনে করিয়ে দেয়া জরুরী, গরু ছাগল জবাই আর ভুরিভোজই কোরবানির উদ্দেশ্য নয়। কোরবানি মানে, মনের পশুকে কোরবানি করা। ত্যাগের মহিমায় উদ্ভাসিত হওয়া। এটুকু মনে রাখা গেলেই কেবল মহিমান্বিত হবে কোরবানির ঈদ। আমরা কি তা মনে রাখবো?
×