ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

বাড়তি আদায় হতে পারে ১১ হাজার কোটি টাকা, ন্যায্য ভাড়া মানছে না কেউ

প্রকাশিত: ০৫:৪৯, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০১৫

বাড়তি আদায় হতে পারে ১১ হাজার কোটি টাকা, ন্যায্য ভাড়া মানছে না কেউ

রাজন ভট্টাচার্য ॥ এবারের ঈদে দেশের সড়ক, রেল, নৌপথের যাত্রীদের কাছ থেকে ঈদ বখশিশ বা অতিরিক্ত ভাড়ার নামে প্রায় ১১ হাজার কোটি টাকা আদায় করা হবে বলে অভিযোগ করেছে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি। এরমধ্যে সড়কপথে ছয় হাজার কোটি, নৌপথে চার হাজার কোটি ও রেলপথে প্রায় ৭শ’ কোটি টাকা। এদিকে পশুবাহী পরিবহন ও বৃষ্টির কারণে রাস্তা নষ্ট ও পরিবহন ধীরগতিতে চলছে বলে মন্তব্য করেছেন সড়ক পরিবহনমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। বৈরী আবহাওয়ার কারণে মঙ্গলবারও দুর্ভোগ মাথায় নিয়ে বাড়ি ফিরেছেন নগরীর মানুষ। ঢাকা-টাঙ্গাইল-চট্টগ্রাম-সিলেট-ময়মনসিংহসহ গুরুত্বপূর্ণ সব মহাসড়কেই কমবেশি যানজট ছিল। যানজটের কারণে সবচেয়ে বেশি দুর্ভোগের শিকার উত্তরাঞ্চলের ২৩ জেলার যাত্রীরা। ঢাকা-টাঙ্গাইলসহ বঙ্গবন্ধু সেতু মহাসড়কের প্রায় ২০ কিলোমিটার রাস্তা ভেঙ্গে খানাখন্দের সৃষ্টি হয়েছে। পশুবাহী পরিবহনের কারণে রাস্তায় ধীরগতির দাবি সড়কমন্ত্রীর ॥ পশুবাহী গাড়ির কারণে রাস্তায় যানবাহন ধীরগতিতে চলছে। এটা যানজট নয় বলে মন্তব্য করেছেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। মঙ্গলবার রাজধানীর মহাখালী বাস টার্মিনাল পরিদর্শনে এসে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে তিনি এ মন্তব্য করেন। মন্ত্রী বলেন, অনেক রাস্তা ছয়বারও মেরামত করা হয়েছে। রাস্তা ঠিক রয়েছে। রাস্তার জন্য কোথাও যানজট হচ্ছে না। পশুবাহী গাড়ির জন্য এই মুহূর্তে কিছু জায়গায় গাড়ি সেøা গতিতে যাচ্ছে। গাড়ি সেøা থাকলেও সেটা ১০ মিনিট পর থাকছে না। এটাকে যানজট বলা যাবে না। বাস্তবে কোথাও যানজট নেই। তবে দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার কারণে কিছুটা ভোগান্তি হচ্ছে। তা নিরসনেও আমরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। অভিযোগ করে ওবায়দুল কাদের বলেন, গাড়ির সেøা গতিকে মিডিয়া যানজট বলে। গাড়ির ধীরগতি কেটে গেলে সেটা কেন মিডিয়া লেখে না? মিডিয়াকর্মীদের অনুরোধ জানিয়ে তিনি বলেন, এখন খুব সেনসিটিভ টাইম। মানুষের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি হয় এমন সংবাদ প্রচার করবেন না। অতিরিক্ত ভাড়ার বিষয়ে মন্ত্রী বলেন, অতিরিক্ত ভাড়া নিচ্ছে ধরে দিন, আমি ব্যবস্থা নেব। এছাড়া বিআরটিএ, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর টিম তদারকি করছে। মন্ত্রী যে জায়গায় আসেন সেখানে তাৎক্ষণিক দুর্ভোগ থাকে না, পরে সেখানে ভোগান্তি হয়- এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, আমি চলে যাওয়ার পরও সারাক্ষণ খোঁজ নিই। কমলাপুরে সময়মতো ট্রেন ছেড়ে যাচ্ছে ॥ কমলাপুরে ঘরমুখো মানুষের চাপ বেড়েছে। মঙ্গলবার সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত বিভিন্ন গন্তব্যের ট্রেনগুলো মোটামুটি ঠিক সময়েই স্টেশন ছেড়ে গেছে বলে রেল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে। সদরঘাটে ভিড় বাড়ছে ॥ বুধবার অফিস শেষে ঈদের ছুটি শুরু। তবুও বাড়ি ফেরা থেমে নেই। একটু আগেভাগে যাওয়ার সুযোগ থাকলে কে না চায় তা কাজে লাগাতে। তাই তো মঙ্গলবার সদরঘাট নদীবন্দরে ঘরে ফেরা মানুষের ভিড় ছিল যথেষ্ট। বৈরী আবহাওয়া উপেক্ষা করে পায়ে পায়ে মানুষের ঢল নামে নদীপথে যাত্রায়। বিআইডব্লিউটিএ’র পরিবহন পরিদর্শক (টিআই) মোঃ সোলায়মান বলেন, অনেকেই আগাম ছুটি নিয়ে বাড়ির পথে রওনা হওয়ায় মঙ্গলবার সকালে ঘাটে যাত্রীর চাপ ছিল অন্য সময়ের তুলনায় অনেক বেশি। বাড়তি ভাড়া গুনতে হচ্ছে ॥ এবারের ঈদে দেশের সড়ক, রেল ও নৌপথের যাত্রীদের কাছ থেকে ঈদ বখশিশ বা অতিরিক্ত ভাড়ার নামে প্রায় ১১ হাজার কোটি টাকা আদায় করা হবে বলে অভিযোগ করেছে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি। মঙ্গলবার গণমাধ্যমে পাঠানো এক পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদনে এ দাবি করা হয়। প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রতি বছর ঈদ মৌসুমে দেশের সড়ক, রেল, নৌ ও আকাশপথের যাত্রীরা অস্বাভাবিক হারে গলাকাটা ভাড়া আদায়ের নৈরাজ্য ও যাত্রী হয়রানির শিকার হয়। নিজ নিজ মন্ত্রণালয়, দফতর, অধিদফতরসহ বিভিন্ন মহল থেকে এ অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের নৈরাজ্য ও যাত্রী হয়রানি বন্ধের কথা বলা হলেও প্রকৃতপক্ষে কার্যকর কোন পদক্ষেপ না থাকায় এ নৈরাজ্য দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। সুপ্রীমকোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের নির্দেশনা অনুযায়ী অতিরিক্ত ভাড়া আদায় বন্ধে সরকারের ওপর নির্দেশনা থাকার পরও তা কার্যকর হচ্ছে না। ওই নির্দেশনায় গাড়িতে ও বাস কাউন্টারে সরকার নির্ধারিত ভাড়ার তালিকা ঝুলিয়ে রাখার আদেশও রয়েছে সংশ্লিষ্টদের ওপর। অতিরিক্ত ভাড়া আদায়কারীদের বিরুদ্ধে কী কী ব্যবস্থা নেয়া হলো- প্রতি তিন মাস পর পর আদালতকে সে বিষয়ে একটি প্রতিবেদন দেয়ারও আদেশ রয়েছে সরকারের সংশ্লিষ্টদের প্রতি। এতকিছুর পরও অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করছে দূরপাল্লার বাস ও লঞ্চগুলো। সড়কপথে ঢাকার সায়েদাবাদ, গাবতলী, মহাখালী, বিভাগীয় শহর চট্টগ্রামের কদমতলী, বহদ্দারহাট, বিআরটিসি, অক্সিজেন ও খুলনার সোনাডাঙ্গা বাস টার্মিনাল, সিলেটের কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনাল পর্যবেক্ষণকালে পরিবহন কাউন্টারের লোকজন, যাত্রী, চালক ও সংশ্লিষ্ট পরিবহন মালিক-শ্রমিক নেতৃবৃন্দের সঙ্গে আলাপকালে জানা যায়, বছরের অন্যান্য সময়ের চেয়ে ঈদ মৌসুমে গন্তব্যভেদে ক্ষেত্রবিশেষ যাত্রীপ্রতি টিকেট ১০০ থেকে ৫০০/৮০০ টাকা পর্যন্ত বেশি ভাড়া আদায় করা হচ্ছে। এছাড়াও কোন কোন ক্ষেত্রে টিকেটের কৃত্রিম সঙ্কটের অজুহাত দেখিয়ে কৌশলে দালালদের মাধ্যমে আরও দ্বিগুণ-তিনগুণ বাড়তি টাকা আদায় করা হচ্ছে। এতে দেখা যায়, সারাদেশে প্রায় ৮০ হাজার বাস দৈনিক যাত্রীপ্রতি ৩০০ টাকা বাড়তি ভাড়া আদায় করলে দৈনিক প্রতিটি বাস গড়ে ১২ হাজার টাকা অতিরিক্ত আদায় করে। এই হিসাবে ৮০ হাজার বাস দৈনিক ৯৬ কোটি টাকা এবং ঈদের ১৫ দিনে ১ হাজার ৪শ’ ৪০ কোটি টাকা বাড়তি ভাড়া যাত্রীদের কাছ থেকে আদায় করে। এই হিসাবে ২৮ হাজার মিনিবাসে করে ৪শ’ কোটি টাকা, ৪ লাখ অটোরিক্সা ১২শ’ কোটি টাকা, ৭৫ হাজার কার ও মাইক্রোবাসে ৭শ’ কোটি টাকা, ৩ লাখ হিউম্যান হলার, নছিমন, করিমন, ভটভটিতে ১৬শ’ কোটি টাকা, ৮শ’ ট্যাক্সিক্যাবে ৬ কোটি টাকা, ১৩ লাখ ব্যাটারিচালিত রিক্সা ৯০ কোটি টাকা বাড়তি ভাড়া আদায় করে। এছাড়াও রয়েছে পিকআপ, ঘোড়ার গাড়ি, ট্রাক, মিনিট্রাকসহ অন্যান্য পণ্যবাহী পরিবহন। গণপরিবহণ সঙ্কটের সুযোগ কাজে লাগিয়ে ঈদে যাত্রী বহনে অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের নামে আরও ৬০০ কোটি টাকা লুটে নেবে। এতে দেখা যায়, এবারের ঈদে সড়কপথে প্রায় ছয় হাজার কোটি টাকার বেশি অতিরিক্ত ভাড়ার নামে লুটে নেয়া হবে, যা যাত্রীদের পকেট কাটার শামিল। সারাদেশে যানজট, সড়কের বেহাল দশা, রেলপথের সিডিউল বিপর্যয়, লাইনচ্যুতিসহ নানা কারণে যাত্রীরা নৌপথের ওপর অনেকাংশে নির্ভরশীল। নৌপথে এবারের ঈদযাত্রায় এক কোটির বেশি যাত্রী সারাদেশে যাতায়াত করবে। এরমধ্যে ৮০ শতাংশ যাত্রী অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের নৈরাজ্যের শিকার হচ্ছে। নৌপথে কেবিন, ডেক নির্বিশেষে গড়ে ৩০০ টাকা হারে দৈনিক ২৪০ কোটি টাকা এবং ঈদের ১৫ দিনে প্রায় চার হাজার কোটি টাকা অতিরিক্ত ভাড়ার নামে যাত্রীদের কাছ থেকে লুটে নেয়া হবে, যার ৪৮ শতাংশ যাত্রীকে কালোবাজারির কাছ থেকে চড়াদামে টিকেট সংগ্রহ করতে হয়েছে। রেলের কিছু চিহ্নিত অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীর যোগসাজশে টিকেট কালোবাজারি চক্রের সদস্যরা ঈদের অগ্রিম টিকেট হাতিয়ে নিয়ে মজুদ করে টিকেটপ্রতি সর্বনিম্ন ৩০০ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ১ হাজার ২০০ টাকা থেকে দেড় হাজার টাকা পর্যন্ত বাড়তি আদায় করছে। এতে যাত্রীপ্রতি গড়ে ৫০০ টাকা অতিরিক্ত ধরা হলে দৈনিক ৪০ কোটি টাকা, যা এই ঈদের ১৫ দিনে ৭শ’ কোটি টাকার বেশি টিকেট কালোবাজারিরা লুটে নেবে। চালু হলো নিয়ন্ত্রণকক্ষ ॥ পবিত্র ঈদ-উল-আযহা উপলক্ষে যাত্রীসাধারণের যাতায়াত নির্বিঘœ করার লক্ষ্যে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ একটি নিয়ন্ত্রণকক্ষ চালু করেছে। বিআরটিএ’র এলেনবাড়ির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এ নিয়ন্ত্রণকক্ষ খোলা হয়েছে। নিয়ন্ত্রণকক্ষের টেলিফোন নম্বর : ৯১৩০৬৬২ ও মোবাইল নম্বর : ০১৯৬৬৬২২০১৯। নিয়ন্ত্রণকক্ষটি মঙ্গলবার থেকে আগামী ২৮ সেপ্টেম্বর ২০১৫ তারিখ পর্যন্ত সার্বক্ষণিক খোলা থাকবে। সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের যুগ্ম-সচিব মোঃ আব্দুল মালেক (মোবা : ০১৭৩০৭৮২৯৪৬) নিয়ন্ত্রণকক্ষের তত্ত্বাবধান করছেন। বিভিন্ন মহাসড়কে যানজট ॥ নিজস্ব সংবাদদাতা রূপগঞ্জ থেকে জানান, নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলার এশিয়ান হাইওয়ে (বাইপাস) ও ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের উভয় দিকে দীর্ঘ ১২ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে দীর্ঘ যানজটের সৃষ্টি হয়েছে। মঙ্গলবার দুপুরে এ যানজটের সৃষ্টি হয়। মহাসড়ক দুটির পাশের বিভিন্ন স্থানে গরুর হাট বসানো, আইন অমান্য করে যানবাহনের চলাচল, কাঞ্চন সেতুতে ধীরগতিতে টোল আদায়, সড়কের বেহালদশাসহ বিভিন্ন কারণে এ যানজট সৃষ্টি হয়েছে বলে পরিবহন শ্রমিকদের দাবি। স্টাফ রিপোর্টার, মুন্সীগঞ্জ থেকে জানান, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের মুন্সীগঞ্জের গজারিয়া অংশে পাঁচ কিলোমিটারজুড়ে ঢাকা অভিমুখে যানজট দেখা দিয়েছে। মঙ্গলবার সকাল থেকেই এই রুটে যানযটের সৃষ্টি হয়। মুন্সীগঞ্জের গজারিয়া অংশের ভাটেরচর থেকে মেঘনা সেতু পর্যন্ত এই যানজট দেখা যায়। নিজস্ব সংবাদদাতা টাঙ্গাইল থেকে জানান, ঢাকা-টাঙ্গাইল ও বঙ্গবন্ধু সেতু মহাসড়কের প্রায় ২০ কিলোমিটার এলাকার বিভিন্ন স্থানে ভেঙ্গেচুরে খানাখন্দের সৃষ্টি হয়েছে। মহাসড়কে খানাখন্দ সৃষ্টি হওয়ায় যানবাহন চলাচলের অযোগ্য হয়ে পড়েছে। চালকরা মহাসড়কে ঝুঁকি নিয়ে ধীরগতিতে যানবাহন চালাচ্ছেন। বৃষ্টি ও যানবাহনের চাকার ঘর্ষণে মহাসড়কের অধিকাংশ স্থানেই ইট-খোয়া, বিটুমিন উঠে বড় বড় গর্তের সৃষ্টি হয়েছে। এতে করে ঈদে ঘরে ফেরা হাজার হাজার যানবাহন ও পশুবাহী ভারি ট্রাক নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সড়কে থেকে চরম বিপাকে পড়তে হচ্ছে।
×