ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

অধ্যাপক হাসান আবদুল কাইয়ূম

ঈদ-উল-আযহা বা কোরবানির ঈদ

প্রকাশিত: ০৫:০৭, ২৪ সেপ্টেম্বর ২০১৫

ঈদ-উল-আযহা বা  কোরবানির ঈদ

পবিত্র ঈদ-উল-আযহা মুসলিম বিশ্বে পালিত হয় জাঁকজমকের সঙ্গে। প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম মক্কা থেকে মদীনায় হিজরত করে এসে দেখতে পান এখানকার অধিবাসীগণ বছরে দুটো উৎসব পালন করে। সে উৎসবে তারা অশ্লীল গান-বাজনা, নর্তন-কুর্দন করে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে তিনি ঈদ-উল-আযহা এবং ঈদ-উল-ফিতরের ঘোষণা দেন। ঈদ-উল-ফিতরের সঙ্গে জড়িয়ে আছে রমজানের সিয়াম পালনের মাধুর্য এবং ঈদ-উল-আযহার সঙ্গে জড়িয়ে আছে মুসলিম জাতির জনক হযরত ইব্রাহীম আলায়হিস সাল্লাম ও তাঁর জ্যেষ্ঠপুত্র হযরত ইসমাঈল আলায়হিস সাল্লামের কোরবানির স্মৃতি। প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম এই হযরত ইসমাঈল আলায়হিস সাল্লামের বংশধর। মক্কা শরীফে হজ পালিত হতো এবং জিলহজ মাসের ১০ তারিখে কোরবানির উৎসব পালিত হতো, কিন্তু তাতে ছিল শিরক, কুফর ও কুসংস্কার ভরা। সে সময় কোরবানির পশু নিয়ে চলত নানা কর্মকা-। এসব কর্মকা-ে তৎকালীন আরব সমাজের নানা সঙ্গতি-অসঙ্গতি উঠে আসত। বাইরে থেকে আসা লোকজন আরাফাত ময়দানে সমবেত হতো আর কোরাইশ গোত্রের লোকজন সাধারণ লোকের সঙ্গে আরাফাতে গেলে মিশতে হবে, তাই তারা আরাফাতে যেত না। নবম হিজরীতে (৩১ খ্রিস্টাব্দ) হজের হুকুম নাযিল হলে ৬৩২ খিস্টাব্দে তিনি হজ পালন করতে মক্কা এলেন। ৯ জিলহজ আরাফাতে অবস্থান করে ১০ জিলহজ মিনাতে এসে বড় শয়তানের চিহ্নিত স্থানে ৭টি কঙ্কর মেরে তিনি ১০০টি উট এবং তাঁর বিবিগণের জন্য একটা গরু কোরবানি দিলেন। সাহাবায়ে কেরামও যার যার সাধ্য অনুযায়ী কোরবানি দিলেন। সেই থেকে হযরত ইব্রাহীম আলায়হিস সাল্লাম ও হযরত ইসমাঈল আলায়হিস সাল্লাম আল্লাহর সন্তুষ্টি ও নৈকট্য লাভের উদ্দেশ্যে কোরবানির নিয়ম প্রবর্তন করেছিলেন। তাঁদের উত্তর পুরুষ হযরত মুহম্মদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম সেই কোরবানি পুনর্জীবিত করলেন। আমরা জানি বার্ধক্যে উপনীত হয়েও হযরত ইব্রাহীম আলায়হিস সাল্লামের কোন সন্তান হয়নি। তাঁর বিবি হযরত সারাও বার্ধক্যে উপনীত হয়েছিলেন। হযরত ইব্রাহীম (আ.) এক অভিজাত পরিবারের সুন্দরী কন্যা হযরত হাজরা আলায়হিস সাল্লামকে শাদী করে নিয়ে এলেন। তাঁর গর্ভে একটা পুত্রসন্তান জন্মগ্রহণ করলেন। আল্লাহর নির্দেশে তিনি শিশুপুত্রসহ হযরত হাজরা আলায়হিস সাল্লামকে বহু দূরে বিরানভূমি মক্কায় রেখে এলেন। একদিন আল্লাহ্ ইব্রাহীম (আ.)-কে নির্দেশ দিলেন সবচেয়ে প্রিয়বস্তুকে কোরবানি দিতে। কোরান মজীদে ইরশাদ হয়েছে : (ইব্রাহীম দু’আ করল) ‘হে আমার রব! আমাকে এক সৎপরায়ণ সন্তান দান করুন। অতঃপর আমি (আল্লাহ্্) তাঁকে এক স্থিরবুদ্ধি পুত্রের সুসংবাদ দিলাম। অতঃপর সে (পুত্র) যখন পিতার সঙ্গে কাজ করবার বয়সে উপনীত হলো তখন ইব্রাহীম বললেন : হে আমার পুত্র! আমি স্বপ্নে দেখলাম আমি তোমাকে যবেহ্্ করছি, এ ব্যাপারে মতামত কী তা আমাকে বল। সে (পুত্র) বলল : হে আমার পিতা! আপনি যা আদিষ্ট হয়েছেন সেটাই করুন, ইনশাআল্লাহ আপনি আমাকে ধৈর্যশীল পাবেন। যখন তাঁরা (পিতা-পুত্র) উভয়েই আনুগত্য প্রকাশ করলেন এবং ইব্রাহীম তাঁর পুত্রকে কাত করে শোয়ালেন তখন আমি তাঁকে আহ্বান করে বললাম : হে ইব্রাহীম! তুমি তো সত্যিই স্বপ্নাদেশ পালন করলে। এভাবেই আমি সৎ কর্মপরায়ণদের পুরস্কৃত করে থাকি। নিশ্চয়ই এটা ছিল এক পরীক্ষা, আমি তাঁকে মুক্ত করলাম এক কোরবানির বিনিময়ে। আমি এটা পরবর্তীদের স্মরণে রেখেছি।’ (সূরা সাফফাত : আয়াত ১০০-১০৮)। হযরত ইব্রাহীম আলায়হিস সাল্লাম পুত্র ইসমাইল আলায়হিস সাল্লামকে কোরবানি দেয়ার উদ্দেশ্যে মক্কা থেকে তিন মাইল দূরে মিনা নামক স্থানে নিয়ে যাওয়ার সময় তিনটি স্থানে শয়তান তাঁদের ধোঁকা দেয়ার চেষ্টা করলে তাঁরা পাথর মেরে শয়তানকে তাড়িয়ে দেন। সেই তিনটি স্থান চিহ্নিত করে এখন হাজীগণ শয়তানকে লক্ষ্য করে কঙ্কর নিক্ষেপ করেন। মিনাতে যেখানে বর্তমানে মসজিদে খইফ রয়েছে, সেখানটিতেই এই কোরবানির ঘটনা ঘটেছিল। আল্লাহর নির্দেশে হযরত ইব্রাহীম আলায়হিস সাল্লাম পুত্রের বদলে একটা দুম্বা কোরবানি দিয়েছিলেন। ঈদ-উল-আযহা বা কোরবানির ঈদ বাংলাদেশের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনে এক বিপ্লবী চেতনার উন্মেষের ঘটনা। এ এমন এক আনন্দউৎসব যা শুধু জীবনকে জানবার এবং উপলব্ধি করবার প্রেরণাই দান করে না বরং আল্লাহর সঙ্গে বান্দার নৈকট্য লাভের পথও প্রশস্ত করে দেয়। কোরবানির পশু কোরবানির সময় যে নিয়ত করা হয় তাতে দুটো তাৎপর্যপূর্ণ আয়াতও উচ্চারণ করা হয় আর তা হচ্ছে : ‘আমি মুখ একনিষ্ঠভাবে ফিরাচ্ছি সেই মহান সত্তার দিকে যিনি আসমান ও জমিন সৃষ্টি করেছেন এবং আমি মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত নই। আরও উচ্চারিত হয় আমার সালাত ও আমার কোরবানি এবং আমার জীবন ও আমার মরণ আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের জন্য।’ আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ভাষায় বলা যায় : ‘ওরে হত্যা নয় এ সত্যাগ্রহ শক্তির উদ্বোধন।’ লেখক : পীর সাহেব, দ্বারিয়াপুর শরীফ, উপদেষ্টা ইনস্টিটিউট অব হযরত মুহম্মদ (সা.), সাবেক পরিচালক ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ।
×