ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

শাহীন রেজা নূর

ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে চাই দৃঢ় প্রতিরোধ

প্রকাশিত: ০৫:০৭, ২৪ সেপ্টেম্বর ২০১৫

ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে চাই  দৃঢ় প্রতিরোধ

বাংলাদেশে বিভিন্ন জঙ্গী সংগঠনের নানাবিধ অপতৎপরতার যে চিত্র প্রায় প্রতিদিনই উদ্ঘাটিত হচ্ছে, তাতে সরকার, সুশীল সমাজ এবং সার্বিকভাবে সকলেরই নতুন করে ভাবনা-চিন্তার প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। সন্দেহ নেই যে, জঙ্গীবাদ আজ তাবত বিশ্বের জন্যই এক সংকট রূপে দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, পাকিস্তান, ইরান, লিবিয়া, আফগানিস্তান, সিরিয়া এবং পশ্চিম ইউরোপের কিছু কিছু দেশে জঙ্গী তৎপরতা মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে দেখা যাচ্ছে। এর মধ্যে সিরিয়া, ইরাক, পাকিস্তান, লিবিয়ায় এই তৎপরতা উত্তরোত্তর বৃদ্ধিই শুধু পাচ্ছে না, একে বিশ্বের অন্যত্র ছড়িয়ে দেয়ার প্রয়াস-প্রচেষ্টাও চলছে অবলীলায়। দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় এর ডাল-পালা বিস্তারের চেষ্টাও নিশ্চয়ই কারও দৃষ্টি এড়ায় না। শান্তি ও সৌহার্দ্যরে ধর্ম ইসলামের অপব্যাখ্যা করে একশ্রেণীর ধর্মান্ধ যে জঘন্য কর্মকা-ে লিপ্ত হয়েছে, তা যে কোন শান্তিকামী, নিরীহ ও বিবেকবান মানুষের জন্য দুশ্চিন্তার কারণ। কেননা, পবিত্র ধর্মগ্রন্থ আল কোরানের অপব্যাখ্যার মাধ্যমে মানুষ হত্যার এমন জঘন্য আয়োজন প্রকৃত প্রস্তাবে দীন ইসলামের মহিমা ও মহত্ত্বকেই আজ বিনাশ করতে উদ্যত। তাই ধর্মপ্রাণ সত্যিকারের মুসলমানরা এই ধর্মান্ধদের অমানবিক ও নৃশংস কর্মকা-ে ক্ষুব্ধ না হয়ে পারে না। নিছক নিজেদের দুনিয়াবী স্বার্থ হাসিলের উদ্দেশ্যে এই ধর্মান্ধরা সরলপ্রাণ মুসলমান তরুণদের বিভ্রান্ত করে যে নির্দয়-নির্মম ঘটনাবলীর সূত্রপাত ঘটাচ্ছে, তা এক কথায় নিন্দনীয়, জঘন্য ও অবশ্যই পরিত্যাজ্য। যা হোক, বাংলাদেশে ইসলামী হুকুমত প্রতিষ্ঠার নামে সম্প্রতি একশ্রেণীর তরুণ-তরুণীকে যে জঙ্গী তৎপরতায় শামিল হতে দেখা যাচ্ছে, এর কারণ কী? এই কারণটি নির্ণয় করা অত্যন্ত জরুরী এই কারণে যে, এই অবস্থা সম্পর্কে জাতিকে সম্যক ধারণা না দিলে ক্রমান্বয়ে এর প্রতিকারের পথটিও কঠিন এমনকি দুঃসাধ্য হয়ে পড়তে পারে। মনে রাখা দরকার যে, এসব অপকর্মের জন্য দেশ ও জাতির সমূহ ক্ষতি সাধিত হয়। আর সে ক্ষতি যাতে ঠেকানো যায়, সেজন্য দেশের শান্তিপ্রিয় সকল মানুষকে এই অপকর্মকারীদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর শক্তি ও সাহস অর্জন করতে বা জোগাতে হবে। শুভবুদ্ধিসম্পন্ন সকল মানুষেরই তাই আজ কর্তব্য হচ্ছে বাংলাদেশে কারা, কিভাবে জঙ্গীবাদকে উস্কানি দিচ্ছে বা এর প্রসার ঘটানোর জন্য কাজ করে যাচ্ছে, তা অবিলম্বে খুঁজে বের করা ও তাদের মুখোশ উন্মোচন করা। সন্দেহ নেই যে, ২০০৯ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির সরকার দ্বিতীয়বার ক্ষমতারোহণের পর থেকেই এই দেশে বিএনপি-জামায়াতের ছত্রছায়ায় বাংলাদেশকে কিভাবে উলফা, লস্কর-ই-তৈয়বা, জেএমবি, হুজি, হিযবুত তাহ্্রীর প্রভৃতি জঙ্গী সংগঠনের অভয়ারণ্যে পরিণত করা হয়েছিল, তার কম-বেশি প্রমাণ ও তথ্য প্রকাশ পেতে শুরু করে। জাতি বিস্ময় ও ক্ষোভের সঙ্গে লক্ষ্য করে যে, বিএনপি-জামায়াত সরকার রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় ভারতের জঙ্গী সংগঠন উলফাসহ বিভিন্ন ভয়ঙ্কর জঙ্গীবাদীদের দীর্ঘদিন লালন-পালন করেছে ও করছে। চট্টগ্রামে দশ ট্রাক অবৈধ অস্ত্র ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে সরবরাহের পূর্বে ধরা পড়ে যাওয়ার পর এ বিষয়ে যেসব তথ্য প্রকাশ পেতে থাকে, তা রীতিমতো রাষ্ট্রদ্রোহিতামূলক, রোমাঞ্চকর এবং ভয়াবহ; আত্মবিনাশী তো বটেই! প্রতিবেশী ভারতে জঙ্গী তৎপরতা চালানোর ব্যাপারে সেখানকার জঙ্গীদের বাংলাদেশে সরকারী ও রাষ্ট্রীয়ভাবে আশ্রয়-প্রশ্রয়দান সর্ববিচারেই ছিল বাংলাদেশকে ভারতের দিক থেকে হুমকির মুখে ফেলে দেয়া। অর্থাৎ এইভাবে পৃষ্ঠপোষকতা প্রদানের অর্থ দাঁড়ায় বাংলাদেশ রাষ্ট্রটি ভারতের সংহতি ও অখ-তা ধ্বংসের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। আর এ কারণে ভারতের দিক থেকে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে কড়া অবস্থান গ্রহণ করা হলে তাকে অন্যায় বলার কোন সুযোগ থাকত কি! শুধু তাই নয়, এই জাতীয় ঘটনাকে কেন্দ্র করে ভারতের দিক থেকে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে সামরিক ব্যবস্থা গ্রহণের মতো ঘটনা ঘটাও বিচিত্র ছিল না। আর তেমনটা ঘটলে বাংলাদেশ ও বাংলাদেশের মানুষ এক লহমায় ভারতের বৈরী দৃষ্টিতে পড়ে যেত বৈকি! আর এক্ষেত্রে কার লাভ হতো? বলাই বাহুল্য, লাভ হতো পাকিস্তানী গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই এবং এর বাংলাদেশী তল্পিবাহকদের। কেননা, একাত্তরে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে ভারত সর্বাত্মক সহায়তা প্রদান এবং বাংলাদেশ সশস্ত্র যুদ্ধে পাকিস্তানকে পরাজিত করায় পাকিস্তানী সামরিক-বেসামরিক কুচক্রী প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর মুহূর্ত থেকেই তৎপর ছিল ও আছে। পাকিস্তানের কুচক্রীমহল এবং তাদের এদেশীয় পোষ্যপুত্ররা বরাবরই বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনকে মুসলমানের বিরুদ্ধে ভারতের চক্রান্ত বলে অভিহিত করে আসছে। অথচ পাকিস্তানী কায়েমী স্বার্থের বরকন্দাজদের অবিচার, অত্যাচার, শোষণ-বঞ্চনা ও বৈষম্যই যে পাকিস্তান ভাঙ্গার জন্য দায়ী, মতলববাজরা তা জেনেও ঘুণাক্ষরে সে কথা মুখে আনে না। আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধে হানাদার পাকিস্তানী বাহিনীর পক্ষ থেকে বেসামরিক ঘাতক বাহিনীর ভূমিকা পালনকারী জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী ছাত্রসংঘ প্রভৃতির নেতা বা হোতা গোলাম আযম একাত্তরে পাকিস্তানে পালিয়ে যাওয়ার পর থেকে কিভাবে ‘পূর্ব-পাকিস্তান উদ্ধার’ অভিযান শুরু করেছিল, তা নিশ্চয়ই কম-বেশি সকলেরই জানা। যে গোলাম আযম, নুরুল আমিন, মাহমুদ আলীরা বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর পাকিস্তানে আশ্রয় লাভ করেছিল, তারা কোনভাবেই যে বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে মেনে নিতে পারেনি, তা অর্বাচীনেও বোঝে। সেই গোলাম আযম পরবর্তীতে পাকিস্তানী গোয়েন্দা সংস্থার অন্যতম দোসররূপে আত্মপ্রকাশিত জেনারেল জিয়ার পৃষ্ঠপোষকতায় পাকিস্তানী পাসপোর্টে বাংলাদেশে প্রবেশ করে এবং জিয়ার পাকিস্তানপ্রেমী পতœী খালেদা জিয়ার সরকারের বদান্যতায় বাংলাদেশের নাগরিকত্ব শুধু ফেরত পায়নি, বরং এদেশের মাটিতে অবস্থানের সুবাদে তার ঘাতক দল জামায়াতে ইসলামীকে পুনরায় বাংলাদেশকে পাকিস্তানী কায়দার তথাকথিত ইসলামী ভাবধারায় ফিরিয়ে আনতে বিএনপির পৃষ্ঠপোষকতায় স্বচ্ছন্দে কাজ করে যায়। বাংলাদেশে ইসলাম বিপন্ন এবং স্বাধীন বাংলাদেশ ‘হিন্দু-ভারত’ দখল করে নিয়েছে, এ ধরনের মিথ্যা কথা বলে গো আযম ও তার স্যাঙাতরা সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন মুসলিম দেশকে বিভ্রান্ত করে এবং বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নস্যাতের অপতৎপরতায় শামিল হয় এই বাংলাদেশবিরোধী গোষ্ঠী। পাকিস্তান আমলে আওয়ামী লীগ বা প্রগতিবাদী অন্যান্য রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনসমূহের কর্মতৎপরতাকে তারা ইসলামবিরোধী আখ্যা দিয়ে এবং এসবের মধ্যে ভারতীয় ও কমিউনিস্টদের হাত আবিষ্কার করে যে মিথ্যার বেসাতী করে ফিরত আজও এর বিরাম নেই। আজও আওয়ামী লীগ সরকারের বা আওয়ামী লীগ সংগঠনের কাজ-কর্মকে তারা ভারতের প্রভাবান্বিত বা নির্দেশিত এবং ইসলামবিরোধী বলে মিথ্যা প্রচার চালিয়ে যাচ্ছে। অথচ স্বাধীন বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানই যে ইসলামী ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এবং বরাবরই আওয়ামী লীগই যে মসজিদ-মাদ্রাসায় সর্বোচ্চ অর্থ বরাদ্দ দিয়ে আসছে, এই তথ্যগুলো এসব বুজদিলের এ্যান্টেনায় ধরা পড়ে না। বেগম জিয়া আর তথাকথিত ইসলামী দল জামায়াতের নেতৃবৃন্দ ও তাদের দোসররা সেমিনারে, জনসভায়, টক শোতে একটি ভাঙ্গা রেকর্ডই বার বার বাজায় যে, আওয়ামী লীগ সরকার ইসলামবিরোধী এবং এই সরকারের আমলে ইসলামী নেতৃবৃন্দের ওপর নির্যাতন-নিগ্রহ চলছে! এ প্রসঙ্গে প্রথমেই বলতে হবে যে, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে মসজিদে উলুধ্বনি হবে, এই দেশ ভারতের করদ রাজ্য বনে যাবে ইত্যাদি যেসব কথা খালেদা জিয়াসহ বিএনপি-জামায়াত নেতারা বলে বেড়িয়েছেন, তারা কি জাতিকে দয়া করে জানাবেন যে, দেশে বর্তমান মসজিদ-মাদ্রাসার সংখ্যা কত? এবং এই সরকারের আমলে কত টাকা বছরওয়ারী বরাদ্দ পায় মসজিদ ও মাদ্রাসাসমূহ? দেশের কোন্ কোন্ মসজিদে নামাজের পরিবর্তে নামাজীরা উলুধ্বনি দিচ্ছে, সেটাও কি জানাবেন তারা? এই সরকার নামাজ পড়ার, রোজা পালনের, হজে গমনের এবং যাকাত প্রদানের ব্যাপারে বাংলাদেশের কোন মুসলমানকে বাধা দিয়েছে, এমন কোন নজির তারা দেখাতে পারবেন কি? ইসলাম ধর্ম পালনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের বৃহত্তর মুসলিম জনগোষ্ঠী আওয়ামী লীগের শাসনামলে বাধাগ্রস্ত হওয়া তো দূরের কথা, বরং অত্যন্ত স্বাচ্ছন্দ্যে ও নির্বিঘেœ ধর্ম-কর্ম করতে পারছেÑ এই খবরটি মতলববাজ ধর্মব্যবসায়ীদের জানা না থাকলেও, বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নেতৃবর্গ তা পরিপূর্ণভাবে জানেন। তারা এও জানেন যে, ধর্মরক্ষার দোহাই দিয়ে বিএনপি-জামায়াত দেশবাসীর বিরুদ্ধে কী ভয়ঙ্কর অধর্ম ও অন্যায় করে চলেছে। শুধু মুসলমানরাই নয়; এই সরকারের আমলে অন্য ধর্মাবলম্বীরাও তাদের ধর্ম পালন করতে পারছে নিরুপদ্রবে। তাই ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি অনুযায়ী সকল ধর্মের মানুষের সহাবস্থানের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপিত হয়েছে বাংলাদেশে এখন। বিএনপি-জামায়াতের শাসনাধীনে সংখ্যালঘুদের ওপর কী অকথ্য নির্যাতন চালানো হয়েছিল, তার প্রমাণ-পঞ্জি আন্তর্জাতিক মহলের কাছেও আছে। এমনকি বিশেষ ট্রাইব্যুনালে মৃত্যুদ-প্রাপ্ত একাত্তরের ঘাতক দেলাওয়ার হোসেন সাঈদীর রায়কে কেন্দ্র করে এবং বিগত সাধারণ নির্বাচনের আগে ও পরে এবং সম্প্রতি বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া জামায়াতের সহযোগিতায় আন্দোলনের নামে যে সহিংসতা চালায়, শত শত মানুষকে এসিড-বোমা হামলায় হত্যা করে, সেটা কোন্ ইসলাম তা বড্ড জানতে ইচ্ছে করে। সর্বোপরি তারা দেশের বিভিন্ন স্থানে হিন্দু ও বৌদ্ধ মন্দিরে যে ধ্বংসযজ্ঞ ঘটায় এবং সংখ্যালঘুদের নির্যাতনের মাধ্যমে সরকারকে বেকায়দায় ফেলার অপচেষ্টা চালায়, তাকে কি মহানবীর (স) ইসলামের সঙ্গে কোনভাবে মেলানো যায়? একশ্রেণীর ভ- ও প্রতারক আওয়ামী লীগারদের অমুসলমান প্রমাণের জন্য মিথ্যার বেসাতী চালায় ইসলামের নামে। এই কাজটি তারা সেই পাকিস্তান আমলেও করেছে। এরা বাংলার মুকুটহীন সম্রাট শেরেবাংলা একে ফজলুল হক, অন্যতম জনদরদী নেতা শহীদ সোহ্রাওয়ার্দী, মজলুম জননেতা মাওলানা ভাসানী আর খাড়াগর্দানে বাঙালীর স্বার্থরক্ষায় জীবনপাতকারী নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ইসলামবিরোধী ও ভারতের দালালরূপে বার বার চিহ্নিত করতে চেয়েছে মিথ্যা অপবাদ দিয়ে। অথচ এই নেতৃবৃন্দের সকলেই বাঙলার অধঃপতিত পশ্চাৎপদ মুসলিম জনগোষ্ঠী এবং এতদঞ্চলের বাঙালীর অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে আজীবন প্রাণপ্রাত সংগ্রাম করে গেছেন। শেরেবাংলা, সোহ্রাওয়ার্দী, ভাসানী, বঙ্গবন্ধু এতদঞ্চলের বাঙালীদের অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম করে গেছেন আজীবন। একই সঙ্গে তারা ছিলেন খাঁটি মুসলমান। খাঁটি মুসলমান তারাই কেবল যারা জাত-পাতের উর্ধে উঠে দেশের সকল ধর্মাবলম্বী মানুষের সেবায় ব্রতী হন। শেরেবাংলা ছিলেন মাথার চুল থেকে পায়ের নখ পর্যন্ত একজন খাঁটি মুসলমান ও খাঁটি বাঙালী। শহীদ সোহ্রাওয়ার্দীর জন্ম হয়েছিল উপমহাদেশের অন্যতম প্রধান এক বনেদি মুসলমান পরিবারে। ইসলাম ও মুসলমানদের জন্য এই পরিবারের অবদান এতই গৌরবময় যা ভাষায় প্রকাশ করা কঠিন। মাওলানা ভাসানী একজন পাবন্দ মুসলমান ও পীর হিসেবে অনেকের কাছে শ্রদ্ধার আসনে সমাসীন ছিলেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের ইসলাম ও মুসলমানদের প্রতি ভক্তি ও দরদ ছিল অপরিমেয়। অথচ তাদের সকলের বিরুদ্ধেই ইসলাম বিরোধিতার এবং ভারতপ্রীতির মিথ্যা ইলজাম চাপিয়েছেন একালের ধর্মব্যবসায়ীদের পূর্বসূরিরা। বর্তমানের এই ধর্মব্যবসায়ীরা সেই ট্র্যাডিশনই সমানে বজায় রেখেছে। ফলে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজী ও অত্যন্ত পাবন্দীর সঙ্গে ধর্ম পালনকারী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এদের চোখে ‘ইসলামবিরোধী’, আর মদ্যপান থেকে শুরু করে যাবতীয় সকল প্রকার সামাজিক অপকর্মে জড়িত নেতাকর্মীরা ‘ইসলামের খাদেম!’ কি অদ্ভুত এদের বিশ্লেষণ! আসলে যারা মতলবী, তারা নানা কৌশলে ও মিথ্যার বেসাতী চালিয়ে ধর্মপ্রাণ তরুণ-তরুণীদের মনে বাংলার প্রগতিশীল মুসলমানদের বিরুদ্ধে যে বিদ্বেষ সৃষ্টি করেছে, তা আল্লাহ পাক বা রসূল (স) এর নির্দেশিত পথের সম্পূর্ণ বিপরীত। মানুষ হত্যা করে যে পৈশাচিক আনন্দ বা উল্লাস এদের মনে জেগে ওঠে তা অমানবিক, অনৈসলামিক তো বটেই! মাদ্রাসায় যেসব তরুণ ভাইয়ের মনে হিংসার আগুন জ্বালিয়ে দেয়া হচ্ছে এবং বেহেস্ত লাভের শর্টকাট পন্থা হিসেবে মানুষ হত্যায় উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে, তাদের সত্যিকারের দ্বীন ইসলামে ফিরিয়ে আনতে হবে। যে অন্যায় ও পাশবিক কাজে তারা সম্পৃক্ত হচ্ছে, তা দুনিয়ায় এবং আখেরাতে তাদের নাজাতের পথ ইসলামের প্রকৃত অনুশাসন অনুযায়ী রুদ্ধ হতে বাধ্য। বিশ্বব্যাপী ইসলামী হুকুমত কায়েমের জন্য হিংসা বা সহিংসতার পথকে যারা সঠিক পন্থা বলে মনে করে, তাদের জানা উচিত যে, উমাইয়ারা, আব্বাসীয়রা বা ফাতেমীরা একের বিরুদ্ধে অপরে যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে প্রকৃত প্রস্তাবে পর্যায়ক্রমে বিলীন হয়ে গিয়েছিল। এরা সকলেই ইসলাম ধর্মের অনুসারী হওয়া সত্ত্বেও কেন বার বার ভ্রাতৃঘাতী লড়াইয়ে জড়িয়ে পড়েছিল? মুসলমানের ইতিহাসে বিভিন্ন পর্বে নিজেদের মধ্যে রক্তারক্তির কাহিনী ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে বৈকি! জবরদস্তিমূলকভাবে ইসলাম সারা দুনিয়ায় প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হলে বহু আগেই বিশ্বের বহু মুসলিম দেশ সমন্বয়ে একটি মাত্র ইসলামী দেশ প্রতিষ্ঠিত হতো। পাকিস্তানও টিকল না শুধু ধর্মকে রাষ্ট্রের একমাত্র বন্ধন হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে। ধর্মের মূল সুর ও বাণীই হচ্ছে মানবতাবাদ। আল্লাহপাক বিশ্বে তার খলিফা হিসেবে মানুষকে মর্যাদা দিয়েছেন। মানুষের প্রতি আল্লাহ ও তার নবীদের, আউলিয়া-দরবেশদের যে মমত্ব ইতিহাসের পরতে পরতে ছড়িয়ে রয়েছে, তা-ই ইসলামকে সাম্য ও মৈত্রীর সূতিকাগাররূপে প্রতিষ্ঠিত করেছে। আজ ইসলামের মহত্ত্ব, ঔদার্য ও মানবিকতা একশ্রেণীর ধর্মব্যবসায়ীর বেপরোয়া মিথ্যাচার ও পৈশাচিক উন্মাদনায় ভূলুণ্ঠিত হওয়ার জোগাড়। এর বিরুদ্ধে কবি কাজী নজরুল ইসলামের কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে প্রকৃত আল্লাহ ও তাঁর রসূলপ্রেমীদের উদ্দেশে আসুন এই আহ্বান জানাইÑ ‘জাগো ওঠো মুসলিম হাঁকো হায়দরি হাঁক।’ ভুললে চলবে না যে, ইসলাম বলেÑ ‘সকলের তরে মোরা সবাই, সুখ দুখ সম ভাগ করে নেবো সকলে ভাই।’ লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক
×